কানাই চক্রবত্তী : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জেলে জাতীয় চার নেতার খুনি অফিসাররা দেশ ত্যাগ করার সময় মোশতাকও তাদের সঙ্গে বিদেশ যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, জেনারেল ওসমানীর অনুরোধে এবং ভরসায় তিনি দেশেই থেকে যান। তবে, শেষ পর্যন্ত কোন অনুরোধ এবং কারো ভরসাই কাজ হয়নি। চরম অপমানকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই অনেকটা গলাধাক্কা খাওয়ার মত অবস্থায় তাকে রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়তে হয়েছিল । যদিও এর আগে খন্দকার মোশতাক আহমেদ নভেম্বরের টালমাটাল পরিস্থিতির সময় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের এবং তার নিজের জন্য আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। এছাড়াও প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় খালেদ মোশারফের বিরুদ্ধে আমেরিকার সাহায্যও কামনা করেন। পুরানো সর্ম্পকের দাবি নিয়ে তিনি আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব দেন।
পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি এই রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রস্তাব পাওয়ার পর আমেরিকার পক্ষ থেকে মোশতাক আসতে চাইলে তাকে স্বাগত জনানো হবে বলে জানানো হয়। বলা হয়, তার জীবনের যদি আশু বিপদ থাকে তাহলে তাকে তাদের দূতাবাসেও সামরিক আশ্রয় দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হবে। মোস্তাকের মূখ্যসচিব মাহবুবুল আলম চাষী রাষ্ট্রদূত বোস্টারের কাছে টেলিফোনে এই প্রস্তাব রাখেন। খুনি ফারুক ও রশিদের জন্যও এমন আশ্রয় খুঁজছিলেন তিনি।
আমেরিকান সাংবাদিক লেখক বি জেড খসরু‘র ইংরেজিতে লেখা ‘বাংলাদেশে মিলিটারি ক্যু সিআইএ লিঙ্ক’ গ্রন্থে এ সর্ম্পকে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সিরাজ উদ্দিন সাথী। বাংলাদেশে‘ দি ইউনিভার্সেল একাডেমি গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে।
অন্যদিকে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম তার ‘সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাত্ব পঁচাত্তর’ গ্রন্থে মোশতাকের ভরসার ব্যাপারে লিখেন ‘খন্দকার মোশতাক ছিলেন অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির মানুষ। খালেদের সঙ্গে কথা বলে তার ধারনা জন্মে, তিনি রাষ্ট্রপতি পদেই বহাল থাকবেন। খালেদ এবং বাহিনী প্রধানেরা তাকে রাষ্ট্রপতিরূপে সম্মান ও আনুগত্য প্রদর্শন করেই চলেছেন। তদুপরি জেনারেল ওসমানী সামরিক বাহিনীতে সবারই শ্রদ্ধার পাত্র, তিনিও মোশতাকের পক্ষে রয়েছেন।’
এর আগে পঁচাত্তরের ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে জেল খানায় নৃশংস ঘটনা ঘটে। এদিন দিবাগত রাত দুইটায় বিদ্রোহী অফিসাররা পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের রিসালদার মোসলেমের নেতৃত্বে একটি ক্ষুদ্র সশস্ত্র সেনাদল কে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠায়। এরা অস্ত্রসহ জেলের ভেতর ঢুকতে চাইলে জেল কর্তপক্ষ বাধা দেয়। এ সময় প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক নিজেই টেলিফোনে জেলারকে নির্দেশ দেন মোসলেম এবং সঙ্গীদের জেলের ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিতে। জেলের ভেতর ঢুকে তারা জেলের একটি কক্ষে আওয়ামী লীগের চারজন শীর্ষপর্যায়ের নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী এবং এএইচ এম কামারুজ্জামানকে গুলি করে হত্যা করে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এবং ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে নেতৃত্বের সংকট সৃষ্টি করার জন্য খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে এ জঘন্য হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়।
অবাক বিষয় হচ্ছে ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে এ নৃশংস ঘটনা ঘটলেও ৩ নভেম্বর সারাদিন ও রাতে এ ভয়াবহ ঘটনার বিন্দু বিসর্গ খালেদ মোশাররফসহ অন্য কেউ জানতে পারেন নি। পরদিন ৪ নভেম্বর কর্ণেল শাফায়াত জামিল জেল হত্যাকান্ডের সংবাদ পেয়েই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে বঙ্গভবনে গিয়ে খন্দকার মোশতাককে অপসারণ করার কথা বলেন। তিনি বলেন, তারা আর এক মুহূর্তের জন্য মোশতাককে প্রেসিডেন্ট পদে দেখতে চান না।
হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম লিখেছেন, খুনিরা দেশ ত্যাগের পর ক্যন্টনমেন্টে অবস্থানকারী কর্মকর্তারা ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন, কেন মোশতাককে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণ করা হচ্ছে না। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন নজরুল ও ক্যাপ্টেন দোস্ত মোহাম্মদের নেতৃত্বে ২য় ইষ্ট বেঙ্গলের দুটি কোম্পানী বঙ্গভবনে মোতায়েন করা হয়। এদিন বিকাল পাঁচটার দিকে মেজর ইকবাল বঙ্গভবন থেকে মেজর হাফিজের কাছে ফোন করে ক্ষুব্দ স্বরে জানতে চান মোশতাককে কেন সরানো হচ্ছে না, খালেদ ও দুই বাহিনী প্রধান মোশতাককে কেন বাগে আনতে পারছেন না। হাফিজ কর্নেল শাফায়াতকে জুনিয়র অফিসারদের ক্ষোভের কথা জানান। শায়ায়াত দুজন অফিসারকে নিয়ে বঙ্গভবনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সন্ধ্যা ছয়টায় শাফায়াত বঙ্গভবনে ঢুকলে মেজর ইকবাল, মেজর দিদার এবং অন্য অফিসাররা মোশতাককে অপসারণের জন্য তাকে অনুরোধ করেন।
খালেদ মোশাররফ এবং দুই বাহিনী প্রধান রাষ্ট্রপতির সচিবের কক্ষে কয়েক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছিলেন। মোশতাক ক্যোবিনেট মিটিং করছেন দীর্ঘ সময় ধরে। খালেদ মোশাররফ দুই বাহিনী প্রধানকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাবিনেট রুমের কাছে গেলে মোশতাক করিডরে বেরিয়ে আসেন। খালেদ অত্যন্ত বিনীতভাবে রাষ্ট্রপতিকে বলেন, তারা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাদের জরুরী আলাপ আছে। এসময় মোশতাক উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠেন তিনি অতীতে অনেক ব্রিগেডিয়ার এবং জেনারেল দেখেছেন। কি করতে হবে তা জানেন উল্লেখ করে বলেন, তিনি এখন ক্যাবিনেট মিটিং নিয়ে খুবই ব্যস্ত।
মোশতাকের উচ্চ কন্ঠের বক্তব্য শুনে করিডরে দন্ডায়মান মেজর ইকবালের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। চারজন সৈনিকসহ তিনি সামনে এগিয়ে এসে একে ৪৭ সাবমেশিন গান তাক করে মোশতাকের দিকে তাক করেন এবং বলে উঠেন ‘আপনি পাকিস্তানি বাহিনীর জেনারেলদের দেখেছেন। এখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজরদের দেখবেন। ইকবাল ও সৈনিকদের রুদ্রমূর্তি দেখে মোশতাক ভয়ে চুপসে যান। শাফায়েত জামিল এগিয়ে এসে মোশতাক ও ইকবালের মাঝামাঝি দাঁড়ালেন এবং মোশতাককে ক্যাবিনেট রুমে ঢুকিয়ে দেন। জেনারেল ওসমানী বাকবিতন্ডা শুনে করিডরে বেরিয়ে এসে সবাইকে কে শান্ত হতে বলেন। শাফায়েত জামিল এসময় সিডিএস মেজর জেনারেল খলিলকে বলেন, ‘জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে , আপনি এ সর্ম্পকে নিশ্চয় জেনেছেন, কিন্তু আমাদের কিছুই জানাননি। দেশের অশান্ত পরিস্থিতিতে আপনি নিস্ক্রিয়। আমি আপনাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হচ্ছি।’ খলিল মাথা নিচু করে বসে থাকলেন।
এর পর শাফায়াত বোমা দাগেন মোশতাককে। বলেন, আপনি একজন খুনি। আপনার নির্দেশে জেল হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। ১৫ আগস্টের রাষ্ট্রপতি হত্যাকান্ডেও আপনি জড়িত। তিনি মোশতাককে এখনই রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করার কথা বলেন।
এদিকে কর্নেল শাফায়াত, মেজর ইকবাল এবং সৈনিকদের রুদ্রমূর্তি দেখে মন্ত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে টেবিলের নিচে ঢুকে পড়েন। দু- একজন পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন। তাদের এক বালতি পানি এনে দেওয়া হলে সেখানে গ্লাস ডুবিয়ে কয়েকজন পানি পান করেন। জেনারেল ওসমানী পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য শাফায়াত ও ইকবালকে ক্যাবিনেট রুম থেকে বাইরে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তার কাছে পাঠিয়ে দিতে বলেন। শাফায়াত ও ইকবাল সৈনিকদের নিয়ে বেরিয়ে এলেন। কর্নেল মালেককে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর গ্রহনের জন্য কাগজপত্র প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
যাহোক অল্প সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের জন্য কাগজপত্র পেশ করা হয়। সেনা প্রধানের পদ থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের পদত্যাগপত্র গ্রহন করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল র্যাঙ্কে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান পদে নিয়োগ করে আদেশ জারি করেন মোশতাক। এছাড়া, জেল হত্যাকান্ডের তদন্ত করার জন্য বিচারপতি আহসান উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। আর শান্ত-সুবোধ বালকের মত অবশেষে নিজ পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করেন খন্দকার মোশতাক। এর পর তাকে গ্রেফতার করে প্রেসিডেন্টের সুইটে নিয়ে রাখা হয়। অন্যদিকে চারজন মন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ওবায়দুর রহমান ও নুরুল ইসলাম মনজুরকে জেল হত্যাকান্ডের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতার করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
৪র্থ ইষ্টবেঙ্গলের সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমিনুল হককে সেনা প্রধানের পিএস হিসাবে বদলি করা হয় এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল গাফফারকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় । জেল হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য জেল সুপারকে বঙ্গভবনে তলব করা হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমিনুল হক তার বক্তব্য রেকর্ড করেন। টেপকৃত রেকর্ড ৪৬ ব্রিগেডে মেজর হাফিজের অফিসের স্টিল আলমারিতে রাখা হয়, পরবর্তীকালে ৭ নভেম্বর পট পরিবর্তনের পর এটি সেখান থেকে উধাও হয়ে যায়। সূত্র-বাসস।