অনলাইন ডেস্ক : দেশের বেসরকারি ৭টি ব্যাংকের ক্রেডিট রেটিং পর্যালোচনা করার তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক একটি ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিস। তারা ইঙ্গিত দিয়েছে, একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে দীর্ঘমেয়াদী বাংলাদেশের ঋণমান বা ক্রেডিট রেটিং পুনর্মূল্যায়ন করতে এসব ব্যাংকের রেটিং পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই সংস্থাটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও দেশের ক্রেডিট পরিস্থিতি যাচাই করে থাকে।
ক্রেডিট রেটিং কী?
কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সঙ্গে আর্থিক সক্ষমতা বা ঋণ দেয়া হলে সেটা ঠিক সময়ে পরিশোধ করার ক্ষমতা কতটা আছে, সেটাই ক্রেডিট রেটিংয়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলছেন, ‘’সামগ্রিকভাবে এটা দেখায় যে, একটা দেশের, কোন প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির সক্ষমতা কতটা আছে। যেমন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কোন দেশ যদি ঋণ নিতে চায়, তখন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এই রেটিংয়ের ভিত্তিতে বুঝতে পারে যে, দেশটি সময় মতো ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কতটা আছে।‘’
ক্রেডিট রেটিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সক্ষমতা, অতীত ইতিহাসের ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়। সেই রেটিং থেকে ক্রেতারা বা ঋণদাতা অথবা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বুঝতে পারে, তাদের সঙ্গে লেনদেন করা কতটা নিরাপদ। তারা ঋণ পরিশোধে কতটা সক্ষম। ওই দেশ বা প্রতিষ্ঠানকে কতটা ঋণ দেয়া নিরাপদ হবে।
কোন রেটিংয়ের কী মানে?
বিভিন্ন ক্যাটেগরির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাগ করা হয়ে থাকে। এটা একপ্রকার মার্কিং সিস্টেম। যেমন ‘এএএ’, ‘’বিএ’, ‘সি’ ইত্যাদি। প্রতিষ্ঠানের মূলধন, আমানত, দেশি ও বৈদেশিক বিনিয়োগের খাত, ঋণের খাত, ঋণ পরিশোধের হার ইত্যাদি সূচক বিবেচনায় নিয়ে এটি নির্ধারণ করা হয়।
‘এএএ’ মানে হচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক রেকর্ড খুব ভালো এবং ঋণ ফেরত দেওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ‘বিএ’ মানে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের কিছু ঝুঁকি রয়েছে। অন্যদিকে রেটিং ‘সি’ মানে হচ্ছে সেখানে আসল ও মুনাফা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
কেন ক্রেডিট রেটিং করা হয়?
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের ভেতরে ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন করতে হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন করা কতটা নিরাপদ, এই ক্রেডিট রেটিং দিয়ে সেটা নিরূপণ করা হয়ে থাকে।
আর্থিক গবেষণা সংস্থা ইন্সটিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুজেরি বলছেন, ‘’সাধারণত এই রেটিং এজেন্সিগুলোর আন্তর্জাতিক একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। কাজেই তারা যে রেটিংটা দেয়, সেটা ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বা সংস্থাগুলো সেটার ভিত্তিতে শর্তাবলী এবং সুদের হার নির্ধারণ করে। কাজেই রেটিং ভালো হলে যেমন সহজ শর্তে, কম সুদে ঋণ পাওয়া যায়। আবার রেটিং খারাপ হলে ঋণদাতারা সেটি ঝুঁকি হিসাবে দেখে। তখন তারা কড়া শর্ত এবং বেশি সুদ আরোপ করে।‘’
এ কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময়েই চায় যাতে, তাদের ক্রেডিট রেটিং ভালো হয়। অনেক দেশে সাধারণ গ্রাহকদের আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে ক্রেডিট রেটিং করা হয়ে থাকে। সেই রেটিংয়ের ভিত্তিতে তাদের নির্ধারণ করা হয় যে, তারা ঋণ
পাবেন কিনা? কতটা ঋণ পাবেন?
আবার বিনিয়োগের পূর্বে বা শেয়ার কেনার আগে বিনিয়োগকারীরা ক্রেডিট রেটিং দেখে ওই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সক্ষমতা বুঝতে পারেন। এ থেকে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে, তাদের বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ, কত তাড়াতাড়ি উঠে আসবে এবং কেমন মুনাফা পেতে পারেন।
কীভাবে ক্রেডিট রেটিং করা হয়ে থাকে?
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আর্থিক খাতের একাধিক সূচক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্রেডিট রেটিং করা হয়ে থাকে। ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলছেন, ‘’যেমন দেখা হয় যে ওই ব্যাংকের আমানত কেমন আছে, সেটা কোন খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে? সেখান থেকে তারা রিটার্ন কেমন পাচ্ছে?’’
‘’গ্রাহক ফেরত চাইলে কত তাড়াতাড়ি তাদের সেই আমানত ফেরত দেয়ার সক্ষমতা আছে? বলা যেতে পারে তাদের সামগ্রিক সক্ষমতা যাচাই করা হয়।’’
‘’কোন খাতে তাদের ঋণ বেশি দেয়া হয়েছে এবং সেখানে ঝুঁকি কেমন আছে? আন্তর্জাতিক কোন ব্যাংকের দায়-দেনা মেটাতে তাদের সক্ষমতা কেমন আছে? প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ কতটা সুদৃঢ় ইত্যাদি। ‘’
একেকটি প্রতিষ্ঠান একেক রকম সূচক বিবেচনায় নিয়ে কাজ করে বলে রেটিংয়ে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। তবে মুজেরি বলছেন, সাধারণত আন্তর্জাতিক সংস্থার ক্রেডিট রেটিংয়ে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখা যায় না।
ক্রেডিট রেটিং কারা করে?
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট রেটিং করে থাকে। তাদের মধ্যে অন্যতম এই মোডি’স।
বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবেও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট রেটিং সনদ দিয়ে দিয়েছে।
সাধারণত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে, অনেক সময় নির্দিষ্ট ফিয়ের বিনিময়ে তারা রেটিং করে থাকে।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলছেন, ‘’ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চায় যে, তাদের ক্রেডিট রেটিং ভালো হোক। কারণ এর ভিত্তিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ পাওয়া, এলসি খোলা ইত্যাদিকে ভূমিকা রাখে।‘’
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি দেশীয় ব্যাংকের এলসি গ্রহণ করতে সম্মত হয়নি কিছু ব্যাংক। এর পেছনে এই রেটিং কমে যাওয়ার ভূমিকা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
আবার ব্যক্তি পর্যায়ের গ্রাহকদের লেনদেন বা আর্থিক রেকর্ড কেমন, সেটা যাচাই করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো’ নামে একটি দপ্তর আছে। যখন কেউ ঋণ নিয়ে থাকে, সেটা ঠিকভাবে পরিশোধ করেছেন কিনা, ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনে বকেয়া রয়েছে কিনা, খেলাপি হয়েছেন কিনা, ব্যুরোর প্রতিবেদন থেকে জানতে পারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এর ভিত্তিতে তারা ঋণ দেয়া না দেয়া, কতটা ঋণ মঞ্জুর করা হবে ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
দেশের ক্রেডিট রেটিং কীভাবে করা হয়?
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যখন কোন দেশের ক্রেডিট রেটিং করা হয়, তখন দেখা হয় যে, তার সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন রয়েছে?
সেখানে বিনিয়োগের অবস্থা, স্টক এক্সচেঞ্জ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিষয়ও বিবেচনায় রাখা হয়। বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণ, বাণিজ্যিক লেনদেন পরিশোধের সক্ষমতা কতটা আছে, সেটা দেখা হয়।
ক্রেডিট রেটিং যদি ভালো হয়, তখন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ বা আর্থিক সহায়তা পেতে হলে সহজ শর্তে তা পেতে পারে। বিনিয়োগকারীরা সেসব দেশে বিনিয়োগে উৎসাহী হন।
কিন্তু রেটিং ভালো না হলে সেটা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় রেটিং খারাপ হলে বাণিজ্যিকভাবে অন্য দেশের ব্যবসায়িক পরিস্থিতি সেই দেশের ব্যবসায়ী বা ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতে দ্বিধায় ভোগে।
সূত্র-বিবিসি।