মোহাম্মদ মাকছুদ উল্লাহ; জীবনের জন্য খাদ্য জরুরি। খাদ্য ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে সৃষ্টিজগতের সব প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহপাক নিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘পৃথিবীতে বিচরণশীল যত প্রাণী রয়েছে সবার রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর, তিনিই জানেন তারা কোথায় থাকে আর কোথায় তাদের মরণ হবে। সব কিছুই একটি সুবিন্যস্ত কিতাবে সংরক্ষিত আছে’ (সূরা হুদ, আয়াত ৬)। এক এক প্রাণীর খাদ্য এক এক রকম। আবার অঞ্চলভেদে একই প্রাণীর খাদ্যাভ্যাস বিভিন্ন রকমের। মানুষের বেলায়ও খাদ্যাভ্যাসের বিভিন্নতা আছে। শীতপ্রধান অঞ্চলে যে প্রাণী বাস করে তার খাবার এক রকম, আবার গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে যে প্রাণী বাস করে তার খাদ্য অন্য রকম। মহান আল্লাহ নিজেই সব প্রাণীর খাদ্য সৃষ্টি, সংরক্ষণ, বিতরণ ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘অনেক প্রাণী এমন আছে, যারা তাদের রিজিক জমা করে রাখে না। আল্লাহই তাদের রিজিক দেন এবং তোমাদের রিজিকও তিনিই দেন। তিনি সব শোনেন সব জানেন (সূরা আনকাবুত, আয়াত ৬০)।
বিশাল এ পৃথিবীর কোথাও কোনো প্রাণী খাবারের কষ্ট পেলে তা মানুষের কারণেই পেয়ে থাকে। কারণ মানুষ বেশি পাওয়ার লোভে কখনও কখনও উৎপাদন বন্ধ রেখেছে, কখনও বা অসম বণ্টন করে অন্যদের বঞ্চিত করেছে। আবার কখনও মানুষের সীমালঙ্ঘনের কারণে চেপে বসা দুর্ভিক্ষ জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। সে ক্ষেত্রে উত্তোরণের পথ কী হবে তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনে বলে দিয়েছেন।
নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে দুর্ভিক্ষের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ মুহূর্তে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় হজরত ইউসুফ (আ.)-এর পলিসি হতে পারে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সফল উপায়। তখনকার মিসরের বাদশাহ একটি স্বপ্ন দেখে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যান। জ্ঞানীদের কাছে ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তারা ‘অলীক স্বপ্ন’ বলে এড়িয়ে যায়। বাদশাহর একজন সেবক হজরত ইউসুফ (আ.)-এর কথা বলেন। পবিত্র কোরআনে স্বপ্নের ব্যাখ্যাসহ মিসরের দুর্ভিক্ষ এবং তা মোকাবেলায় হজরত ইউসুফ (আ.)-এর নেয়া পদক্ষেপগুলো বড় সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
কোরআনের ভাষায়, ‘বাদশাহ বলল, আমি স্বপ্নে দেখেছি সাতটি মোটা গাভীকে সাতটি জীর্ণ-শীর্ণ গাভী খেয়ে ফেলেছে এবং দেখেছি সাতটি শীষ সবুজ সাতটি শীষ শুকনো। ওহে সভাসদবৃন্দ! তোমরা যদি স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানো তাহলে আমাকে বল। তারা বলল, এটি একটি অর্থহীন স্বপ্ন, আমরা এমন স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানি না। তারপর দু’জন কারাবন্দির মধ্যে যে মুক্তি পেয়েছিল দীর্ঘ সময় পর তার ইউসুফ (আ.)-এর কথা মনে পড়ল। সে বলল, আমি আপনাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দেব। আমাকে কারাগারে যাওয়ার সুযোগ দিন। কারাগারে এসে সে বলল, হে ইউসুফ! হে সত্যবাদী! সাতটি মোটা গাভীকে সাতটি শীর্ণকায় গাভী খেয়ে ফেলেছে এবং দেখেছি সাতটি শীষ সবুজ সাতটি শীষ শুকনো। আমাকে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দাও যাতে করে আমি মানুষকে জানাতে পারি।
ইউসুফ (আ.) বললেন, তোমরা সাত বছর লাগাতার চাষাবাদ করবে, তারপর তোমরা যে শষ্য সংগ্রহ করবে তার মধ্য থেকে যা তোমরা খাবে তা ছাড়া অবশিষ্ট শষ্য তোমরা শীষসহ সংগ্রহ করবে। তারপর আসবে সাতটি কঠিন দুর্ভিক্ষের বছর। এই সাত বছরে লোকেরা যা সঞ্চয় করে রেখেছে কেবল তাই খাবে। এ ছাড়া আর কোনো ফসল উৎপন্ন হবে না।
স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে বাদশাহ বলল, ইউসুফকে নিয়ে এসো, আমি তাকে আমার একান্ত সহচর হিসেবে নিয়োগ করব। ইউসুফকে দেখে বাদশাহ বলল, আজ তুমি আমাদের কাছে মর্যাদাবান ও বিশ্বাসভাজন মানুষে পরিণত হয়েছ। ইউসুফ বললেন, আমাকে দেশের ধন-সম্পদের দায়িত্ব দিন, আমি বিশ্বস্ত ও সুবিজ্ঞ হয়ে দায়িত্ব পালন করব। এভাবেই ইউসুফকে আমি সে দেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম। আমি যাকে ইচ্ছা তার প্রতি দয়া করি, আমি সৎ মানুষের শ্রম নষ্ট করি না।
দুর্ভিক্ষের সময় ইউসুফের ভাইয়েরা খাদ্য নিতে এলো। ইউসুফ তাদের চিনতে পারলেন। কিন্তু ভাইয়েরা তাকে চিনতে পারল না। যখন ইউসুফ তাদেরকে খাদ্য বণ্টন করে দিলেন তখন সে বলল, তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না- আমি মাপে পূর্ণ মাত্রায় দিই। অর্থাৎ আমার মাঝে স্বজনপ্রীতি কিংবা চুরির দোষ নেই (সূরা ইউসুফ)।
হজরত ইউসুফ (আ.)-এর এ ঘটনার মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় যে জরুরি বিষয়গুলো আল্লাহতায়ালা মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন তা হল- ১. কৃষি ও খাদ্য বিভাগের দায়িত্বশীলকে অবশ্যই খাদ্য ও ফসল উৎপাদন বিদ্যায় পারদর্শী এবং সুষম বণ্টনে অভিজ্ঞ হতে হবে। ২. তাকে অবশ্যই শতভাগ আমানতদার হতে হবে। ৩. খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ ও সংরক্ষণের বিজ্ঞান সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা থাকা চাই। ৪. জনগণের বাস্তব অবস্থার সঠিক তথ্য এবং পরিসংখ্যান জানতে হবে। ৫. প্রয়োজনমতো খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ৬. স্বজনপ্রীতি ও প্রতিহিংসার ঊর্ধ্বে থেকে সমবণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। ৭. জনগণের সামর্থ্যানুযায়ী বিনিময় মূল্য গ্রহণ করে এবং সামর্থ্যহীনদের বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। ৮. দুর্ভিক্ষকবলিত জনগণের প্রতি অনুগ্রহ নয় বরং অধিকার হিসেবে আপদকালে তাদের খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। ৯. ব্যবস্থা এমন হতে হবে যেন মানুষ সরকারি ত্রাণ সম্মানের সঙ্গে নিতে পারে। ১০. এ বিভাগের কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় ভাতা ও সুরক্ষার নিশ্চিত করতে হবে। ১১. সব কাজ তাকওয়ার ভিত্তিতে এবং সততার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে ১২. সবসময় মহান আল্লাহর ওপর আস্থা ও ভরসা রাখতে হবে।
লেখক : পেশ ইমাম, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ।