সম্পাদকীয় : দেশে অনিয়ম অন্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধর্ষণের মত জঘন্য ঘটনা। ধর্ষণ ‘কামুক’ মানবসন্তানের সৃষ্ট এক চূড়ান্ত পৈচাশিকতার নাম যা বর্তমানে ব্যপকহারে বেড়েছে।
বাংলাদেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ-আন্দোলনের মুখে এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধনী এনে অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা ইতোমধ্যে কার্যকর করা সত্ত্বেও নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।
গত বছরের আলোচিত ঘটনা নুসরাত হত্যার পর প্রত্যাশা ছিল ধর্ষণ শব্দটি এ সমাজ থেকে মুছে যাবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষক এহেন অপরাধ করে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। যা গাজীপুরের এক ঘটনায় জানা যায়। আবার চট্টগ্রামে রাস্তায় স্বামীকে আটকে স্ত্রীকে গণধর্ষণের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় স্তম্ভিত হয় সমাজ। এছাড়াও পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কোন্দলের জের ধরে ধর্ষণের খবর প্রকাশ হয় গণমাধ্যমে, যা থেকে বোঝা যায় শুধুমাত্র আইন দিয়ে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ২০১৯ সালে গণপরিবহনে ৫২টি ঘটনায় ৫৯ জন নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়ক পথে ৪৪টি, রেলপথে ৪টি ও নৌপথে ৪টি যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৬ টি ধর্ষণ, ১২টি গণধর্ষণ, ৯টি ধর্ষণের চেষ্টা ও ১৫টি যৌন হয়রানির ঘটনা রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুসারে এসব ঘটনায় ৪৪টি মামলা দায়ের করা হয় যার পরিপ্রেক্ষিতে ৯৩ আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০১৭ সালে গণপরিবহনে চাঞ্চল্যকর রূপা গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় দেশবাসী ফুঁসে উঠলে জনগণের তীব্র প্রতিবাদের কারণে স্বল্পতম সময়ে এই ঘটনার বিচার সম্পন্ন হয়। এই ঘটনায় ৪ পরিবহন শ্রমিককে ফাঁসি ও ১ জনকে সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। এর ফলে ওই সময়ে এই ধরনের ঘটনা কিছুটা কমলেও বর্তমানে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
এ অবস্থায় যে প্রশ্নটি বারবার উঠে আসছে তা হলো, সমাজে ধর্ষণের ঘটনা কেন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না ? প্রকৃতপক্ষে এর অন্তরালের কারণ বহুবিধ। আইনেও রয়েছে অনেক সমস্যা। সেগুলো চিহ্নিত না করে শুধু মৃত্যুদণ্ডের বিধান এনে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে না। তাছাড়া বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ধর্ষণের মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে। আবার ধর্ষণের সব ঘটনা প্রকাশ হয় না বা বিচারের আওতায় আসে না লোকলজ্জার ভয়ে। আবার ইদানীংকালে তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহারের হুমকি দিয়ে দমন করে নির্যাতিত নারী ও তার পরিবারকে। একই সাথে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবশালীদের দাপটে প্রশ্রয় পায় অপরাধীরা। বিশ্বে ৩৫ শতাংশ নারীই জীবনের কোন না কোন সময়ে যৌন হয়রানি, শারীরিক লাঞ্ছনা, শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৪০ শতাংশের কম নারীই আইনের দ্বারস্থ হয়েছেন। আর বিচার পেয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশ ভুক্তভোগী।
প্রকৃতপক্ষে যৌন হয়রানি আর ধর্ষণ এখন সমাজের এমন এক ব্যাধি, যা নারীদের জীবনকে নরকময় করে তুলেছে বিকৃত রুচির কিছু মানুষ। যার ফলে বর্তমানে নারীরা স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েও আতংকগ্রস্থ হচ্ছে নিরাপত্তার নিশ্চিয়তা নেই বলে। সুতরাং এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আইনের পাশাপাশি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও সচেতনতা জরুরি।
সচেতনতা নেই বলে ধর্ষণের সাজার কঠোরতা জানা থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত নারী ধর্ষিত হচ্ছে। এ ঘৃণ্য অপরাধের সাজা মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পরেও থামছে না অন্যায় কাজটি। তার কারণ আইনী জটিলতাতে বিচার প্রলম্বিত হয়। আর এতে ধর্ষক মনে করে তার অন্যায় থেকে বাঁচার পথ আছে। তা ছাড়া বিচারকে ব্যাহত করতে পারিবারিক সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব বা চাপ অনেক ক্ষেত্রে কাজ করে। এতে করে সমাজে ধর্ষণ নামের ব্যাধিটি যে বিষ ছড়াচ্ছে তা থেকে রেহাই পাচ্ছে না ৩/৪ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৬৫/৭০ বছরের নারীও। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য মতে- চলতি বছরের আগস্টে ৭২টি ধর্ষণের ঘটনায় ৪৯টিই কন্যাশিশু। ৩২টি গণধর্ষণের ঘটনায় শিশু ১৪টি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৯৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন। এছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৩ জন এবং ১২ জন আত্মহত্যা করেছেন। একইসঙ্গে এই আট মাসে ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৯২ জন নারী এবং ৯ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৩ জন নারী ও ৯ জন পুরুষ। বাংলাদেশ পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে- গত বছরে বাংলাদেশে ৫ হাজার ৪০০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তাই এ ব্যাধিকে প্রতিরোধ করতে হলে সচেতনতার বিকল্প কোন পথ নেই।
সে সাথে বিশেষ আরেকটি কারণ হলো, মানুষের নৈতিক অবক্ষয়। কু-রিপুকে সংযত করার চর্চা কমছে। ধর্মের অনুশাসন, বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করার ফলে মানুষ বিপথে পরিচালিত হতে সাহস পায়। বলা হয়, আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ বিচরণ মানুষকে নষ্ট করছে। এটা একটা দুর্বল যুক্তি। কারণ ভালো মন্দ বোঝার বিবেকবোধ মানুষের আছে। আর সে বোধকে যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় তবে ধর্ষণের মত ব্যাভিচার কাজ করা সম্ভব নয়। বিশ্বজুড়ে পুরুষেরাও প্রতিদিন যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন এবং ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের তুলনায় ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সের কিশোরীরা ৪ গুণ বা তার বেশি পরিমাণে ধর্ষণের শিকার হন। কলেজছাত্রীরা (১৮ থেকে ২৪ বছর বয়স) যৌন নিপীড়নের শিকার হন ৩ গুণ পরিমাণে। হিজড়া সম্প্রদায়ের ব্যক্তি এবং প্রতিবন্ধীদের যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান ২ গুণ । খোদ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭০ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনা ভুক্তভোগীর পরিচিতদের দ্বারাই সংগঠিত হয়।বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে প্রায় ১০ জন ধর্ষণের শিকার হন।
নারী-পুরুষ উভয়ের শালীনতা বোধ থাকা খুব জরুরি। শারীরিক চাহিদা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্ত সে চাহিদা মেটানোর জন্য ধর্ষণের মত বর্বরোচিত কাজ বন্য পশুকেও হার মানায়।
এ সূক্ষ্ম বোধগুলো জাগ্রত করতে হলে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে৷ আসলে নারীকে এখনো ভোগ্যপণ্য হিসাবে একটি দেহ হিসাবে চিন্তা করার মানসিকতা বদলাতে পারিনি এ সমাজ।
তাই ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে সাময়িকভাবে সোচ্চার হয়ে থেমে গেলে চলবে না। ধর্ষণের প্রতিরোধ করতে সবাইকে সচেতন হতে হবে যার যার অবস্থান থেকে। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের মুখ্য দায়িত্ব হলো সচেতনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে মানুষের নৈতিক চিন্তার পরিবর্তন করা। তা না হলে কেবল আইন দিয়ে ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধকে দমন করা সম্ভব হবে না। বরং প্রলম্বিত বিচার ব্যবস্থা ও ক্ষমতার ছত্রছায়ায় আইনের অপব্যবহারে ধর্ষকদের দৌরাত্ম্য বাড়বে।