অনলাইন ডেস্ক : সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় চীনা অ্যাপলিকেশন টিকটকের অপারেশন যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করার পর থেকে এই অ্যাপটি ঘিরে বেইজিং-ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক বৈরিতা আলোচনায় উঠে এসেছে।
টিকটক অ্যাপটি চীনা সংস্থা বাইটড্যান্সের মালিকানাধীন অন্যতম জনপ্রিয় শর্ট ভিডিও প্ল্যাটফর্ম যা বিশ্বব্যাপী তরুণদের মধ্যে ভিডিও তৈরি ও শেয়ার করার ক্ষেত্রে বেশ জনপ্রিয়।
প্রায় ১৫০টি দেশে ১৫০ কোটি ইউজার রয়েছে অ্যাপটির। এছাড়া বিশ্বব্যাপী অ্যাপটি ডাউনলোড হয়েছে ২৬০ কোটি বার।
কিন্তু বহুল ব্যবহৃত টিকটকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে এটি ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করে সেসব তথ্য চীন সরকারের হাতে তুলে দেয়।
এই তথ্য পাচারের অভিযোগ তুলে এরইমধ্যে অ্যাপটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ ইউরোপীয় কমিশন।
কিছু কিছু গোয়েন্দা সংস্থার উদ্বেগ, অ্যাপটি সরকারি ডিভাইসে ডাউনলোড করলে তাদের সংবেদনশীল তথ্য অন্যের হাতে চলে যেতে পারে।
যদিও শুরু থেকেই এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে চীনা টেক সংস্থাটি।
তাদের দাবি, অ্যাপ ব্যবহারকারীদের তথ্য কখনোই অন্য কাউকে দেয় না। ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে তারা অন্যান্য সোশাল মিডিয়া কোম্পানির মতো একইভাবে কাজ করে।
টিকটক নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বিশ্লেষকদের মত হচ্ছে- এর পেছনে নিরাপত্তা ইস্যুতে সতর্ক থাকার বিষয়টি যেমন আছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক বিরোধের প্রভাবও এখানে স্পষ্ট।
তারা বলছেন টিকটকের বিরুদ্ধে অভিযোগ যতোটা এর নিরাপত্তাকে ঘিরে, তার চেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা এর জন্ম ও উৎস চীনে হওয়া। যে দোষে ইতোমধ্যে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে হুয়াওয়েই, জেডটিইসহ অন্য টেক প্রতিষ্ঠানগুলোও।
বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলছেন, এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে দুই দেশের রাজনৈতিক কোন্দল যে আরও গভীরতর হচ্ছে সেটিই প্রতীয়মান হয়। তিনি বলেন, দুই দেশের প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার বিষয়টিও এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ফুটে ওঠে।
“সার্বিকভাবে দুই দেশের মধ্যে যে প্রকট অবিশ্বাস সেটা স্পষ্টতই ধরা দিয়েছে,” তিনি বলেন।
একের পর এক খড়গ
টিকটক অ্যাপটি সবার আগে ভারতের সমর-কূটনীতির বিষয় হয়ে ওঠে। দুই হাজার কুড়ি সালের জুন মাসে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চীন ও ভারতের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘাতের পরপর ভারত সরকার দেশের ভেতর টিকটকসহ অর্ধশতাধিক চীনা অ্যাপের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
গত মাসে কানাডা সরকার নিরাপত্তা সংক্রান্ত কারণ দেখিয়ে দেশটির সব সরকারি ডিভাইসে টিকটক নিষিদ্ধ করে।
কাছাকাছি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রও তাদের সব ধরনের সরকারি ফোন থেকে টিকটক অ্যাপ ডিলিট করার জন্য সরকারের চাকুরীজীবীদের নির্দেশ দেয়।
এদিকে ইউরোপীয় কমিশনও সাইবার নিরাপত্তাজনিত কারণে কমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মোবাইল ফোনে টিকটক রাখা কিংবা এর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, “এই অ্যাপটির বৈশ্বিক নিরাপত্তা বা এর নজরদারির দিক নিয়ে কিছু উদ্বেগ রয়েছে। এ কারণে দেশগুলো রক্ষণশীল অবস্থানে আছে। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ওই দেশগুলোর যেমন নিজস্ব নীতি আছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের যে তিক্ত সম্পর্ক সেটার প্রভাব যে একেবারে নেই সেটা বলা যাবে না।”
যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও টিকটক নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। ২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির অজুহাতে এই অ্যাপটির অপারেশন পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার হুমকি দিয়েছিলেন। তার এক নির্বাহী আদেশে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের তৎপরতা ৪৫ দিনের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ হচ্ছে এই অ্যাপটি চীনা সরকারের কাছে তথ্য পাচার করছে।
বেইজিং এবং টিকটক উভয়েই এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং চীনা সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মার্কিন আদালতে অভিযোগ দায়ের করে। সেসময় আদালতের সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করা সম্ভব হয়নি।
এবারে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দফতর ও বাসভবন হোয়াইট হাউজ, প্রতিরক্ষা দফতর, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড স্টেটসহ সরকারের কিছু কিছু অফিস ইতোমধ্যে তাদের সব ধরনের ডিভাইসে টিকটক অ্যাপটিকে নিষিদ্ধ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ম্যানেজমেন্ট ও বাজেটের পরিচালক শালান্ডা ইয়ং সম্প্রতি বলেছেন, “এই অ্যাপটির কারণে সরকারের স্পর্শকাতর তথ্য যে ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে সেটি মোকাবেলায় এই সিদ্ধান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”
ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গে চিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং সাংবাদিকদের বলেছেন যে “বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দমন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। এ থেকে বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুপার-পাওয়ার রাষ্ট্র নিজেদের ব্যাপারে কতোটা অনিশ্চিত থাকে।”
তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচিত বাজার অর্থনীতি এবং ন্যায্য প্রতিযোগিতার নীতিমালাকে সম্মান করা, কোম্পানি দমন বন্ধ করা এবং বিদেশি কোম্পানিগুলো যাতে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্ত, ন্যায্য ও বৈষম্যহীনভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারে তার জন্য পরিবেশ তৈরি করা।”
বেইজিং-ওয়াশিংটন বিরোধ
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানবাধিকার পরিস্থিতিসহ আর্থ-বাণিজ্যিক ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পেছনে চীনকে দোষারোপ করা, উইঘুর মুসলিম নিপীড়ন এবং হংকংয়ের স্বশাসন নিয়ে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এখন এই অ্যাপ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন দ্বন্দ্ব।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও তার দেশের ইন্টারনেটকে চীনের প্রভাবমুক্ত করতে ক্লিন পাথ বা ক্লিন নেটওয়ার্ক পরিকল্পনার আওতায় পাঁচটি পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেন। সেগুলো হল ক্লিন ক্যারিয়ার, ক্লিন স্টোর, ক্লিন অ্যাপস, ক্লিন ক্লাউড এবং ক্লিন কেবল।
এরমধ্যে ক্লিন স্টোর হচ্ছে, গুগল অ্যাপ স্টোর বা অ্যাপল অ্যাপ স্টোরের মতো অ্যাপ বিতরণকারী প্ল্যাটফর্মকে চীনা অ্যাপমুক্ত করা।
রাজনৈতিক কোন্দলের প্রতিফলন
টিকটক কীভাবে কাজ করে, এর ডাটা সংরক্ষণ পদ্ধতি ও এর এলগরিদম নিয়ে অনেক প্রশ্ন তুলেছে পশ্চিমা দেশগুলো।
কিন্তু এই অ্যাপটির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্ররা তথ্য পাচারের যে অভিযোগ তুলেছে তার স্বপক্ষে কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেনি।
এ থেকে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন যে, টিকটকের বিরুদ্ধে এই খড়গ মূলত দেশটির সাথে রাজনৈতিক কোন্দলের একটি প্রতিফলন। মার্কিন নীতি এখন এমন যে, চীন সংশ্লিষ্ট কোনও কিছুই আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে তাদের উদ্বেগের বিষয়টিকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
ঠিক যেমন “জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষার” নামে চীনা কোম্পানি হুয়াওয়েইর সঙ্গে করা হয়েছে। সেই অভিযোগের পক্ষে আজ পর্যন্ত কোনও প্রমাণ দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, “যেহেতু এখানে একটি চীনা লিঙ্ক আছে, তাই তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা রয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে বৈশ্বিক পর্যায়ে দুই দেশের মতবিরোধের সংযোগ যে এখানে আছে, সেটার সম্ভাবনা একদম উড়িয়ে দেয়া যাবে না।”
বরং চীন তাদের ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের আস্থা অর্জনে মোবাইল অ্যাপলিকেশনটির সার্ভার যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে স্থাপন করে, যেন মার্কিন নাগরিকদের তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের আওতায় থাকে।
সেইসাথে ২০২০ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী বা সিইও হিসেবে একজন মার্কিন নাগরিক কেভিন এ মেয়ারকে দায়িত্ব দেয়া হয়। যদিও তিন মাসের মাথাতেই তিনি পদত্যাগ করেন। টিকটকের বিরুদ্ধে মার্কিন নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করা এবং চীন সরকারের সঙ্গে তথ্য বিনিময় সম্পর্কে সবার আগে প্রকাশ্যে অভিযোগ তুলেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাণিজ্যিক উপদেষ্টা। কিন্তু তিনি এ অভিযোগের পক্ষে কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
ওই বাণিজ্য উপদেষ্টা আগেও অভিযোগ করেছিলেন যে, চীন করোনাভাইরাস সৃষ্টি করেছে। এবং হুয়াওয়েই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও অভিযোগ করেছেন যে যারা টিকটক ব্যবহার করেন শেষ পর্যন্ত তাদের সব তথ্য চীনের কমিউনিস্ট পার্টির হাতে গিয়ে পড়তে পারে।
কিন্তু টিকটক কর্তৃপক্ষ সবসময় বলে আসছে, ব্যবহারকারীর কাছ থেকে তারা যেসব তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো চীনের বাইরে সংরক্ষণ করা হয়।
তারা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ডাটা যুক্তরাষ্ট্রেই সংরক্ষণ করা হয়। তার ব্যাকআপ রাখা হয় সিঙ্গাপুরে। ইউরোপের গোপনীয়তা সংক্রান্ত ইউনিটও সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডে স্থানান্তর করা হয়েছে।
সে সময় টিকটকের নীতি বিষয়ক প্রধান থিও বেরট্রাম বিবিসিকে বলেছিলেন, “ব্যবহারকারীরা চীনা কমিউনিস্ট সরকারের আঙ্গুলের নিচে চলে যাবে এই ধারণা সর্বৈব মিথ্যা।”
এরপরও বছরের পর বছর ধরে পশ্চিমা দেশগুলো টিকটকের বিরুদ্ধে শুধু অভিযোগই করে আসছে, কিন্তু কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি।
চীনে ২০১৭ সালে যে জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে সে অনুযায়ী দেশটির যেকোনো সংগঠন অথবা নাগরিক রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে সাহায্য সহযোগিতা করতে বাধ্য।
এ ব্যাপারে মি. বেরট্রাম বলেছেন, “টিকটকের কাছে চীন সরকার যদি কখনো ব্যবহারকারীর তথ্য চাইতো, তাহলে আমরা অবশ্যই তাদেরকে না বলে দিতাম।” তবে কমিউনিস্ট পার্টিকে অসন্তুষ্ট করলে তার পরিণতি কী হতে পারে সে বিষয়টি বাইটড্যান্সকে মনে রাখতে হবে।
এই কোম্পানির নিজের জনপ্রিয় সংবাদ বিষয়ক অ্যাপ টুটিয়াওকে ২০১৭ সালে একবার ২৪ ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
চায়না মর্নিং পোস্টের খবর অনুসারে, অ্যাপটি প্রচারণাধর্মী ও অশালীন বিষয় ছড়াচ্ছে- বেইজিং ইন্টারনেট ইনফরমেশন অফিস এই অভিযোগ আনার পর অ্যাপটি কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও গোয়েন্দা বিভাগের কথা মতো কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে এই কোম্পানি ও তার নেতৃত্বের ওপরেও তার বড় রকমের প্রভাব পড়তে পারে।
সূত্র-বিবিসি।