বিশ্ব বিখ‍্যাত অমুসলিম মনীষীদের দৃষ্টিতে হযরত মুহাম্মদ (স.)

Posted on October 10, 2022

জাকির হোসেন আজাদী: ১২ রবিউল আউয়াল পৃথিবীবাসীর জন্য শ্রেষ্ঠতম দিন। উচ্ছাসের দিন। অতিব আনন্দে উদ্বেলিত উদ্ভাসিত হওয়ার দিন। কারণ এই দিনে ধূলির ধরায় জগতের শ্রেষ্ঠ মহামানব সায়‍্যিদুল মুরসালিন রহমাতুল্লিল আলামীন মরু ভাস্কর মরু দুলাল মা আমিনার নয়নমনি হযরত মুহাম্মদ (স.) -এর শুভাগমন ঘটেছিল।

যাঁকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আসমান জমিন আঠারো হাজার মাখলুকাত কূল কায়েনাতের কোনো কিছুই সৃষ্টি করতেন না। প্রতি বছর তাঁর জন্মদিনের আনন্দে উদ্ভাসিত হয় সমগ্র মুসলিম জাহান। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে দিনটি সগৌরবে উদযাপিত হয়।

যাঁর সমতুল‍্য পৃথিবীর কেউ নেই সেই মানুষটি সম্পর্কে জগত বিখ‍্যাত মনীষীরা বিভিন্ন বাণী দিয়েছেন। যিশু বা হযরত ঈসা (আ.) বলেন, —”যে সব নবীকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে তাদের সংখ্যা এক লক্ষ চব্বিশ হাজার, যারা সত্য কথাই বলেছেন। কিন্তু আমার পরে সকল নবী ও রসূলগণের জ্যোতি প্রকাশ লাভ করবে এবং অন্ধকার থেকে তিনি মানুষদেরকে আলোকিত পথের দিকে ডাকবেন। কারণ তিনি আল্লাহর রসূল।

যিশু আরও বলেছেন, তিনি তোমাদের যুগে আসবেন না তোমাদের কয়েক বছর পর তিনি আগমন করবেন। যাঁর ওপর মেঘমালা ছায়া বিস্তার করবে। যাঁকে আল্লাহ মনোনীত করবেন তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ পরিচিত হবেন। তিনি আল্লাহবিমুখ লোকদের ওপর বিরাট ক্ষমতার অধিকারী হবেন । তিনি এমন সত্যতা নিয়ে আসবেন যে সকল নবীর সত্যতা থেকে অধিকতর সুস্পস্ট হবে। গৌতম বুদ্ধ (৪৮৫-৫৬৭ খ্রীষ্টপূর্ব) বললেন, আমিই একমাত্র বুদ্ধ বা শেষ বুদ্ধ নই। সময়মত আর একজন বুদ্ধ আসবেন। আমার চেয়েও তিনি পবিত্র ও অধিক আলোপ্রাপ্ত হবেন।

তাছাড়া বিশ্ব বিখ‍্যাত অমুসলিম মনীষীরাও মহানবীর সম্পর্কে অনেক সুন্দর সুন্দর বাণী দিয়েছেন। যেমন- স্কটল্যান্ডের খ্যাতিমান গ্রন্থাকার স্যার টমাস কারলাইল (১৭৯৫-১৮৬২ খ্রী:) তাঁর প্রধান গ্রন্থ অনু হিরোস হিরো ওয়ারশিপ এন্ড দি হিরোইন ইন হিসটরীতে লিখেছেন- মহানবীর আগমনে মানুষের সার্বিক অবস্থায় এবং চিন্তাধারায় এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। আল্লাহর সৃষ্টি মানুষ জাতির এক বিরাট অংশ অন্য কারো কথা অপেক্ষা মুহাম্মদের কথায়ই অধিকতর আস্থাশীল। অন্ধকার হতে আলোর পথের দিশারী হযরত মুহাম্মদ (স.)। তিনি নিজে যা নন তাই হওয়ার জন্য তিনি ভান করতেন না।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এডওয়াড গিবন বলেন, আশ্রয়প্রার্থীর জন্য বিশ্বস্ততম রক্ষাকারী ছিলেন মুহাম্মদ (স.)। কথাবার্তায় সব চেয়ে মিষ্ট ভাষি, সবচেয়ে মনোজ্ঞ তাকে যারা দেখেছেন তারা আবেগাপ্লুত হয়েছেন—অপ্রত্যাশিতভাবে। যারা কাছে এসেছে তারা তাঁকে ভালবেসেছেন। পরে তারা বিবরণ দিয়েছেন তাঁর মত মহামানব আগে কখনো দেখিনি পরেও না। মুহাম্মদ (স.) এর স্মৃতিশক্তি ছিল গভীর, তাঁর রসিকতা ছিল শালীন। তাঁর কল্পনা ছিল উন্নত ও মহত্। তাঁর বিচার বুদ্ধি ছিল তীক্ষ্ম। জাগতিক শক্তির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেও মুহাম্মদ (স.) নিজ গৃহের কাজগুলোও করতেন। তিনি আগুন জ্বালাতেন, ঘর ঝাড় দিতেন, দুগ্ধ দোহন করতেন এবং নিজ হাতে কাপড় সেলাই করতেন। তাঁর আনীত ধর্ম বিধান সর্বলোকের জন্য প্রযোজ্য।

কবি জন মিল্টন বলেছেন, “মুহাম্মদ আবির্ভূত হলেন ষষ্ঠ শতাব্দীতে এবং পৌত্তলিকতাকে নিশ্চিহ্ন করলেন এশিয়া, আফ্রিকা ও মিশরের অনেকাংশ থেকে যার সর্বাংশেই আজ পর্যন্ত এক আল্লাহর উপাসনা প্রতিষ্ঠিত। স্যার উইলিয়াম ম্যুর বলেন, “আবির্ভূত হলেন একটি মানুষ মুহাম্মদ, ব্যক্তিত্ব ও ঐশী নির্দেশ পরিচালনার দাবিতে যুদ্ধরত গোত্রগুলোর অসম্ভব মিলনকে প্রকৃতই সম্পন্ন করলেন।” ডব্লিউ মন্টোগুমারী ওয়াট বলেছেন, “মুহাম্মদ (স.) তাঁর যুগে তিনি ছিলেন একজন সামাজিক সংস্কারক, এমনকি নীতির শাস্ত্রের ক্ষেত্রেও। তিনি সৃষ্টি করেছিলেন সামাজিক নিরাপত্তার এক নতুন পরিবার সংগঠন; আর উভয়টিই ছিল পূর্বেকার ব্যবস্থার ওপর বিরাট উন্নতি সাধন।”

লেবাননের হিট্টি বংশীয় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও মার্কিন মুল্লুকে অধ্যাপনায় প্রশংসিত প্রফেসর ফিলিপ কে হিট্টি আরব জাতি ও দেশ নিয়ে অনেকগুলো তথ্যপূর্ণ ইতিহাস গ্রন্থ লিখেছেন। তিনি মহানবী সম্পর্কে বলেছেন, “মুহাম্মদ তাঁর স্বল্প পরিসর জীবনে অনুল্লেখযোগ্য জাতির মধ্য হতে এমন একটি জাতি ও ধর্মের গোড়াপত্তন করলেন যার ভৌগলিক প্রভাব খ্রীষ্টান ও ইহুদীদেরকেও অতিক্রম করলো। মানব জাতির বিপুল অংশ আজও তাঁর অনুসারী। অমায়িক ব্যবহার, অনুপম ভদ্রতা ও মহত্ শিক্ষার দ্বারা তিনি আরব জাতির অবস্থার পরিবর্তন ঘটান। মহত্ত্ব, সহানুভূতি ও বদান্যতার মাধ্যমে তিনি মানুষের হৃদয় জয় করেন। তিনি ন্যায়ের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কখনো ন্যায় নীতি ও পূণ্যতার পথ পরিহার করেননি। তিনি ওয়াদা খেলাফ করেননি বা কাউকে প্রতারিত করেননি। এমনকি তার আজীবন শত্রু, যারা তাকে দেশ হতে বের করে দিয়েছিল এবং সমগ্র আরব জাতিকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল চূড়ান্ত বিজয়ে তিনি প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। ব্যক্তিগত আক্রোশে তিনি কখনো কাউকে শাস্তি দেন নাই। সমগ্র দেশের শাসনকর্তা হয়েও তিনি পূর্বের মতই দারিদ্র্যপূর্ণ জীবন-যাপন করতেন। যার ফলে মৃত্যুকালে তাঁর ওয়ারিশদের জন্য কিছুই রেখে যাননি।”

অন্য একজন প্রাচ্য পণ্ডিত গিব তাঁর “মুহাম্মদেনিজম” শীর্ষক ইংরেজী গ্রন্থে বলেছেন, “আজ এটা এক বিশ্বজনীন সত্য যে, মুহাম্মদ নারীদেরকে উচ্চতর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন।” ফরাসী দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠতম পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদ প্রফেসর লামার্টিন তার ‘তুরস্কের ইতিহাস” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব, উপায় উপকরণের স্বল্পতা এবং বিস্ময়কর সফলতা এ তিনটি বিষয় যদি মানব প্রতিভার মানদণ্ড হয়, তাহলে ইতিহাসের অন্য কোন মহামানবকে এনে মুহাম্মদের সাথে তুলনা করবে এমন কে আছে? দার্শনিক বাগ্মী, ধর্ম প্রচারক, আইন প্রণেতা, যোদ্ধা, আদর্শ বিজেতা, মানবিক রীতি-নীতির প্রবর্তনকারী এবং একটি ধর্মীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা যিনি, তিনি মুহাম্মদ। তিনি বিনম্র তবু নির্ভীক, শিষ্ট তবু সাহসী, ছেলে মেয়েদের মহান প্রেমিক, তবু বিজ্ঞজন পরিবৃত। তিনি সবচেয়ে সম্মানিত, সব চেয়ে উন্নত, বরাবর সত্, সর্বদাই সত্যবাদী, শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসী এক প্রেমময় স্বামী, এক হিতৈষী পিতা, এক বাধ্য ও কৃতজ্ঞ পুত্র, বন্ধুত্বে অপরিবর্তনীয় এবং সহায়তায় ভ্রাতৃসুলভ, দয়ার্দ্র, অতিথিপরায়ন, উদার এবং নিজের জন্য সর্বদাই মিতাচারী। কঠিন তিনি মিথ্যা শপথের বিরুদ্ধে, ব্যভিচারীর বিরুদ্ধে। খুনী, কুত্সাকারী, অর্থলোভী, মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা এ ধরনের লোকদের বিরুদ্ধে। ধৈর্যে, বদান্যতায়, দয়ায়, পরোপকারিতায়, কৃতজ্ঞতায়, পিতা-মাতা গুরুজনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে এবং নিয়মিত আল্লাহর প্রার্থনা অনুষ্ঠানে এক মহান ধর্ম প্রচারক।”

জার্মানীর প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, পণ্ডিত ড. গুস্তাভ উইল মহানবী (স.)কে বিশ্বে আইনদাতা ও সমাজ সংস্কারের মূর্ত প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্য একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ স্টানলি লেনপুল বলেছেন, ধর্ম ও সাধুতার প্রচারক হিসেবে মুহাম্মদ যে রকম শ্রেষ্ঠ ছিলেন, রাষ্ট্র নায়ক হিসেবেও অনুরূপ শ্রেষ্ঠ। তিনি অদ্ভুত শক্তিতে, হূদয়ের উষ্ণতায়, অনুভূতির মাধুর্য ও বিশুদ্ধতায় ছিলেন বিশিষ্ট। জীবনে কখনো কাউকে তিনি আঘাত করেননি। সবচেয়ে খারাপ বাক্য যা তিনি কথাবার্তায় কখনো ব্যবহার করেছেন তা ছিল, “তার কি হয়েছে?” তার নাশিকা ধূলা মলিন হোক” তিনি (মুহাম্মদ) বলেছিলেন, “কাউকে অভিশাপ দেয়ার জন্য আমি প্রেরিত হয়নি, প্রেরিত হয়েছি বিশ্বজাহানের জন্য রহমত স্বরূপ”।

ইউরোপের প্রখ্যাত দার্শনিক-সাহিত্যিক জর্জ বার্নার্ড শ’ (১৮৫৬-১৯৫০) মহানবী (স.) সম্পর্কে বলেন, “আমি মুহাম্মদকে অধ্যয়ন করেছি। আমার বিশ্বাস- তাঁকে মানব জাতির ত্রাণকর্তা বলাই কর্তব্য। যদি তাঁর মত কোন ব্যক্তি আধুনিক জগতের একনায়কত্ব গ্রহণ করতেন তবে তিনি এর সমস্যাগুলো এরূপভাবে সমাধান করতে পারতেন যাতে বহু অনাকাঙ্ক্ষিত শান্তি ও সুখ অর্জিত হতো। আমি ভবিষ্যতদ্বাণী করছি, মুহাম্মদের ধর্ম আগামীদিনে পূর্ণ স্বীকৃতি লাভ করবে যেমন আজকের ইউরোপ তাকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে।” ইউরোপের বিশ্ব বিখ্যাত মহাবীর নেপোলিয়ান বোনাপার্ট তার “অটোবায়োগ্রাফী”তে বলেছেন, “আমি আল্লাহর মহিমা কীর্তন করি, এবং পূত চরিত্র ও দিব্য প্রেরণা দীপ্ত মুহাম্মদকে আর পবিত্র কুরআনকে শ্রদ্ধা নিবেদন করি।”

মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী সাহিত্যিক মাইকেল এইচ হার্ট তার “দি হানড্রেড” গ্রন্থে বলেন, “মুহাম্মদকে আমি বিশ্বের সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী মনীষীদের তালিকার শীর্ষে স্থান দিয়েছি, এতে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু মানব জাতির ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি ধর্মীয় ও ধর্মবহির্ভূত উভয় ক্ষেত্রে একযোগে বিপুলভাবে ও সর্বাধিক সফলকাম হয়েছেন।” ইংরেজ কবি জন কীটস বলেন, “পৃথিবীর যা কিছু মঙ্গলময়, যা কিছু মহত্ ও সুন্দর সবই নবী মুহাম্মদ। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই।”

তাছাড়া জন ডেভেন পোর্ট, জোসেফ হেল, ডা. স্যামুয়েল জনসন, প্রফেসর স্টিফেন্স, জন উইনিয়াম ড্রেপার, আলফ্রেড মার্টিন, মরিস গড ফ্রে, অর্থার গিলম্যান, ওয়াশিংটন আরভিং, এডওয়ার্ড মুনন্ট, রেভারেন্ড ডব্লিউ স্টিফেন, রেমন্ড এলিয়ন নিকলসন, মানবেন্দ্র নাথ রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু, মিসেস ইন্দিরা গান্ধীসহ শতাধিক বিশ্ব বিখ্যাত অমুসলিম ব্যক্তিত্বগণ মহানবী (স.)-এর প্রশংসার বাণী উচ্চারণ করেছেন। তাছাড়া এনসাইক্লোপিডিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্বকোষেও হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর সফল জীবনালেখ্য শ্রদ্ধার সাথে সন্নিবেশিত হয়েছে।

আমাদের কর্তব্য হলো আল্লাহর রসুল হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর এই আলোকিত জীবনাদর্শ হতে শিক্ষা আমাদের ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। এর মাধ্যমেই শান্তি, সমৃদ্ধি, উন্নতি, অগ্রগতি আসতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গীতিকবি।