প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী : বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতাসহ আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের কুচক্রী চক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মেরে ফেলে ভেবেছিল, তারা বাঙালির স্বাধীনতা হরণ করবে- বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের অংশ হিসেবে গড়ে তুলবে। অথচ মোশতাক ও জিয়ার সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। কালপরিক্রমায় জাতির জনক আরো শক্তিশালী হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের মাঝে বেঁচে আছেন।
বঙ্গবন্ধু সব সময় বাঙালির মঙ্গল কামনা করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দলীয় চেয়ারম্যানের বক্তৃতায় শোষণহীন সমাজ গঠনের জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেছিলেন যে, আমরা একটা শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়তে পারব, যেখানে মানুষ সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে পারবে। তিনি সেদিন দৃঢ়কণ্ঠে ঘুষখোরদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যে লোকটার মাইনে হাজার টাকা কিন্ত ব্যয় করে ৫ হাজার টাকা। যে লোকটার ইনকাম ৩ হাজার টাকা কেমন করে সে ব্যয় করে পনেরো হাজার টাকা?
তিনি আরো বলেছিলেন যে, এই জিনিসটা সমাজের কাছে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে তাহলেই আপনাদের ওপর আস্থা ফিরে আসবে। বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হলে ঘুষখোররা সুযোগ পেত না। দুর্ভাগ্যজনক যে, ৭৫-পরবর্তী সময়ে যে নিষ্ঠুর ও চক্রান্তকারীরা ক্ষমতা দখল করেছিল, তারা অন্যায় কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। দুর্নীতিকে তারা প্রশ্রয় দেয়। বঙ্গবন্ধু যেখানে শোষণহীন সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন, তারা সমাজ ব্যবস্থায় ইংরেজ, পাকিস্তানি শাসকদের পরিবর্তে দেশি শাসক নানা স্থানে আমদানি করেন এবং জনগণের সেবাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলেন।
বঙ্গবন্ধু তার উপরিউক্ত বক্তৃতায় আরো বলেছিলেন যে, যদি আমরা একটা শোষণহীন সমাজ গড়তে পারি, আমি বিশ্বাস করি, ইনশাআল্লাহ বাংলার মাটিতে যা এখনো আছে, তাতে ৭ কোটি লোক হলেও বাংলার মানুষ না খেয়ে মরতে পারে না। তাঁর এ বক্তব্য বিশেষভাবে প্রতিধানযোগ্য। বাংলার মানুষকে ভালোবেসে অকৃত্রিমভাবে প্রয়াস নিয়েছিলেন যাতে করে দেশ থেকে দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করা যায়। অথচ দেখা গেল নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জোর জবরদস্তি করে যারা ক্ষমতা দখল করলো সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের কোনো আনুগত্য রইল না। বরং তারা এক ধরনের দুর্নীতির বেড়াজাল গড়ে তুলল, যাতে করে সাধারণ মানুষ দুর্নীতির অসহায়ত্বে পড়ে। তাদের এই নিষ্ঠুরতা, প্রবঞ্চনাকে ইয়াজিদের শয়তানির সাথে তুলনীয়। অথচ বঙ্গবন্ধুর ওপর কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ড বরং তাকে আরো শক্তিশালী করেছে।
বক্তৃতায় জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন যে, আমাদের আদর্শ হলো বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে দুনিয়াতে বাঁচিয়ে রাখা, বাংলার দুঃখী মানুষকে পেট ভরে খাবার দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করা, যেখানে অত্যাচার-অবিচার-জুলুম থাকবে না, দুর্নীতি থাকবে না। এজন্য তিনি আরো বলেন, লেট আস অল ট্রাই ফর দ্যাট। আসুন আমরা চেষ্টা করি সে সম্পর্কে সকলে মিলে তার সে দেশ গড়ার প্রত্যয়, স্বাধীন জাতি হিসাবে বাঙালির নাম সমগ্র বিশ্ব উজ্জ্বল করার ইচ্ছা, তাঁতি-জেলে, কামার-কুমার কৃষক-কৃষাণি, শ্রমজীবী, মেহনতি মানুষকে পেটে-ভাতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দর্শন এবং একই সাথে বাঙালি সত্তার বিজয়, স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশের নাম বিশ্ব উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত হোক- এই প্রত্যয় সুদৃঢ়ভাবে মানুষকে সুগভীরভাবে উচ্চারণ করেছিলেন। মানুষের হিত সাধনে তিনি ছিলেন আপসহীন। বাংলার জনমানুষের প্রতি তাঁর ছিল সুগভীর ভালোবাসা। আর তাই তো যে সমস্ত কীট তাঁকে ও তাঁর পরিবার-পরিজনসহ ঘৃণ্যভাবে হত্যার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল, তারা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি জড়িতদের বিচার হয়েছে। তবে কয়েকজন বিদেশে থাকায় দণ্ড কার্যকর করা যায়নি। অন্যদিকে পরোক্ষভাবে যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির বিধান করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১৫ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন যে, কর্মী ভাইয়েরা, দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে তোমাদের একটি সুখী জাতি গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমাদের দল একটি গণতান্ত্রিক দল। জনগণের ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করেই আমাদের সরকার গঠিত হয়েছে এবং পার্টির মাধ্যমেই জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। পার্টি সমর্থন না করলে সরকার টিকে থাকতে পারে না। বস্তুত বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় দলীয় কর্মীদের জনসেবা ও জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে বলেছিলেন। মানুষের সেবার মাধ্যমে দেশে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত রূপ কাটিয়ে উঠে কত দ্রুত স্বাবলম্বী হওয়া যায় তা প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ছিল সাধারণ জনমানুষের কল্যাণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করা। যে দলের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে, সে দলের মাধ্যমে জনগণের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট দূর করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ন রাখা। এ জন্য তিনি যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করাও শুরু করেছিলেন। তাঁর দুঃখজনক মৃত্যুর পর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসর আলবদর-আলশামস- রাজাকার ও বিহারীরা যারপরনাই বীভৎস ও নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিল এবং দু লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। তারপরও যাতে জনগণ নিজের হাতে আইন তুলে না নেন, সে জন্য সেদিনের সে বক্তৃতায় তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘প্রতিশোধ গ্রহণের পথ তোমাদের ত্যাগ করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণকে হত্যা, ধর্ষণ ও সম্পত্তি ধ্বংসের জন্য দায়ী ব্যক্তিবর্গ ও তাদের দালালদের উপযুক্ত শাস্তি সরকার নিশ্চয়ই দেবে। এ জন্যে জনগণ নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারে না। বঙ্গবন্ধু দেশে যাতে সুষ্ঠু আইনের প্রয়োগ হয় সে বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন। যারা বাংলার স্বাধীনতার কেবল বিরোধিতা করেনি বরং পাকিস্তানিদের দোসর ছিলেন, নির্মম ও নৃশংসভাবে মানুষের হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন, নারী নির্যাতনের মতো ভয়ানক কাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচার করতে ব্রতী ছিলেন।
১৬ জানুয়ারি ১৯৭২ ঢাকা শহরতলির বাস্তুহারাদের সমাবেশে তিনি বলেছিলেন যে, ‘আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার শপথ নিয়েছি। সোনার বাংলার সোনার মানুষদের নিয়ে ধৈর্য ধরে কাজ করে আমরা গড়ে তুলবো এই শোষণহীন সমাজ।’ বস্তুত মেহনতি মানুষকে সঠিকভাবে ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতির আওতায় এনে দেশ ও জাতি গঠনের মহতী লক্ষ্যে মুজিব সাহেব সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, যাতে করে দেশের সবার ঘরে ঘরে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। মানব কল্যাণের ব্রতী নিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের আপদে-বিপদে সঙ্গী হয়েছেন। জীবনের মায়া ত্যাগ করে তিনি জীবনমান উন্নয়নে সবার জন্য খাদ্য ব্যবস্থার আয়োজন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। খাদ্য নিরাপত্তার ব্যাপারেও তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। একজন আদর্শবান, মনেপ্রাণে বাঙালি তার সমস্ত নিষ্ঠা শক্তি দিয়ে মাতৃভূমির হিত সাধনে ব্যাপৃত ছিলেন। কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়া প্রয়োগ করেছেন।
২৪ জানুয়ারি ১৯৭২ টাঙ্গাইলের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের প্রতি হুঁশিয়ারি জানিয়ে আমি বলছি ঘুষ আর দুর্নীতি বাংলাদেশ থেকে মুছে যাক। মনে রাখবেন এটা পাকিস্তান সরকার নয়। আপনাদের চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদি দেখি কেউ খারাপ কাজ করছে সে নোটিশ পাবে ‘ইউর সার্ভিস ইজ নো লংগার রিকোয়ার্ড।’ বস্তুত বঙ্গবন্ধু একজন দক্ষ প্রশাসকের মতো সরকারি চাকরিজীবী এবং বেসরকারি আম-জনতার মধ্যে ব্যবধান দূর করতে সচেষ্ট ছিলেন। তার কর্মধারা ছিল প্রো পিপল। তিনি চেষ্টা করতেন মানব কল্যাণের।
৩০ জানুয়ারি ১৯৭২ ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিবাহিনীর সকল দলের অস্ত্র সমর্পণ উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন যে, ‘মুক্তি সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। স্বাধীনতার জন্য আপনারা বিরাট ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আপনারা সংগ্রাম করেছেন জালেমের বিরুদ্ধে।’ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার যথাযথ ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি চেষ্টা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য। তার কর্ম তাকে বীরের মর্যাদা দিয়েছে। দক্ষ শাসক হিসাবে রূপান্তর করেছে।
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরস্থায়ী সম্পর্কে ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের ভাষণে তিনি বলেন যে, ‘ভারতের মহান জনগণ, ভারত সরকার, ভারতের সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষ করে ভারতের মহান নেত্রী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতের অবিস্মরণীয় ভূমিকা ছিল। তাই অকুণ্ঠ চিত্তে তিনি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন। আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিও ধন্যবাদ জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সুদৃঢ় সমর্থন দেওয়ার জন্য আমি সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’
বঙ্গবন্ধু সব সময় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে মুক্ত থাকতে চেয়েছেন। তাই তো জোর গলায় বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র আমাদের দুই দেশের আদর্শ।’ মানুষ মানুষের জন্য, জীবনধারায় প্রতিটি মানুষ যেন সত্যিকারভাবে বেঁচে থাকার রসদ পায়। সে জন্য তিনি তাঁর সাড়ে তিন বছর শাসনকালে চেষ্টা করেছেন। তিনি ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য হ্রাসে চেষ্টা করেছেন। সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সচেষ্ট ছিলেন। জাতীয়করণকৃত শিল্প কল-কারখানার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর বেসরকারি খাতে শিল্প কল-কারখানা স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল মানব সম্পদের উন্নয়ন। দেশ ও জাতি গঠনে লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহারে তিনি সদা উন্মুখ ছিলেন।
একজন আদর্শ মানব হিসেবে বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি থাকার পাশাপাশি একটি স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলা ভাষার বিকাশে ভূমিকা পালনকারী বলে মোবাশ্বের আলী তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। মানুষ মানুষের জন্য- এ নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। তবে যারা দুর্নীতি করে, পরসম্পদ লুণ্ঠন করতো, ঘুষ খেত, ক্ষমতার অপব্যবহার করতো তাদের প্রতি তিনি কঠোর ছিলেন। বঙ্গবন্ধু অহিংসার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। আজ তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলেছে অদম্য গতিতে। মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু সকল বাঙালি তথা বাংলাদেশির আদর্শস্বরূপ।
লেখক: প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী, ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট ও আইটি এক্সপার্ট