৫০ বছর পর আবার চাঁদে মানুষের অভিযান

Posted on April 5, 2023

অনলাইন ডেস্ক : পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পরে আবার চন্দ্রাভিযানে যাচ্ছে মানুষ। আর কারা যাচ্ছেন সেই অভিযানে, তাদের নাম ঘোষণা করেছে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা। প্রায় ৫৪ বছর আগে, ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে প্রথমবারের মত চাঁদের বুকে নেমেছিলেন নাসার দুই নভোচারী নিল আর্মস্ট্রং আর এডউইন অলড্রিন, আর লুনার মডিউলে করে চাঁদ প্রদক্ষিণ করছিলেন তৃতীয় নভোচারী মাইকেল কলিন্স। এর পরে চাঁদের বুকে শেষবার মানুষ নেমেছিল ১৯৭২ সালে।

এবার নাসা যে নভোচারী দলটি ঘোষণা করেছে - তারা অবশ্য চাঁদের বুকে নামবেন না, কিন্তু তাদের এই মিশন পরবর্তী কোন একটি দলের চাঁদে অবতরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রথম চন্দ্রাভিযানে - বা এমনকি শেষটিতেও - নভোচারীরা সবাই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। কিন্তু এবারের চারজনের দলটিতে বিরাট এক পরিবর্তন এসেছে, এতে আছেন একজন নারী - ক্রিস্টিনা কখ, আর একজন কৃষ্ণাঙ্গ নভোচারী -ভিক্টর গ্লোভার।

বাকি দুজন হলেন রিড ওয়াইজম্যান আর জেরেমি হ্যানসেন। এই দলটির তিনজন মার্কিন নাগরিক, আর একজন ক্যানাডিয়ান।

সোমবার টেক্সাসের হিউস্টনে এক অনুষ্ঠান করে দলটির নাম ঘোষণা করা হয়েছে। একটি ক্যাপসুলে করে তারা চাঁদ প্রদক্ষিণ করবেন - হয়তো আগামী বছরই, বা ২০২৫ সালের কোন এক সময়।

কেন ১৯৭২-এর পর আর চাঁদে মানুষ নামেনি?

এ প্রশ্নটি নিয়ে বহু কথাবার্তা, লেখালেখি হয়েছে। বলা হয়, ১৯৭২ সালের পর চাঁদে মানুষ নামানো যে বন্ধ হয়ে যায় - এর কারণ অনেকগুলো।

একটি কারণ - অর্থ। চন্দ্রাভিযান বা মহাকাশ অভিযান প্রচণ্ড রকমের ব্যয়বহুল। ১৯৬৯ সালে প্রথমবার চাঁদের মাটিতে মানুষের পা রাখা নিশ্চয়ই সারা পৃথিবীতে আলোড়ন এবং উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ১৯৭০এর দশকে এসব অভিযানের পক্ষে মার্কিন জনগণ এবং রাজনীতিবিদদেরও সমর্থন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল। ফলে ১৯৭২এ অ্যাপোলো ১৭-র পর চাঁদে মানুষ পাঠানো অনির্দিষ্টকালের জন্য থেমে যায়।

তাছাড়া অনেকে বলেন, ওই সময়টা ছিল মার্কিন-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধ ও সর্বক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতার যুগ। তবে ১৯৬৯ সালে লুই আর্মস্ট্রং ও এডউইন অলড্রিনের চাঁদে নামার মধ্যে দিয়ে মার্কিন মহাকাশ কর্মসূচির 'শ্রেষ্ঠত্ব' প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পরই আমেরিকানরা ধীরে ধীরে এ ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

নাসাও ধীরে ধীরে তাদের মহাকাশ কর্মসূচিকে স্কাইল্যাব, স্পেস শাটল, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ইত্যাদি কর্মসূচির দিকে নিয়ে যায়।

অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮৬ মহাকাশে স্থাপন করে 'মির' স্পেস স্টেশন। পরবর্তীকালে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশ কর্মসূচিতে সহযোগিতাও শুরু করে।

শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় থেকে মার্কিন মহাকাশ কর্মসূচিতে চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহে অভিযানের মত উদ্যোগগুলো আবার জায়গা পেতে শুরু করে।

রকেট ও মহাকাশ যান তৈরিতে এগিয়ে আসে বেশ কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, তাদের সাথে নানা কর্মকান্ডে যুক্ত হয় নাসা-ও। তারই ধারাবাহিকতায় এসেছে আর্টেমিসের মত কর্মসূচি - যার লক্ষ্য আবার চাঁদের বুকে মানুষ পাঠানো।

কেন এই অভিযান আগের চাইতে একেবারে আলাদা
বলা হচ্ছে, এই অভিযানটি হবে মূলত ১৯৬৮ সালের অ্যাপোলো-৮ অভিযানের অনুরূপ। সেটিই ছিল চাঁদে মানুষের প্রথম যাত্রা - প্রথম স্পেসফ্লাইট। সেই নভোচারীরাই চাঁদের দিগন্তে পৃথিবীর 'উদয়ের' সেই বিখ্যাত ছবিটি তুলেছিলেন, ঠিক যেভাবে আমরা পৃথিবী থেকে সূর্য বা চাঁদ ওঠার ছবি তুলি।

কিন্তু এবারের অভিযানটি - যাকে গ্রিক পৌরাণিক সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর যমজ বোনের নামে 'আর্টেমিস' কর্মসূচি নাম দেয়া হয়েছে - তা হবে অনেক আলাদা। এতে ব্যবহৃত হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর সর্বাধুনিক প্রযুক্তি।

নাসা এ জন্য যে বিশেষ রকেট তৈরি করেছে তার নাম 'স্পেস লঞ্চ সিস্টেম' এসএলএস - আর এতে সংযুক্ত থাকবে যে ক্যাপসুল বা মহাকাশযানটি তার নাম 'ওরায়ন' - এর ভেতরেই থাকবেন নভোচারীরা।

গত বছর নভেম্বর মাসে আর্টেমিস ওয়ান এসএলএসের প্রথম রকেটটিকে পরীক্ষামূলক যাত্রায় পাঠানো হয়। ১০০ মিটার লম্বা এই রকেট ছিল নাসার তৈরি করা এ যাবৎকালের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট।

এতে ছিল ২৭ লক্ষ লিটার তরল হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন জ্বালানি। এতে যে 'থ্রাস্ট' বা রকেটটির ওপরদিকে ওঠার জন্য উর্ধ্বমুখী চাপ তৈরি হয়- তার পরিমাণ ৩৯ মেগানিউটন বা ৮৮ লক্ষ পাউণ্ড। এই রকেটটি ওরায়ন ক্যাপসুলকে চন্দ্রপৃষ্ঠের ৮০ মাইল দূরত্বে নিয়ে যায়।

চন্দ্রযান ওরায়ন
ওরায়ন ক্যাপসুলটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে ঠাসা থাকলেও এটা দেখতে কিন্তু অনেকটা সেই ১৯৬৯ সালের চন্দ্রযান লুনার মডিউলের মতই। এর কারণ খুবই সহজ। এই যানটিকে নভোচারীদের বহন করে নিয়ে যেতে হবে, আবার নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসতেও হবে।

ফিরে আসার সময় যখন এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকবে তখন এর গতিবেগ হবে প্রায় অকল্পনীয় রকমের দ্রুত - ঘন্টায় ২৪ হাজার মাইল। এর নিচের দিকে যে তাপপ্রতিরোধী ঢাকনা থাকবে তা তখন বাতাসের সাথে ঘর্ষণের ফলে ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে যাবে এবং একে ৩,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ সহ্য করার উপযুক্ত হতে হবে। তা নাহলে অবতরণের সময় মহাকাশযানে আগুন ধরে যাবে।

এই তাপ ও গতির প্রতিক্রিয়া সহ্য করার জন্য এই কৌণিক গঠনটাই সবচেয়ে উপযুক্ত - সে কারণেই আগেকার ডিজাইনটিই প্রায় অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে।

পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় এটির গতি ঘন্টায় ২৪,০০০ মাইল থেকে মাত্র ১৭ মাইলে নামিয়ে আনার জন্য ১১টি প্যারাশুট এর সাথে যুক্ত থাকছে। যানটির সমুদ্রে আছড়ে পড়ার জন্য ঘন্টায় ১৭ মাইলই হচ্ছে নিরাপদ গতি। এই ওরায়নের ভেতরে এমন সব প্রযুক্তি থাকবে যা ১৯৬৯ সালের চন্দ্রাভিযানের সময় কেউ কল্পনাও করতে পারেননি।

এতে থাকবে একটি ক্রু মডিউল যাতে থাকবেন নভোচারীরা এবং অন্যান্য সরঞ্জাম। ইউরোপিয়ান সার্ভিস মডিউল নামের অংশটিতে থাকবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা এবং মহাকাশযানটিকে চালানোর প্রযুক্তি।

এর সামনের দিকে থাকবে লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেম বা এলএএস - যা কোন বিপদ বা জরুরি অবস্থা দেখা দিলে ওরায়নকে তা এড়াতে সহায়তা করবে। মহাশূন্যের গভীরে যে উচ্চমাত্রার তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ - তা থেকে রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে এই ক্যাপসুলের ভেতরে।

২০০৬ সাল থেকে এই ওরায়ন তৈরির কাজ শুরু হয় এবং এটি নির্মাণে ১৮০০ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে।

নভোচারীরা কমলা রঙের স্পেসস্যুট পরবেন। তাতে বাতাস, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবস্থা লাগানো থাকবে। কোন কারণে কেবিন থেকে বাতাস বেরিয়ে গেলে নভোচারীদের সুরক্ষা দেবার ব্যবস্থাও থাকবে এই স্পেসস্যুটের ভেতরে।

কতদিন ধরে চলবে এ মিশন
যে রকেটটিতে করে কখ, গ্লোভার, হ্যানসেন ও ওয়াইজম্যান চন্দ্রাভিযানে যাবেন তার নাম হচ্ছে আর্টেমিস-টু। পুরো যাত্রাটি হবে মোট ১০ দিনের।

কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণের পর রকেটটি পৃথিবীর উচ্চ কক্ষপথে পৌছাবে, এবং তার পর রকেট থেকে চন্দ্রযান ক্যাপসুলটি বিচ্ছিন্ন হবে।

এর পর ওরায়ন ক্যাপসুলটির প্রধান ইঞ্জিন চালু হবে এবং সেটি চাঁদের দিকে এগুতে থাকবে। চন্দ্রপৃষ্ঠের ১৪০ কিলোমিটার ওপরে পৌঁছে এটি চাঁদের চারদিকে আবর্তন করবে এবং তার পর পৃথিবীতে ফিরে আসার যাত্রা শুরু করবে।

পৃথিবীর কাছাকাছি আসার পর ক্যাপসুলটির ক্রু মডিউলটি আলাদা হয়ে যাবে এবং তারপর তা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতর প্রবেশ করে প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করবে। সেখান থেকে যানটিকে বিশেষ নৌযানে তুলে নেয়া হবে।

চাঁদের বুকে আবার মানুষ নামবে কবে?
চাঁদে মানুষের প্রথম অবতরণের মিশন অ্যাপোলো-১১ ঘটেছিল ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে। চন্দ্রযান বহনকারী রকেটটির নাম ছিল স্যাটার্ন-ফাইভ । সবশেষ ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে অ্যাপোলো-১৭ মিশনের নভোচারীরা চাঁদের বুকে নেমেছিলেন।

আর্টেমিস-টুর চন্দ্রাভিযান যদি ২০২৪ সালে হয় - তাহলে তার অন্তত ১২ মাস পরে চাঁদের বুকে আবার মানুষের পা ফেলার অভিযানটি হবে। সেটার নাম হবে আর্টেমিস থ্রি।

আর্টেমিস থ্রি অভিযানের নভোচারীরা যে যানটিতে করে চাঁদের মাটিতে নামবেন - তা এখন পরীক্ষামূলক পর্বে রয়েছে। নাসা নিজে এটি তৈরি করছে না।

এর নাম দেয়া হয়েছে স্টারশিপ এবং এই যানটি হবে পুনঃব্যবহার যোগ্য। এটি তৈরি করছে ধনকুবের ইলন মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানি। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এটির ফ্লাইট টেস্টিং শুরু হবে।

আর্টেমিস ওয়ানের নভোচারীদের পরিচয়
রিড ওয়াইজম্যান হচ্ছেন এই দলটির অধিনায়ক। মার্কিন নৌবাহিনীর এই ৪৭ বছর বয়স্ক পাইলট এর আগে একটি মহাকাশ অভিযানে গিয়েছেন। সেটি ছিল ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে। তা ছাড়া তিনি একসময় নাসার নভোচারী অফিসের প্রধান ছিলেন।

ভিক্টর গ্লোভার হচ্ছেন প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান যিনি চন্দ্রাভিযানে যাচ্ছেন। ছেচল্লিশ বছর বয়স্ক মার্কিন নৌবাহিনীর এই টেস্ট পাইলট ২০১৩ সালে নাসায় যোগ দেন। তার প্রথম মহাকাশ যাত্রা ২০২০ সালে এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে তিনি ছয় মাস কাটিয়েছেন।

ক্রিস্টিনা কখ হতে যাচ্ছেন চন্দ্রাভিযাত্রী প্রথম নারী। তার বয়স ৪৪ এবং তিনি একজন ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার। একজন নারী নভোচারী হিসেবে তিনি মহাকাশে একটানা ৩২৮ দিন থেকেছেন যা এক রেকর্ড। জেরেমি হ্যানসেন একজন ক্যানাডিয়ান। তিনি এখনো মহাকাশে যাননি। কৗানাডিয়ান স্পেস এজেন্সিতে যোগ দেবার আগে তিনি সেদেশের বিমানবাহিনীতে একজন যুদ্ধবিমান চালক ছিলেন। এই গ্রীষ্মকালেই তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে এবং তা চলছে পরবর্তী ১৮ মাস ধরে।

চন্দ্রাভিযান: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
নাসার আর্টেমিস মিশনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে গেটওয়ে নামে এমন একটি মহাকাশ স্টেশন তৈরি করা যা চাঁদের কক্ষপথে থাকবে, এবং নভোচারীরা চাঁদে অবতরণের পথে সেটিকে ব্যবহার করতে পারবেন। এ ছাড়া নাসা বিশেষ করে মনোযোগ দিচ্ছে চাঁদের দক্ষিণ মেরু এলাকায়।

এর কারণ, এই অঞ্চলটিতে যে সব জ্বালামুখ আছে সেগুলো স্থায়ীভাবে ছায়ায় ঢাকা থাকে এবং তাতে বরফের আকারে পানি জমা আছে বলে জানা গেছে।

এই পানি যে শুধু মানুষের জীবনধারণের জন্যই অত্যাবশ্যক তাই নয়, পানির উপাদান হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনকে রকেটের জ্বালানি হিসেবেও হয়তো ব্যবহার করা যেতে পারে।

নাসার একজন প্রশাসক বিল নেলসন মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় রত। তার কথায়, চীনও এখন পরিকল্পনা করছে চাঁদের দক্ষিণ মেরু এলাকায় নভোচারী পাঠানোর।

চাঁদ ও মহাকাশে বিভিন্ন দেশের কার্যক্রমের তত্ত্বাবধানের জন্য কিছু নীতিমালা তৈরির এবং আর্টেমিস অ্যাকর্ড নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্যও কাজ চলছে।

সূত্র-বিবিসি।