কাজী ওসমান আলী সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে তিনি এ ব্যাংকের শীর্ষ দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি এসআইবিএলের সার্বিক কার্যক্রম ও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নানা দিক নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেছেন ৩৪ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এ ব্যাংকার।
প্রশ্ন: একজন অভিজ্ঞ ব্যাংকার হিসেবে নিজের নেতৃত্বের কৌশলকে কীভাবে তুলে ধরবেন?
ওসমান আলী: আমি মাঠ পর্যায় থেকে পেশাজীবন শুরু করে আজকের অবস্থানে এসেছি। একটি প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে এর শীর্ষ নেতৃত্ব। আমি কাজে বিশ্বাসী। আর সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি না। তবে সব পর্যায়ের কর্মকর্তার বাস্তব অভিজ্ঞতাকে মূল্য দিয়ে দলগত মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। তাছাড়া আমি মনে করি, ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি শক্ত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদকে উৎসাহিত করার বিকল্প নেই। ব্যাংকের মানবসম্পদ উন্নয়নে আমার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রশ্ন: আমানত ও ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার নির্দেশকে ঘিরে ব্যাংক খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে এসআইবিএল কী ধরনের কৌশল নিয়েছে? এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আপনার মতামত কী?
ওসমান আলী: বিনিয়োগ মুনাফার হার কমানোর উদ্যোগকে সর্বপ্রথম আমরাই স্বাগত জানাই। আমরাই প্রথম সরকারের উদ্যোগে সাড়া দিয়েছি। এক অঙ্কের বিনিয়োগ বিষয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ মানুষকে জানিয়েছি। এ বছরের ১ জুলাই থেকেই আমাদের বিনিয়োগের মুনাফার হার ৯ শতাংশ কার্যকর করেছি। বেসরকারি খাতের ব্যাংক মালিকরা গত ২০ জুলাই ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে তারা আমানতের সুদ-মুনাফার হার নির্ধারণ করে ৬ শতাংশ। তবে এসআইবিএল তার আগেই এমন সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাস্তবায়ন করে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের সংকট ও সম্ভাবনার জায়গা কোনগুলো বলে মনে করেন?
ওসমান আলী: দিন দিন শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ব্যবসা এদেশে আশানুরূপভাবে বেড়ে চলেছে। সাধারণ মানুষ ইসলামী ব্যাংকিংয়ে আকৃষ্ট হচ্ছে। তারপরও আমি বলব, ইসলামী ব্যাংকিং পরিপূর্ণতা লাভ করে মুদারাবা-মুশারাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে। প্রকৃত ও সৎ উদ্যোক্তারা এর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রকৃত স্বাদ পেতে পারেন। কিন্তু ব্যবসায়িক সংস্কৃতি ও পরিবেশ বিবেচনায় আমাদের পক্ষে এর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটানো সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এ মুহূর্তে সরকারের উচিত হবে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে সার্বিক সহায়তা দেওয়া। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা, বিনিয়োগ ও আইনগত প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা জরুরি। ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে প্রতিবন্ধকতা পর্যায়ক্রমে আমরা অনেকটাই অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসলামী ব্যাংকিং যেভাবে বিকশিত হয়েছে অন্য কোনো দেশে ততটা হয়নি। সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য।
প্রশ্ন: এসআইবিএলের সাম্প্রতিক আর্থিক পারফরম্যান্স সম্পর্কে যদি কিছু বলেন!
ওসমান আলী: বিগত বছরগুলোয় আমাদের ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল ছিল। বর্তমানে আমরা আমানত, বিনিয়োগ, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, প্রবাসী আয় এবং পরিচালন মুনাফাসহ সব সূচকে প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরিকল্পিত কৌশল নিয়ে এগোচ্ছি। দ্বিতীয় প্রজন্মের ইসলামী ব্যাংক হিসেবে এসআইবিএল ১৯৯৫ সালে পাঁচটি শাখা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে এর শাখার সংখ্যা ১৪৯টি। পাশাপাশি প্রত্যন্ত এলাকায় কাজ করছে ৮০টি এজেন্ট ব্যাংকিং ইউনিট। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আশা করি, এ ব্যাংক দেশের অন্যতম প্রধান ইসলামী ব্যাংকের মর্যাদায় উন্নীত হবে।
প্রশ্ন: ইসলামী ব্যাংকগুলোর মধ্যে এসআইবিএল প্রযুক্তিতে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। কীভাবে?
ওসমান আলী: ব্যাংকটি ব্যাংকিং কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং গুণগত মানের গ্রাহকসেবা দিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মধ্যে এগিয়ে রয়েছে। এসআইবিএল দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম অনলাইন ব্যাংকিং সেবা চালু করে। ব্যাংকের সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় একটি সমন্বিত কেন্দ্রীয় কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে। ১৪৯টি শাখাই কোর ব্যাংকিং সলিউশন ব্যবহার করছে। এতে গ্রাহকরা সবসময় যে কোনো শাখায় রিয়েল টাইম অনলাইন ব্যাংকিংয়ের সব সুবিধা পায়। আমরা ইতোমধ্যে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের আওতায় বেশ কিছু সেবা সংযোজন করতে সক্ষম হয়েছি। বর্তমানে আধুনিক ব্যাংকিং সেবা যেমন ২৪ ঘণ্টা এটিএম সার্ভিস, ভিসা ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, এসএমএস ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার, সেন্ট্রাল ক্লিয়ারিং সুবিধা, সেন্ট্রালাইজড রেমিট্যান্স প্রসেসিং, সেন্ট্রালাইজড ট্রেড প্রসেসিং, অফশোর ব্যাংকিং, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফাইন্যান্সিংসহ অন্যান্য সেবার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। আমাদের মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে গ্রাহকরা মোবাইল টপ আপ এবং ফান্ড ট্রান্সফার করতে পারছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতে পারছে। এছাড়া আরও অনেক ই-কমার্স/ওয়েবভিত্তিক প্রডাক্টের প্রচলন প্রক্রিয়াধীন।
প্রশ্ন: আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে আপনারা কতটা অগ্রসর?
ওসমান আলী: আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সব পর্যায়ে আমাদের ব্যাংকের অংশগ্রহণকে বিস্তৃত করছি। সারাদেশে এর শাখা বিস্তৃত হয়েছে। এতে করে গ্রাহকসংখ্যাও বাড়ছে আনুপাতিক হারে। আমাদের পরিকল্পনায় রয়েছে যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাদের ব্যাংকের শাখা খোলা সম্ভব হচ্ছে না, সেসব জায়গায় এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করার।
এসআইবিএল শুরু থেকেই সামাজিক অঙ্গীকার ও দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মসূচি বাস্তবায়নে নারী ও পারিবারিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা চালু করেছি ‘ফ্যামিলি এমপাওয়ারমেন্ট ইসলামিক মাইক্রো-ফাইন্যান্স প্রোগ্রাম’। ক্ষুদ্র বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছি।
প্রশ্ন: ২০১৮-১৯ সালে এসআইবিএলের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা কী?
ওসমান আলী: সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে বেশ কিছু কর্ম-পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। যার মধ্যে রয়েছে স্থায়ী আমানত বাড়ানো, বৈদেশিক লেনদেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে রফতানি ও রেমিট্যান্স আহরণ বাড়ানো, সিএসআর খাতে ব্যয় বাড়ানো, মোবাইল ব্যাংকিং চালু ইত্যাদি। ব্যাংকের সেবার মান ইতোমধ্যে উন্নত করা হয়েছে। প্রডাক্টেও আনা হয়েছে বৈচিত্র্য ও উৎকর্ষ। আমাদের দেশের ব্যাংকিংসেবা মূলত শহরকেন্দ্রিক। আমরা গ্রামীণ জনগণকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। এছাড়া নারী সমাজকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা আমাদের পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ ব্যাংকে নারী উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। প্রবাসী বাঙালিদের আর্থিক সেবার আওতায় আনার ব্যাপারে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি, যা ভবিষ্যতে আরও জোরদার করা হবে। সৌজন্যে: শেয়ার বিজ