‘খুলনার দ্বন্দ্বে’ কক্সবাজারে খুন হন কাউন্সিলর রব্বানী!

Posted on January 11, 2025

মোহাম্মদ রিদুয়ান হাফিজ, কক্সবাজার প্রতিনিধি: কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন এলাকায় খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর ও সেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গোলাম রাব্বানী টিপু হত্যার ঘটনা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল।

কে বা কারা কেন হত্যা করেছে টিপুকে? কেনইবা সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টের নিরিবিলি জায়গাকে হত্যাকান্ডের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে? সেই নারীকেই কী হত্যাকান্ডের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল? হত্যাকারী কিভাবে নিখুঁত করে একটি গুলিতে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করেছে? কোথায় সফরসঙ্গী সেই নারী? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে প্রশাসন!

বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) রাত ৮ টা ২০ মিনিটের দিকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন সীগাল হোটেলের সামনে গোলাম রব্বানীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

র‍্যাব জানায়, বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) সকাল ৭টার দিকে কক্সবাজারের সুগন্ধা এলাকার হোটেল গোল্ডেন হিলে আসেন গোলাম রব্বানী টিপু ও খুলনার সাবেক কাউন্সিলর শেখ হাসান ইফতেখার ওরফে চালু। এর দুই ঘন্টা পর সকাল ৯টায় হোটেলে আসেন রুমি নামের এক নারী। তারা দুই কক্ষ সংযুক্ত বিশিষ্ট বিশেষ কক্ষে ওঠেন।

এই ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খুলনার ১৬ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শেখ হাসান ইফতেখার ও কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার বাসিন্দা মেজবাহ হক ভুট্টোকে হেফাজতে নেয় র‍্যাব। কিন্তু রুমি (২৭) নামের ওই নারী এখনো পলাতক বলে জানান র‍্যাব-১৫ এর অধিনায়ক সাজ্জাদ হোসেন।

হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ৩১ মিনিটে মাস্ক পরা রুমি নামের ওই নারীকে নিয়ে হোটেল থেকে বের হন রব্বানী।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সুত্র বলছে, রুমি খুলনা মেডিকেল কলেজের একজন শিক্ষার্থী।

হোটেল থেকে বের হওয়ার দুই ঘন্টার মধ্যে রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে খুন হন কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপু। ঘটনাস্থল থেকে একটি গুলির খোসা উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

গুলির খোসাটির তথ্য বিশ্লেষণের পর সিআইডি সুত্রে জানা যায়, যে অস্ত্রটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটি পৃথিবীতে সব থেকে বহুল ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয় পিস্তল ৯ এমএম। তবে যে অস্ত্র দিয়ে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে সেটি বিশেষত মিয়ানমারের তৈরি এবং সবচেয়ে বেশী ব্যবহার হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তবে কী প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী (ট্রেইনড শুটার) ব্যবহার করা হয়েছে হত্যাকান্ডে?

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটি সুত্র ধারণা করছে, অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে সংগঠিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ব্যবহৃত হয়েছে ভাড়া করা প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা শ্যুটার।

এখন প্রশ্ন উঠছে কে বা কারা এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কাজ করেছে?

এ হত্যাকাণ্ডের কয়েকটি কারণ খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

১. জনপ্রতিনিধিত্ত্ব ও স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব?
২. আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সম্পৃক্ততা?
৩. খুলনার চরমপন্থী নেতা গাজী কামরুলের সাথেই দ্বন্ধের বলি কী টিপু?

১. জনপ্রতিনিধিত্ত্ব ও স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব:
স্বেচ্ছাসেবক লীগের খুলনা মহানগর শাখার সহসভাপতি গোলাম রব্বানী টিপুর বাবা মো. গোলাম আকবর ছিলেন স্কুলশিক্ষক। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রব্বানী মেজ। রব্বানীর ১৩ বছর বয়সী একটি ছেলে ও ৮ বছর বয়সী একটি কন্যা আছে। রব্বানীর জমিজমা কেনাবেচার ব্যবসা ছিল। একসময় কক্সবাজারেও তাঁর ব্যবসা ছিল।

৫ আগষ্টের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। এরই মধ্যে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা তার বাড়িতে একাধিক বার হামলাও করেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সুত্র থেকে জানা যায়, সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির বহিস্কৃত নেতা শরিফুল আনাম ও তার ছেলে আশিকুল আনামসহ একটি পক্ষ গোলাম রব্বানী টিপুর প্রতিপক্ষ প্রার্থী মো. কবির হোসেন কবু মোল্লাকে সমর্থন করেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। ৫ আগষ্টের পর গোলাম রব্বানী টিপুর বাড়িতে হামলার সাথে এদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।

২. আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা:
খুলনার দৌলতপুর ও দেয়ানা এলাকার অনেকের আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সাথে সম্পর্ক ছিল। এসবের সূত্র ধরে এলাকায় পক্ষ–বিপক্ষও আছে। ব্যক্তিগত আক্রোশ, পারিবারিক কোন্দল ও এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দৌলতপুর এলাকায় বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে।

২০১৫ সালের অক্টোবরে দৌলতপুর খান এ সবুর রোডে ইসলামি ব্যাংকের সামনে শহিদুল ইসলাম ওরফে হুজি শহীদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঠিকাদার ও জ্বালানি তেল ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম ওরফে হুজি শহীদ ছিলেন চরমপন্থী সংগঠনেরও নেতা।

ঠিকাদার হুজি শহীদকে হত্যায় তার ভাই তৌহিদ দৌলতপুর থানায় গোলাম রব্বানী টিপু, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর সুলতান মাহমুদ পিন্টু, দিঘলিয়া উপজেলার সুগন্ধি গ্রামের জুলকার নাঈম মুন্নাসহ ২০ জনকে আসামী করে মামলা করেন।

এরপর ২০২২ সালের ৩০ জুন নগরীর মুজগুন্নী এলাকায় ওই মামলার আসামী জুলকার নাঈম মুন্নাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি পূর্ববাংলা কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য ছিলেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটি সুত্রের তথ্য বলছে, হুজি শহীদ হত্যাকাণ্ডের প্রায় আসামীই টার্গেট কিলিং এর শিকার। সেই হুজি শহীদ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ কিনাও খোঁজা হচ্ছে!

৩. চরমপন্থী নেতা গাজী কামরুলের সাথেই দ্বন্ধের বলি কী টিপু?
খুলনার চরমপন্থী নেতা গাজী কামরুলের সাথে গোলাম রব্বানী টিপুর দ্বন্দ্ব ছিল। গাজী কামরুলের সাথে শহিদুল ইসলাম ওরফে হুজি শহিদের সম্পৃক্ততা ছিল। হুজি শহিদ নিহত হওয়ার পর গাজী কামরুলের সাথে গোলাম রব্বানী টিপুর দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যায়। এ বিষয়টিকেও দেখা হচ্ছে তদন্তে!

এদিকে নিহত গোলাম রব্বানীর ভাই গোলাম রসুল বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেন, “বহু গ্রুপ একত্র হয়ে বহুদিন ধরে রব্বানীকে হত্যা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে বাড়িতে বোমা হামলা হয়েছে। যেভাবেই হোক, তারা সফল হয়েছে। তবে আমি কারও নাম বলব না। যেটাই হোক, এটা আমাদের এলাকাভিত্তিক দ্বন্দ্ব।”

তার পরিবারের দাবী, পূর্বপরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কক্সবাজারে তাঁর (রব্বানী) শত্রু ছিল না। খুলনা, দৌলতপুর, পাবলা, দেয়ানা—এখান থেকেই এটার সূত্রপাত। অন্য বিষয়ের চেয়ে এটার পেছনে এলাকার দ্বন্দ্ব, এলাকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কাজ করেছে।

অন্যদিকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে হোটেল থেকে বের হওয়া সেই নারী সঙ্গীকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কার হাত রয়েছে সেই তথ্য পাওয়া যেতে পারে ওই নারীর কাছে এমন ধারণা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

প্রসঙ্গত, গোলাম রব্বানী খুলনা সিটির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদ্য সাবেক কাউন্সিলর এবং মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ সভাপতি। গত ২৬ সেপ্টেম্বর দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের সঙ্গে তাঁকেও অপসারণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন।