সাইফুল ইসলাম পিপন।। পুঁজিবাজারকে বলা হয় একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। এখানে প্রতিদিন হাজারো বিনিয়োগকারী তাদের সঞ্চয়, পরিশ্রম ও ভবিষ্যৎ আশা নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। তাদের প্রত্যাশা থাকে— একটি স্বচ্ছ, ন্যায্য এবং নিরাপদ বাজার যেখানে বিনিয়োগের ফলাফল নির্ধারিত হবে সঠিক প্রতিযোগিতা ও প্রকৃত চাহিদা-যোগানের ভিত্তিতে। বাংলাদেশে এই বাজারের তত্ত্বাবধান ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (BSEC)। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, বাজারে কারসাজি শনাক্তকরণ ও শাস্তি প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতা এক ভয়াবহ সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি ২০২১ সালে সংঘটিত শেয়ার কারসাজিতে জরিমানার সিদ্ধান্ত এসেছে ২০২৫ সালে। চার বছরের এই বিলম্ব প্রমাণ করে যে, আমাদের সার্ভেইলেন্স টিম রিয়েল টাইম পর্যবেক্ষণে সক্ষম নয়। অথচ এই সময়ের মধ্যে কারসাজিতে জড়িতরা বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে নিরাপদে চলে যেতে পেরেছে। অন্যদিকে সাধারন বিনিয়োগকারীরা তাদের ক্ষতির বোঝা বহন করেছে এবং বাজারের আস্থা আরও দুর্বল হয়েছে।
এই সমস্যাটি বিচ্ছিন্ন নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটেছে। ২০২১-২২ এর Beximco কারসাজিতে জরিমানা করা হয় ২০২৪ সালে, কিন্তু জরিমানার অর্থ আদায় কার্যত হয়নি। অর্থাৎ শাস্তি ঘোষণাই যথেষ্ট নয়, এর বাস্তবায়ন আরও বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে, ২০২২ সালে ক্রিকেট তারকা Shakib Al Hasan এর বিরুদ্ধে শেয়ার প্রাইস ম্যানিপুলেশনের অভিযোগ ওঠে। মামলার নিষ্পত্তি ও শাস্তি ঘোষণায় দীর্ঘসূত্রিতা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। অনেকে মনে করেন, খ্যাতিমান ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আরও ধীরগতিতে কাজ করে। আবার, সিকিউরিটিজ প্রোমোশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (SPM) চেয়ারম্যান শেলি রহমানের বিরুদ্ধে ১৯৯৮ সালে শেয়ার কারসাজির অভিযোগ আনা হলে,৬ বছর পরে ২০০৪ সালে মামলা শুরু হয়। কিন্তু রায় ঘোষণা হয়েছে ২০১৬ সালে এসে— অর্থাৎ প্রায় ১২ বছর পর। সুতরাং এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ সন্ত্রাসীদের শাস্তি হয়তো হয়, কিন্তু এত দীর্ঘ বিলম্বে তা কার্যত বিনিয়োগকারীর ক্ষতি পূরণে কোনো কাজে আসে না। বরং কারসাজিকারীদের আরও সাহসী করে তোলে।
আস্থাহীনতার বহুমাত্রিক প্রভাবঃ বিলম্বিত বিচার শুধু বিনিয়োগকারীর আস্থা ভেঙে দেয় না, বরং পুরো অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলে। যেমন— ক) খুচরা বিনিয়োগকারী তথা যারা সামান্য মূলধন নিয়ে বাজারে আসে, তারা সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা দেখে— অপরাধীরা শাস্তি পায় বহু বছর পর, অথচ তাদের ক্ষতি আগেই হয়ে গেছে। খ) প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারীরাও বাজারের অনিশ্চয়তায় পুঁজির অবস্থান পুনর্বিবেচনা করে। গ) স্বচ্ছতা ও দ্রুত বিচার না থাকলে বিদেশি ফান্ড ম্যানেজাররা এই বাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে এবং দূরে সরে যায়, ফলে প্রত্যাশিত বৈদেশিক বিনিয়োগ আসে না।
কেন এই বিলম্ব?
১. রিয়েল টাইম প্রযুক্তির অভাবঃ সার্ভেইলেন্স টিমের কাছে এখনো আধুনিক সফটওয়্যার বা AI-ভিত্তিক সিস্টেম নেই।
২. জনবল সংকট ও দক্ষতার ঘাটতিঃ প্রতিদিনের কোটি কোটি লেনদেন পর্যবেক্ষণ করার মতো প্রশিক্ষিত জনবল পর্যাপ্ত নয়।
৩. আইনি জটিলতাঃ মামলা ও বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বছরের পর বছর কেটে যায়।
৪. জরিমানা আদায়ে অদক্ষতাঃ শাস্তি ঘোষণার পর জরিমানার অর্থ আদায় প্রায়শই অনিশ্চিত থেকে যায়।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটঃ ভারতের SEBI “Surveillance and Investigation Department” পরিচালনা করে, যা রিয়েল টাইমে সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করে। তাদের অ্যালগরিদমিক সফটওয়্যার কয়েক মিনিটের মধ্যে বাজার কারসাজি ট্রিগার করতে সক্ষম। সিঙ্গাপুরের Monetary Authority of Singapore (MAS) বিগডাটা অ্যানালাইটিক্স ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে। অস্বাভাবিক কেনাবেচা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত শুরু হয়। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের SEC অত্যাধুনিক AI surveillance চালু করেছে, যা ট্রেডিং অ্যালগরিদম ও হাই-ফ্রিকোয়েন্সি ট্রেডিং রিয়েল টাইমে ট্র্যাক করে। ফলে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত হয়, বিনিয়োগকারীর আস্থা বজায় থাকে। সুতরাং বোঝায় যায় যে, বাংলাদেশের তুলনায় এই দেশগুলো বহু এগিয়ে আছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে প্রস্তাবনাঃ
১. রিয়েল টাইম সার্ভেইলেন্স চালু: AI, বিগডাটা ও মেশিন লার্নিং ব্যবহারে প্রতিদিনের প্রতিটি ট্রেড পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
২. ফাস্ট-ট্র্যাক ট্রাইব্যুনাল: কারসাজি মামলাগুলো সাধারণ আদালতে নয়, বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।
৩. কার্যকর জরিমানা আদায়: শুধু জরিমানা ঘোষণা নয়, বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৪. দক্ষ জনবল: সার্ভেইলেন্স টিমকে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দিয়ে সক্ষম করে তুলতে হবে।
৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: ভারত, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশের মডেল অনুসরণ করে সিস্টেম তৈরি বা আপডেট করতে হবে।
পুঁজিবাজারে টিকে থাকার মূলমন্ত্র হলো আস্থা। কিন্তু বিলম্বিত বিচার সেই আস্থা ধ্বংস করছে। অপরাধীরা বাজার থেকে অর্থ তুলে নিরাপদে পালাচ্ছে, আর বিনিয়োগকারীরা কেবল ক্ষতির বোঝা বইছে। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে বিলম্বিত বিচার থেকে রিয়েল টাইম নজরদারি, দ্রুত বিচার এবং কার্যকর শাস্তির দিকে ফিরে এসে বাজারকে সন্ত্রাসমুক্ত করা। কারন, বাংলাদেশ যদি সময়মতো এই সংস্কারগুলো গ্রহণ না করে, তবে পুঁজিবাজার আর কখনোই টেকসই আস্থার জায়গায় দাঁড়াতে পারবে না। অথচ সুযোগ এখনো আছে— দ্রুত পদক্ষেপ নিলে এই বাজার আবারও বিনিয়োগকারীর আস্থা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে।
লেখক: মোঃ সাইফুল ইসলাম (পিপন), পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।



