October 8, 2024 - 5:38 am
তথ‌্য অ‌ধিদপ্ত‌রের নিবন্ধন নম্বরঃ ৭৭
Homeআইন-আদালতমৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী মোহাম্মদ আলী গ্রেফতার

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী মোহাম্মদ আলী গ্রেফতার

spot_img

নিজস্ব প্রতিবেদক : একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এবং দীর্ঘদিন যাবৎ পলাতক যুদ্ধাপরাধী আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলীকে (৭০) গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৩)।

শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ এর একটি আভিযানিক দল রাজধানীর ডেমরা এলাকা হতে আসামি আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৩–এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ এ তথ্য জানান।

জানা যায়, ধৃত আসামির বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ আনা হয়। ধৃত আসামি আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী ১৯৭১ সালে গঠিত ইসলামী ছাত্র সংঘের একজন অন্যতম সংগঠক এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানা জামায়াত ইসলামীর সক্রিয় সদস্য ছিল। এছাড়াও সে শান্তি কমিটির সক্রিয় সদস্য হিসেবে অত্র এলাকায় লুটপাট ও বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রম চালাত। এছাড়াও ১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে শান্তি কমিটির গাইবান্ধা জেলাপ্রধান মওলানা মমতাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে ধৃত আসামিসহ আরো অনেকে মিলে অত্র এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড চালাত।

১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর পূর্ব শত্রুতার জের ধরে শান্তি কমিটির দুর্ধর্ষ ডাকাত মোঃ আব্দুর রহিম মিয়া এবং ধৃত আসামী আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে আবু সালেহ, আব্দুল লতিফ, রুহুল আমিন, নাজমুলসহ আরও কয়েকজন কুখ্যাত রাজাকার এবং পাকিস্তানি আর্মিদের একটি দল নিয়ে সকাল ০৮৩০ ঘটিকায় মালিবাড়ি গ্রামের গণেষ চন্দ্র বর্মনের বাড়িতে হামলা করে লুটপাট এবং বাড়ির সদস্যদের উপর নির্মম নির্যাতন চালায়। একপর্যায়ে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এরপর গণেষ চন্দ্র বর্মনকে উঠিয়ে নেয়ার জন্য উদ্ধত হলে তার স্ত্রী, পুত্র, বন্ধু আকবর আলী এবং প্রতিবেশি মোহাম্মদ আলী ও মনসুর আলী এগিয়ে এলে তাদের সকলকে ধৃত আসামী এবং তার সহযোগীরা তাদের বেধড়ক মারপিট করে এবং একপর্যায়ে তাদেরকে আটক করে নিকটবর্তী দরিয়াপুর ব্রিজে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গণেষ চন্দ্র বর্মনকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে মুখমন্ডল ও সারাশরীরে নৃশংসভাবে আঘাত করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর তার মুখমন্ডল বিকৃত করে দেয় এবং মৃতদেহের সাথে ইট ও পাথর বেঁধে এমনভাবে নদীতে ডুবিয়ে দেয় যাতে করে লাশটি ভেসে ওঠতে না পারে।

আটককৃত আকবর আলী, মোহাম্মদ আলী এবং মনসুর আলীকে তারা কামারজানি আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে মারধর করে এবং নির্যাতন করে। আকবর আলীকে তারা উপস্থিত অপর দুই ব্যক্তির সামনে বৈদ্যুতিক শক এবং নির্যাতনের মাধ্যমে ক্যাম্পেই হত্যা করে। পরের দিন বিকালে অপর দুই ব্যক্তি মনসুর আলী এবং মোহাম্মদ আলীকে তারা ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেয়ার পর এরা কোন রকম পালিয়ে জীবন বাঁচায়।

উক্ত ঘটনায় কামারজানি আর্মি ক্যাম্পে হত্যাকান্ডের শিকার আকবর আলীর পুত্র আনিছুর রহমান বাদী হয়ে ২০১৩ সালে গাইবান্দা অধস্তন আদালতে ধৃত আসামী আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী, আব্দুর রহিম, আবু সালেহ, আব্দুল লতিফ, রুহুল আমিন, নাজমুল হুদাকে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করে। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে স্থানান্তর করা হয়। বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালীন সে কখনোই আদালতে হাজির হয়নি। মামলা রুজুর পর ২০১৩ সাল থেকেই সে নিজ এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যায়। এরপর গভীর তদন্তে আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত প্রতিটি অভিযোগ প্রসিকিউশনের মাধ্যমে প্রমানিত হলে ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কর্তৃক আসামির বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় প্রদান করা হয়। এই মামলার অভিযুক্ত অপর ৫ জন আসামীর মধ্যে বর্তমানে ১ জন জর্ডানে অবস্থানরত, ১ জন কারাগারে, ২ জন পলাতক রয়েছে এবং ১ জন আসামী পলাতক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।

ধৃত আসামী আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী ১৯৭১ সাল থেকেই ইসলামী ছাত্র সংঘ, জামায়াতে ইসলামী এবং যুদ্ধের সময় সংগঠিত শান্তি কমিটির রাজাকার বাহিনীর সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ধৃত আসামী মুসলিম এবং তার রাজাকার দলটি শান্তি কমিটি এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে যোগসাজসে অত্র এলাকার বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও নাশকতামূলক কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী কার্যক্রম চালায়। তদন্তে প্রাপ্ত স্বাক্ষীদের সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য অনুযায়ী গাইবান্ধা সদর থানায় তাদের নৃশংসতায় প্রাণ হারায় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়াও তাদের অত্যাচারে অত্র এলাকার অধিকাংশ বাড়িতে লুটপাট ও ব্যাপক নির্যাতন চলে।

মামলা রুজুর পর ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ধৃত আসামী সুন্দরগঞ্জ থানায় তার এক আত্মীয়র বাড়িতে আত্মগোপনে ছিল। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে চলমান মামলায় সে জামিনের আবেদন করলে বিজ্ঞ আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে। অতপর ট্রাইবুন্যাল কর্তৃক গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হলে ২০১৬ সালে সে পূর্বস্থল থেকে পালিয়ে গাইবান্ধা তিস্তা নদীর তীরে অবস্থিত বেলকার চর নামক নির্জন একটি চরে গিয়ে আত্মগোপনে থাকে। তখন সে দিনমজুরির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। পরবর্তীতে ২০২১ সালে ঢাকায় পালিয়ে এসে সাভার আশুলিয়া এলাকায় একটি ভাড়ার বাসায় বসবাস শুরু করে। এখানেও প্রথমে দিনমজুরি এবং পরে গৃহ শিক্ষকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। আত্মগোপনে থাকাকালীন সে ব্যক্তিগত পরিচয় গোপন রেখে ছদ্মনাম ব্যবহার করে নিজের পরিচয় প্রদান করত। পরবর্তীতে সে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারের ভয়ে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে উক্ত স্থান ছেড়ে রাজধানীর ডেমরা এলাকায় একটি বস্তিতে থাকাকালীন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ কর্তৃক গ্রেফতার হয় এই অপরাধী।

গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ