অনলাইন ডেস্ক : জানুয়ারি মাসের এক তারিখে, সারা দুনিয়ার মানুষ আতশবাজি পুড়িয়ে, ঢাকঢোল পিটিয়ে, হৈহুল্লোর করে, উৎসব আয়োজনে খৃস্টাব্দের নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। কিন্তু উৎসব করার আগে, আপনি কি কখনো নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছেন কেন পহেলা জানুয়ারি বছরের প্রথম দিন?
এর আগে এক সময় ২৫শে মার্চ, আবার ২৫শে ডিসেম্বরসহ বিভিন্ন তারিখে বছরের শুরু ধরা হতো।
এর কারণটা ছিল মূলত রোমান পেগান উৎসব এবং দুই হাজার বছরেরও বেশি আগে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার যে ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা চালু করেছিলেন তার সূত্র ধরে।
জানুস
প্রাচীন রোমানদের জন্য, জানুয়ারি মাসটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এ মাসটি ছিল দেবতা জানুস, যার আরেক নাম ইয়ানুরিয়াস, ল্যাটিন ভাষায় যার অর্থ জানুয়ারি, তাকে উৎসর্গ করা মাস।
রোমান পৌরাণিক কাহিনীতে, জানুস হচ্ছেন দ্বিমুখী দেবতা, অর্থাৎ তাকে দুটি মুখ দিয়ে চিত্রিত করা হয়েছে। তাকে রূপান্তরের দেবতাও বলা হয়। অর্থাৎ যেকোন পরিবর্তনের শুরু এবং শেষের প্রতীক।
ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডায়ানা স্পেনসার ব্যাখ্যা বলেন, “জানুসের দুটি মুখের একটি সামনের দিকে এবং আরকটি পিছনের দিকে ঘোরানো।” সামনের মুখটি দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এবং পেছনের মুখটি অতীতের দিকে ফেরানোকে নির্দেশ করে।
জানুয়ারি বছরের প্রথম মাস হওয়ার পেছনে অতীত এবং ভবিষ্যৎ – উভয় দিকে তাকানোর একটা সম্পর্ক আছে। “সুতরাং যদি বছরের মধ্যে একটা সময় আসে যখন আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে ‘এটাই আবার শুরু করার সময়’, সেক্ষেত্রে জানুয়ারি প্রথম মাস হওয়াটা যৌক্তিক।”
আবার ইউরোপে এটি এমন এক সময় যখন শীতকালের পরের দিনগুলো দীর্ঘ হতে শুরু করে।
অধ্যাপক স্পেন্সার বলেছেন, “এটি রোমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল, কারণ এটি সেই ভয়ানক ছোট দিনগুলোর পরে আসতো, যখন পৃথিবী ছিল অন্ধকার, হীম শীতল এবং যখন ঠান্ডার কারণে কোন ফসল ফলত না৷”
কেননা, বছরের দীর্ঘতম রাত ২২শে ডিসেম্বর থেকে ক্রমে দিন বড় হতে থাকে, আর জানুয়ারির শুরু থেকে দিনের দৈর্ঘ্য বেড়ে যায় সূর্যের দক্ষিণায়নের ফলে। এ কারণে অধ্যাপক স্পেন্সারের মতে “জানুয়ারি এক ধরণের বিরতি এবং প্রতিফলনের সময়কাল।”
২৫শে ডিসেম্বর
সেসময় রোমানরা যতো বেশি ক্ষমতা অর্জন করতে শুরু করে, তারা নিজেদের বিশাল সাম্রাজ্য জুড়ে নিজেদের ক্যালেন্ডার ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। কিন্তু মধ্যযুগে, রোমের পতনের পরে, খ্রিস্টধর্ম নিজেদের দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে এবং তারা দাবি করে যে পহেলা জানুয়ারি পেগানদের তারিখ।
অনেক দেশে যেখানে খ্রিস্টধর্মের আধিপত্য ছিল, তারা ২৫শে মার্চকে নতুন বছরের শুরু হিসাবে উদযাপন করতে চেয়েছিল।
কারণ তাদের মতে, সেই দিনটি ছিল যখন দেবদূত গ্যাব্রিয়েল, ভার্জিন মেরির কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন।
স্পেন্সার বলেছেন, “যদিও খ্রিস্টের জন্মের সময় ক্রিসমাস হয়, কিন্তু খ্রিস্টের এ জন্মের ঘোষণাটি মেরির কাছে আরও আগে আসে যে, তিনি ঈশ্বরের এক নতুন অবতারের জন্ম দিতে চলেছেন।”
“সেই মুহূর্ত থেকে যেহেতু খ্রিস্টের গল্পের শুরু হয়েছে, তাই ২৫শে মার্চ থেকে নতুন বছর শুরু হওয়াকে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ভাবা হয়।”
পহেলা জানুয়ারি যেভাবে প্রথম দিন হলো বছরের
ষোড়শ শতকে, পোপ গ্রেগরি ত্রয়োদশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন এবং ক্যাথলিক দেশগুলিতে ওই সময় থেকে পহেলা জানুয়ারিকে নতুন বছরের শুরু হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। আমরা এখন যে ক্যালেন্ডার অনুসরণ করি বা যেটি ইংরেজি বর্ষপঞ্জি হিসেবে চেনেন অনেকে, সেটাই ‘গ্রেগরিয়ান’ ক্যালেন্ডার।
ইতালি, স্পেন এবং পর্তুগালের মতো ক্যাথলিক দেশগুলো তখন দ্রুতই এই নতুন ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে। তবে প্রোটেস্ট্যান্ট এবং অর্থোডক্স খ্রিস্টান প্রধান দেশগুলো এটি বেশ দেরিতে গ্রহণ করে।
ইংল্যান্ড, যে দেশটি পোপের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়কে গ্রহণ করেছিল, তারা ১৭৫২ সালের আগ পর্যন্ত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করেনি। এর আগ পর্যন্ত তারা ২৫ মার্চকেই নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে উদযাপন করতো। সে বছর ব্রিটেনের পার্লামেন্টের একটি আইন ব্রিটিশদের ইউরোপের বাকি অংশের সাথে একীভূত করেছিল।
এর আগে ১৬৯৯ সালে জার্মানির বিভিন্ন প্রোটেস্ট্যান্ট অধ্যুষিত রাজ্যগুলো নতুন এই বর্ষপঞ্জি গ্রহণ করে।
ব্রিটেনের পর ১৭৫৩ সালে সুইডেন, ১৮৭৩ সালে জাপান, ১৯১২ সালে চীন, ১৯১৮ সালে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং ইউরোপের সবশেষ দেশ হিসেবে গ্রীস ১৯২৩ সালে এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে।
এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টান প্রধান নয় এমন দেশও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতে শুরু করে।
বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে, আর ঠিক এই কারণেই আমরা প্রতি বছরের পহেলা জানুয়ারি সারা বিশ্বে আতশবাজি পোড়ানোর উদযাপন দেখি।
জুলিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের আগে প্রচলিত ছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। রোমান শাসক জুলিয়াস সিজার প্রথম শতকে ওই বর্ষপঞ্জি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
যেখানে বছরের সময়কাল ১১ সেকেন্ড বেশি স্থায়ী হয়। সেইসাথে দেখা যায় ক্যালেন্ডারটিতে লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ সংক্রান্ত কিছু ভুল গণনা ছিল। যে কারণে প্রায়শই ঋতুর সঙ্গে এর বিচ্যুতি ঘটতো। ফলে বার বার সংশোধন করতে হতো।
হিসাবে এই ভুলের কারণে পরের কয়েক শতক ভুল সময়ে পালিত হয় অনেক উৎসব। বিশেষ করে ‘ইস্টার’-এর তারিখ নির্ধারণে সমস্যা দেখা দেয়। পাশাপাশি নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়ায় সেসময় এই ক্যালেন্ডারের কিছু পরিবর্তন অত্যাবশ্যক হয়ে উঠে।
ফলস্বরূপ জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন এবং প্রতিস্থাপন হিসেবে চালু করা হয় বর্তমানের গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারটি। সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর কক্ষপথ পরিভ্রমণে ৩৬৫ দিন, পাঁচ ঘন্টা, ৪৮ মিনিট এবং ৪৫ দশমিক দুই পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগে। বছর এবং দিন তারিখের হিসাব এই পরিভ্রমণের সময়কালকে ঘিরেই নির্ধারণ করা হয়।
বিশ্বকোষ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুসারে, নতুন এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ৩৬৫ দিনে এক বছর গণনা করা হয়।
বাকি যে ঘণ্টা, মিনিট ও সেকেন্ড থাকে সেগুলোকে ভারসাম্যে আনতে প্রতি চার বছর পর পর লিপ ইয়ার থাকে, যেখানে প্রতি চার বছরে একদিন বেড়ে যায়। মূলত জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ভুল গণনা সংশোধন বা ঠিক করার জন্য, জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার ক্ল্যাভিয়াসকে একটি নতুন ক্যালেন্ডার ডিজাইন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানী লুইগি লিলিওর (অ্যালোসিয়াস লিলিয়াস) সুপারিশের ভিত্তিতে তৈরি হয় নতুন ক্যালেন্ডার, যা পরবর্তীতে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার হিসাবে পরিচিতি পায়।
নতুন পদ্ধতি অনুযায়ী প্রতি চতুর্থ বছর একটি অধিবর্ষ বা লিপ ইয়ার হবে। কিন্তু বেজোড় শতকের বছর অর্থাৎ যেসব বছর ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য নয়, সেগুলোকে এই পদ্ধতিতে ছাড় দেওয়া হয়।
যেমন ১৬০০, ২০০০, ২৪০০ সালগুলো লিপ ইয়ার ছিল। কিন্তু, ১৭০০, ১৮০০, এবং ১৯০০ বছর লিপ ইয়ারের তালিকা থেকে বাদ যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে এ সংশোধনী আনা হয় ১৫৮২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি।
পোপের শাসনে এই সংশোধনী গৃহীত হলেও, একে ঘিরে ধর্মীয় নেতা এবং পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছিল তখন। বিশেষ করে প্রোটেস্ট্যান্ট দেশগুলো নতুন ক্যালেন্ডারকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি যেভাবে সর্বজনীন হলো
গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সবচেয়ে বড় দিক হল এটি সর্বজনীন, যেখানে তারিখগুলো কখনই দিন পরিবর্তন করে না। তবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে, এমন অনেক দেশেরই তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যগত বা ধর্মীয় ক্যালেন্ডারও রয়েছে।
যেমন, বাংলাদেশের নিজস্ব বাংলা ১২ মাসের পঞ্জিকা রয়েছে। দেশটি ১৪শ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিবছর এপ্রিলের মাঝামাঝি বাংলা নববর্ষ পালন করে আসছে।
একইভাবে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মিয়নামার এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে থাকে।
এছাড়া ১৯১২ সালে চীন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করলেও তাদের নিজস্ব চন্দ্র বর্ষপঞ্জিও অনুসরণ করে এবং প্রতি বছর চীনসহ বিভিন্ন দেশে চীনা নববর্ষ উদযাপন অব্যাহত রেখেছে।
আবার ইথিওপিয়ার বাসিন্দারা সেপ্টেম্বর মাসে এনকুটাটাশ নামে নিজেদের ঐতিহ্য অনুযায়ী নববর্ষ উদযাপন করে। অন্যদিকে, মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোয় হিজরি নববর্ষ পালন হয়।
তবে, ঠিক এই মূহুর্তে অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক যোগাযোগে দাপ্তরিক কাজ সম্পাদনে পৃথিবী জুড়ে মূলত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সূত্র-বিবিসি।