সজল রোশন : মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যকার প্রার্থক্য বুঝার চেয়ে মূর্তি ও ভাবমূর্তির মধ্যকার প্রার্থক্য বুঝা বেশি জরুরি। বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি জলাঞ্জলি দিয়ে যারা এই দুর্যোগকালীন সময়ে তাঁর ভাস্কর্য বানানোকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন তারা যদি বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তির প্রতি একটু শ্রদ্ধাশীল হতে পারতেন তবে তা দেশ ও মানুষের জন্য কল্যাণকর হতো। আর যারা ইসলামের নামে মূর্তি ভাঙার আন্দোলন শুরু করেছেন তারাও যদি ইসলামের ধর্মের সত্যিকারের ভাবমূর্তির প্রতি একটু শ্রদ্ধাশীল হতে পারতেন তবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ উপকৃত হতো। সমাজ, রাষ্ট্র বা বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হলে সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যবস্থাকে বিবেচনায় নিতে হবে। ক্ষনিকের বাহবা পাওয়ার জন্য, সম্ভাব্যতা যাচাই না করে, যে সব আন্দোলন আমরা ইসলামের নামে করছি তা দুই দিন পরেই মুখ থুবড়ে পড়ে কারণ মানুষের কাছে এসবের বিশেষ কোন অর্থ নাই। এসব অর্থহীন দাবি বা আন্দোলনের কারণেই ইসলাম ধর্মের ভ্যালু প্রপোজিশন বা পজিশনিং নির্ণয় এবং নির্ধারণ করা খুব কঠিন। ম্যাকডোনাল্ড বললে আমরা সাশ্রয়ী ফাস্টফুড বুঝি, টয়োটা মানে রিলায়েবল গাড়ি, কোকাকোলা মানে সফট ড্রিংকস। কিন্তু ইসলাম ধর্মের ভ্যালু প্রপোজিশন কি ? ইসলাম ধর্ম বলতে আসলে কি বুঝায় ? একজন মানুষ একটা সমাজ, রাষ্ট্র বা পৃথিবী ইসলাম থেকে কিভাবে লাভবান হবে ? ইসলাম প্রতিষ্ঠা মানে পৃথিবীতে কি পরিবর্তন আনা ? মূর্তি/ ভাস্কর্য গুড়িয়ে দেয়ায় সমাজের মানুষের কি কল্যাণ আছে ? এই মহাদুর্যোগে,এই মানবিক বিপর্যয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি কি আর নাই ? ভাস্কর্যকে মূর্তি বা প্রতিমা ধরে নিয়েই বলছি, মানুষ মূর্তির পূজা করে তাই মূর্তি ভেঙে ফেলতে হবে ? মানুষ গাছেরও পূজা করে, তো সব গাছ কেটে ফেলতে হবে ? বিভিন্ন জীব-জন্তুরও পূজা করে। আগুন, পাহাড় বা পাথরের পূজাও করে, তাহলে ? নবীজি (সঃ) কাবার মূর্তি ভেঙ্গেছেন মক্কা বিজয়ের পর। কাবা তখন থেকে ইসলামের অবিসংবাদিত তীর্থ। সেখানে তো কোন অমুসলিম নাই। মূর্তি, ভাস্কর্য, ছবি সরিয়ে রাখার বিপক্ষে কারো অভিমত নাই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রেডিও পাকিস্তানের নাম রেডিও বাংলাদেশ হবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা আছে যারা মূর্তির পূজা করে, ভাস্কর্যকে ভক্তি করে; তা আমাদের দৃষ্টিতে শিরিক হলেও তাদের দৃষ্টিতে তো ইবাদত। মূর্তি আর ভাস্কর্যের মধ্যে কোন প্রার্থক্য নাই বলেই তো সে মূর্তি বা ভাস্কর্য ভাঙ্গার দাবি তোলা যাবে না। আমরা সে মূর্তি ভাঙ্গা তো দূরের কথা তাকে অশ্রদ্ধাও করতে পারি না। সে মূর্তি আরেকজনের দেবতা। আমাদের নবীর কার্টুন আঁকা যাবে না কিন্তু আরেকজনের দেবতা বা শ্রদ্ধার প্রতীককে গুড়িয়ে দেয়া যাবে ? সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দু বা খ্রিষ্টান দেশে মসজিদ থাকতে পারবে কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম দেশে মূর্তি থাকতে পারবে না ? মূর্তি, ভাস্কর্য, প্রতিমা, বা কোন প্রাণীর প্রতিকৃতি যে সারা দেশ বা দুনিয়া থেকে সরানো সম্ভব নয় তা আমরা সবাই বুঝি। তবুও সারা দেশ থেকে শিরক উচ্ছেদের যে অভিযান আমাদের শায়খুল হাদিসরা শুরু করেছেন তা যে “জুতা-আবিষ্কার” কবিতার চামড়া দিয়ে সারা পৃথিবী মুড়ে দেয়ার মত প্রকল্প তা কি তারা বুঝতে পারছেন ? সারা দুনিয়া চামড়ায় মুড়ে দেয়া সম্ভব নয়, তার চেয়ে নিজের পায়ে জুতা পরাই সহজ এবং একমাত্র সমাধান। মূর্তি আর ছবির মধ্যে প্রার্থক্য কি ? শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন প্রার্থক্য নাই। একজন প্রখ্যাত শায়খুল হাদিস ফতোয়া দিয়েছেন যে ডিজিটাল ছবি বা ভিডিও জায়েজ কারণ তা সত্যিকারের ছবি নয়, তা মূলত কতগুলো আলোর কণা, এই যুক্তিতে তো প্রিন্টেড ছবিও একটা রং করা কাগজ এবং মূর্তিও একটা পাথরের টুকরা! মূর্তি পূজা কেন শিরক ? একটা প্রাণহীন পাথরের মূর্তি কেন সর্বশক্তিমান স্রষ্টার প্রতিপক্ষ ? কারণ কারো মূর্তির পূজা মানে তার ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পন করা। আমরা একমাত্র আল্লাহর উপাসনা করি মানে একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পন করি। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি আল্লাহর হুকুম মানি ? নাকি আমাদের পীর, আমীর, শায়খুল হাদিসদের হুকুম মানি ? আল্লাহর নির্দেশের বিপরীতে পীর, শায়খদের নিঃশর্ত অনুসরণ, অন্ধ অর্চনাও মূর্তি পূজার মতোই শিরক। বিশেষ করে যারা বাস্তবতা বিবর্জিত এবং উদ্দেশ্যহীন আন্দোলনের নামে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে রাখে। ইসলাম ধর্মের মূলনীতি এতই অবিসংবাদিত যে তা সবাই সানন্দে, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই গ্রহণ করবে কিন্তু আমরা সেসব মূলনীতি নিয়ে কথা বলি না কারণ সবাই বিনা বিতর্কে ইসলামকে গ্রহণ করলে আমাদের আন্দোলনের ইস্যু কি হবে ? বিতর্ক প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তু হতে হবে এমন যা নিয়ে দিনভর বিতর্ক করা যাবে। আমাদের এমন একটা ইস্যু লাগবে যার আসলেই আগা মাথা নাই তাহলেই মানুষ এর আগা মাথা খুঁজে পাবে না। দুইদিন পর আমরা এমনই আগা মাথা বিহীন নতুন ইস্যু নিয়ে হাজির হবো। কেউ “ইনশাআল্লাহ” না লিখে যাবেন না।
লেখক: সজল রোশন, নিউ ইয়র্ক