সময়ের প্রয়োজনে এবং মানুষের অধিকার সচেতনতার ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ‘কপিরাইট’ ধারণার উদ্ভব হয়েছে। কপিরাইট রক্ষায় সৃষ্টিশীল মানুষের আর্থিক ও নৈতিক অধিকার প্রাপ্তির মিলিত দাবির ফলে ১৮৮৩ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কনভেনশনে পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন প্রভৃতি সৃষ্টিকারীদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশও এ কনভেনশনে সই করেছে।
বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জিআই পণ্য সুরক্ষার নিবন্ধন ঐচ্ছিক হলেও এতে বিশেষ সুবিধা আছে। এতে মালিকানাস্বত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। শিল্প-কলকারখানায় উৎপাদিত প্রতিটি পণ্যের ব্র্যান্ড বা নিজস্ব নাম আছে। ওই নামে তা বাজারে পরিচিতি পায়। জিআই পণ্যগুলোর উপযুক্ত কোনো ব্র্যান্ডিং বা ট্যাগ ছিল না। এ কারণে ক্রেতাদের পক্ষে তা শনাক্ত করে কিনতে অসুবিধা হয়ে থাকে।অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা ওই পণ্যের নামে অন্য পণ্য বিক্রি করে। এতে ক্রেতারা প্রতারিত হন, ক্ষতিগ্রস্ত হন মূল বিক্রেতা।
জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পাওয়া আমাদের জামদানি ও ইলিশ প্রতিযোগিতামলূক বিশ্ববাজারে অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে। এসব অর্জন ও স্বীকৃতিকে অর্থনীতির উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশে উৎপাদিত অন্য ফল, যেমন আমকেও জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করা যেতে পারে। যথাযথভাবে জিআই পণ্য ব্র্যান্ডিং করতে পারলে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়তি দাম দিতে আগ্রহী সারাবিশ্বের ক্রেতারা। জিআই নির্দেশক পণ্য নিবন্ধন হলে দেশে পর্যটকও বাড়বে। সংশ্লিষ্ট এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়ন হবে।
আমাদের দেশে মেধাস্বত্ব সুরক্ষায় আইন থাকলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর নয় বলেই প্রতীয়মান। পাইরেসির মাধ্যমে মূল পণ্যের নকল প্রবণতার আধিক্যে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন এর স্বত্বাধিকারী। কোনো একটি বিশেষ ধারণার প্রকাশ বা তথ্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণকারী বিশেষ কিছু অধিকারের সমষ্টিই হলো মেধাস্বত্ব। এটি একটি আইনি ধারণা। আমাদের সে আইনটি বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়।
মানুষের চিন্তা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে উদ্ভাবিত মেধাসম্পদ দু’ভাগে বিভক্ত। ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোপার্টি (পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন); অন্যটি কপিরাইট (সাহিত্য ও শৈল্পিক কাজের পরিমণ্ডল)। এ সৃষ্টিশীল কর্মের যিনি সৃষ্টিকারী তাঁর অনুমতি ব্যতীত এটির পুনরুৎপাদন, বাণিজ্যিক বা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার স্রষ্টার অধিকার হরণেরই নামান্তর।
একটি দেশের অর্থনীতিতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে সেদেশের সংরক্ষিত মেধাস্বত্ব। আর এই মেধাস্বত্বকে শক্তিশালী করতে প্রয়োজন সময়োপযোগী নীতিমালা, আইনী কাঠামো এবং এর যথাযথ প্রয়োগ। আর এই আইনের সঠিক প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে “ইন্টালেকচ্যুয়াল প্রোপার্টি এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ” (আইপিএবি) এবং “ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ” (আইসিএসবি)। প্রতিষ্ঠান দু’টি এ বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরে আয়োজন করছে সিপিডিসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠান। সেখানে মেধাস্বত্ব আইনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বিজ্ঞ বক্তারা বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করছেন, দিচ্ছেন নানা পরামর্শ।
জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে সৃজনশীল মেধাসম্পদ সুরক্ষা ও এর পৃষ্ঠপোষকতার বিকল্প নেই। জাতীয় শিল্পনীতিতে নতুন উদ্ভাবন ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের সুরক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এর আলোকে মেধাসম্পদ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংশ্লিষ্ট আইন যুগোপযোগী করাও অনস্বীকার্য। বর্তমানে আমাদের দেশের মেধাস্বত্ব আইন প্রয়োগের যথার্থতা নিয়ে আইপিএবি ও আইসিএসবি’র ভূমিকা নি:সন্দেহে প্রসংশার দাবিদার।
আরো পড়ুন: