তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের লেবুর চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। ভোজন রসিকদের কাছে লেবু একটি অপরিহার্য খাবার। সেই লেবুর চাহিদা হঠাৎ কমে যাওয়ায় সংকটে পড়েছেন চাষিরা।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের লেবুর বাজার থেকে প্রতিদিন যেখানে ৬ থেকে ৮ লাখ লেবু রাজধানী সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেত। দামও ছিল ভালো। কিন্তু হঠাৎ করেই তা নেমে এসেছে ৩ থেকে ৪ লাখে। লেবুর দামও কমেছে ২ থেকে ৩ গুণ। গত বছর এই সময়ে লেবুর দাম ছিল ২ থেকে ৪ টাকা প্রতিটি, কিন্তু চলতি বছরে এই সময়ে লেবুর দাম নেমে এসেছে ৫০ পয়সা থেকে দেড় টাকা প্রতি। ফলে মাথায় হাত পড়েছে লেবু চাষি ও ব্যবসায়ীদের।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জসহ ৭ উপজেলার পাহাড়-টিলা মাটি ও আবহাওয়া এ এলাকা লেবু চাষে খুবই উপযোগী ও প্রসিদ্ধ। প্রতি মৌসুমে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপকহারে কাগজি, চায়না, জারা, পাতি ও কাটা লেবুর উৎপাদন হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ফলন হয় শ্রীমঙ্গলে।
মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়া, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লেবু চাষ এবং ভারতীয় লেবু বাজারে আসায় শ্রীমঙ্গলের লেবু বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
লেবু ব্যবসায়ী সমিতির তথ্যনুসারে, শ্রীমঙ্গলসহ কমলগঞ্জ ও আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় দুই হাজার লেবুর বাগান রয়েছে। মূলত শ্রীমঙ্গলের আড়ৎ থেকেই এইসব বাগানের লেবু বিক্রি হয়। স্থানীয় সমিতির আওতাধীন ২২টি গুদাম ছাড়াও আরও অনেক ব্যবসায়ী রয়েছে। এখানকার পাইকারি বাজার থেকে লেবু নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, চাষীরা লেবু বিক্রি করতে এসে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে লেবু চাষে উৎসাহ হারাচ্ছেন তারা।
শ্রীমঙ্গল ভারত সীমান্তঘেঁষা শিবির বাড়ি খাস এলাকার লেবু চাষি লিটন মিয়া। তিনি বলেন, ‘গাছ থেকে একগাড়ি (২ হাজার পিস) লেবু সংগ্রহে মজুরি দিতে হয় ৭’শ ৫০ টাকা, বাজারে নিয়ে যেতে গাড়িভাড়া ১ হাজার টাকা। আমার এক গাড়ি লেবু বাজারে তুলতে মোট খরচ হয় ১হাজার ৭৫০ টাকা। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। এক দিন ৪০০ টাকা লাভ হলে পরের দিনেই ৩০০ টাকা লস হয়। এতে লেবু চাষে আর উৎসাহ পাচ্ছি না। অনেক চাষি লেবু গাছ থেকেই পেড়ে বাগানেই ফেলে দিচ্ছেন।’
লেবু চাষীরা জানান, একসময় সেপ্টেম্বরে লেবুর সিজন শেষ হয়ে যেত, কিন্তু বর্তমানে সারা বছর সিজন থাকে। কয়েক বছর আগেও শীতকালে লেবু পাওয়া যেত না। কিন্তু এখন উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ ও উচ্চ ফলনশীল চারা রোপণের কারণে সারাবছরই লেবু উৎপাদন হচ্ছে।
আরেক লেবু চাষী ছফেদ মিয়া জানান, তিনি এই বছর ৩০ একর জমিতে লেবু চাষ করেছেন। কিন্তু লেবু বিক্রি করে সার এবং মজুরি তুলতে পারছেন না। সেই সাথে সারের ব্যাপারে কোন সহযোগিতা পাননা কৃষিবিভাগ থেকে। এভাবে লস দিয়ে ব্যবসা বেশী দিন চালানো কঠিন।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ীর অভিযোগ, ভারত থেকে প্রচুর লেবু বাজারে ঢুকছে। যার ফলে লেবুর বাজারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এমনিতেই লেবুর দাম কম, তার ওপর ভারতীয় লেবু বাজারে আসায় দাম আরও কমছে।
শ্রীমঙ্গল লেবু ঘরের পরিচালক আশুতোষ চক্রবর্তী বলেন, ‘গত বছরের পর এই বছর হঠাৎ লেবুর বাজারে এই পরিবর্তন এসেছে। মূলত দেশের বিভিন্ন জায়গায় লেবুর চাষ বেড়েছে। আগে যেভাবে সারাদেশের লেবুর চাহিদা পূরণ করত শ্রীমঙ্গল। এখন আর সেভাবে নেই। দেশের চাহিদা পূরন হয়ে যায় অন্যান্য এলাকার লেবু থেকেই। তাই স্থানীয় বাজারে দাম কমে গেছে।’
চাষিরা বলছেন, এ বছর প্রথম দিকে বিরুপ আবহাওয়ায় লেবু বাগানের কিছু ক্ষতি হলেও ফলন ভালোই হয়েছে। প্রত্যন্ত জনপদের চাষিরা বিক্রির জন্য লেবু নিয়ে আসছেন বাজারে। আর করোনায় লেবুর বাড়তি চাহিদা থাকায় কাক-ডাকা ভোরে শুরু হত লেবুর ব্যবসা। তখন চাহিদাও ছিল তুঙ্গে। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই।
শ্রীমঙ্গল আড়ৎ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. জসিম জানান, এবার লেবুর দাম গত বছরের তুলনায় ৩ গুণ কমেছে। ফলে চাষীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তেমনি লেবুর আড়তদারেরাও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ জানান, এই জেলার মাটি ও আবহাওয়া লেবু চাষের জন্য উন্নত এবং প্রসিদ্ধ। জেলায় ১৫’শ থেকে ২ হাজার হেক্টর জমিতে এ বছর লেবু চাষ হয়েছে। কৃষকদের তারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন। বাজারদর ওঠানামা করা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তবে চাষিরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে ব্যাপারে তারা খেয়াল রেখে সব ধরনের ব্যবস্থা নেবেন।
ভারত থেকে স্থানীয় বাজারে লেবু আসার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এই রকম অভিযোগ আসেনি। যদি অভিযোগ পাই তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেব।’