নিজস্ব প্রতিবেদক: দিনের পর দিন কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড কে তোয়াক্কা না করে লেনদেনে অটুট পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত দুই কোম্পানি বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড এবং পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড । পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে একই ব্যাক্তি এক সাথে এই দুইটি কোম্পানিতে একই পদে দ্বায়িত্বরত রয়েছেন। এমনকি দুই কোম্পানির ফ্যাক্টরি ও অফিসের ঠিকানাও একই। এই বিষয়ে কর্পোরেট সংবাদে তথ্যবহুল প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়েছে বহুবার। এমনকি অভিহিতও করা হয়েছে রেগুলেটরি সংস্থাগুলোতেও। তারপরেও বিষয়টি আমলে নেয়নি নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ।
তথ্যমতে, এই কোম্পানি দুটির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন। উভয় প্রতিষ্ঠানে কোম্পানি সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান, সিএফও হিসেবে নাইমুল ইসলাম, হেড অফ ইন্ট্রানাল অডিটর মো. সাখাওয়াত হোসেন দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিষ্ঠান দুটির ফ্যাক্টরি শ্রীরামপুর, ধামরাই দেখানো হয়েছে। এছাড়া নিবন্ধিত অফিসের ঠিকানা দেখানো হয়েছে প্লট নং- ৩১৪/এ, রোড নং- ১৮, ব্লক-ই, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা।
যদিও কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড (৩ জুন ২০১৮) এর ৩ (১) (সি) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, কোনও কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, কোম্পানি সচিব বা প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা একইসময় অন্য কোনও কোম্পানি, প্রতিষ্ঠানে একই পদে বা অন্য কোনও পদে নিযুক্ত থাকতে পারবেন না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কোম্পানি সেক্রেটারি মো: মোস্তাফিজুর রহমান কর্পোরেট সংবাদকে জানান, ‘ আমাদের ম্যান পাওয়ার আছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে আমাদের জবাবদিহী করেনি। যদি নিয়স্ত্রক সংস্থা থেকে এমন কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাহলে আমরা তা মেনে নিবো এবং কোম্পানির পক্ষ থেকেও পরিচালনা পর্ষদেও পরিবর্তন আনা হবে। কিন্তু আমাদের এ প্রসঙ্গে এখনো জানানো হয়নি ।’
এ ব্যাপারে বরাবরের মত দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এর প্রধান অপারেশন কর্মকর্তা মো: সাইফুর কে জানালে তিনি পড়ে জানাবেন বলে জানান ।
কোম্পানি দুটির প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক মোঃ মিজানুর রহমান, এফসিএস বলেন, “ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঠিক তদারকির অভাবে এসব কোম্পানি বার বার সাধারণ বিনিয়োগকারিদের ঠকাচ্ছে। তিনি আরোও বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রনকারি কর্তৃপক্ষের ঠিলে-ঠালা মনিটরিং ও বিএসইসির উদাসিনতায় পুঁজিবাজারে এ ধরনের কোম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে পুঁজিবাজার কখনোই স্বাভাবিক আচরণ করছেনা।
পুঁজিবাজারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে এবং বিনিয়োগকারিদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে আরো কঠোরভাবে মনিটরিং করার পরামর্শ দিয়েছেন এই বিশ্লেষক।
এর আগে ২০০৯ সালে পুঁজিবাজারে বিভিন্ন অনিয়মের কারনে কোম্পানি দুটিকে মূল মার্কেট থেকে সরিয়ে (ওভার দ্য কাউন্টার) ওটিসি মার্কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে মুনাফায় ফেরার পাশাপাশি সুশাসনে উন্নতি করায় গত বছরের ১৩ জুন ওটিসি মার্কেট থেকে মূল মার্কেটে ফিরিয়ে আনা হয় এই দুই কোম্পানিকে। এসেই কারসাজি শুরু করেছিলো কোম্পানি গুলো। হঠাতি শেয়ার দাম বাড়তে থাকে কোম্পানিগুলোর ।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৫০ কোটি টাকা অনুমোদন সাপেক্ষে ১৯৮৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। কোম্পানিটির বর্তমান পরিশোধিত মূলধনের পরিমান ৯ কোটি ৩৮ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। বছরের পর বছর মুনাফা করলেও বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়েছে কোম্পানিটি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মনোস্পুল পেপারের নিট মুনাফা ছিল তিন কোটি আট লাখ ১৩ হাজার ৪৪৮ টাকা; ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল তিন কোটি ৮৬ লাখ ২২ হাজার ২৬১ টাকা; ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাঁচ কোটি ৭৩ লাখ ১৭ হাজার ৭৮৬ টাকা; ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছয় কোটি ৭৪ লাখ ৯০ হাজার ২৯৭ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক কোটি ৬৯ লাখ ৪২ হাজার ৭৬২ টাকা নিট মুনাফা করেছে কোম্পানিটি।
২০২১ সালে কোম্পানিটি ডিভিডেন্ড দিয়েছে ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড, ২০২০ সালে ৯ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড এবং ১০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড এবং ২০১৪ সালে ১০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড প্রদান করে কোম্পানিটি।
কোম্পানিটির মোট শেয়ার ৯৩ লক্ষ ৮৮ হাজার ৮২৫ টি। তার মধ্যে তারমধ্যে ৫৩.৮৩ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ০.৩৫ শতাংশ এবং বাকি ৪৫.৮২ শতাংশ শেয়ার সাধারন বিনিয়োগ কারিদের হাতে।
গত একবছরে বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড এর শেয়ার দর ওঠানামা করে সর্বনিম্ন ৭৩.১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৭৫ টাকায়।
অপরদিকে পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড এর অনুমোদিত মূলধনের পরিমান ২৫ কোটি টাকা। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমান ১০ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ার ১ কোটি ৪ লক্ষ ৪৯ হাজার টাকা ৬০০ টি। তারমধ্যে ৪৩.৯৬ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ০.৫৪ শতাংশ এবং বাকি ৫৫.৫০ শতাংশ শেয়ার সাধারন বিনিয়োগ কারিদের হাতে।
২০২১ সালে কোম্পানিটি ডিভিডেন্ড দিয়েছে ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড, ২০২০ সালে ১১ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড এবং ১১ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড।