যে ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসা সহজ, যেগুলোর কঠিন

Posted on December 4, 2024

অনলাইন ডেস্ক : ক্যান্সার এমন একটি জটিল রোগ যা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে শরীরের কোনও অংশে কোষের অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়াকে ক্যান্সার বলা হয়। সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা গেলে এবং সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করলে রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

ক্যান্সার কতটা দ্রুত ছড়াবে সেটি সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। এটি কতটা প্রাণঘাতী হতে পারে তা কোন স্টেজে ধরা পড়ছে তার পাশাপাশি এর লক্ষণ কতটা ধরা পড়ে এর উপরেও নির্ভর করে, বলছিলেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সার্জিক্যাল অনকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. হাসান শাহরিয়ার কল্লোল।

যেসব ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশ্বব্যাপী অনেক উন্নতি হয়েছে সেগুলোতেও সেরে ওঠার হারটা বেশি থাকে।

ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা এনএইচএস, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এবং চিকিৎসকের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এমন কয়েক ধরনের ক্যান্সার সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক যা অধিক প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে কিংবা তুলনামূলক কম প্রাণঘাতী ।

যেসব ক্যান্সার সারানো তুলনামূলক সহজ
ড. হাসান শাহরিয়ার কল্লোলের মতে যে কোনও ক্যান্সারই শনাক্ত করতে বেশি দেরি হয়ে গেলে সেটা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। কিছু ক্যান্সার খুব বেশি দ্রুত বিস্তার হতে থাকলেও আগে শনাক্ত সম্ভব হলে চিকিৎসা সহজতর হয়, আর কিছু ক্যান্সার ধীরগতিতে ছড়ালেও শনাক্ত হতে বেশি দেরি হয়ে গেলে চিকিৎসা কঠিন হয়।

বিশ্বে দুইশর বেশি ধরনের ক্যান্সার রয়েছে যার চিকিৎসা ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন ব্রেন বা ব্লাড ক্যান্সারের বেশ কিছু ধরন থাকে যেগুলো চিকিৎসায় অনেকটাই ভালোভাবে সারানো যায়।

ব্রেস্ট ক্যান্সার
বিশ্বব্যাপী যে ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সেটি স্তন ক্যন্সার। এর চিকিৎসায়ও যথেষ্ট অগ্রগতিও হয়েছে।

আমেরিকার ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী ব্রেস্ট ক্যান্সার তিন গ্রেড বা ধরনের হয়ে থাকে যার মধ্যে গ্রেড ওয়ান বা লো গ্রেড সাধারণত ধীরগতিতে বাড়ে। ক্যান্সার কোষ কী হারে, কীভাবে এবং কতটা দ্রুততার সাথে বাড়ে তার উপর এ গ্রেডগুলো নির্ভর করে। এটি ক্যান্সারের চারটি স্টেজ বা পর্যায়ের অংশ নয়।

এর লক্ষণগুলো মধ্যে স্তনে শক্ত অংশ, নিপল থেকে তরল বের হওয়া, এবং স্তনে পরিবর্তন দেখা যায়। সাধারণত ৫০ বছরের বেশি বয়সের নারীদের স্তন ক্যান্সার বেশি হয়।

স্তনের চামড়া, গড়ন বা ভেতরের দিকে যে কোনও অস্বাভাবিক অবস্থা মনে হলেই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিৎ। সাধারণত এই ধরনের ক্যান্সার অন্য ধরনের চেয়ে বেশি দেখা গেলেও স্তন ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেশ কম থাকে। তবে বেশি দেরি করে চতুর্থ পর্যায়ে চলে গেলে চিকিৎসাটাও তুলনামূলক জটিল হয় বলছিলেন ড. কল্লোল।

প্রোস্টেট ক্যান্সার
প্রোস্টেট ক্যান্সার সাধারণত ধীরে বাড়ে, বিশেষ করে বৃদ্ধ পুরুষদের ক্ষেত্রে। এনএইচএসের তথ্য অনুযায়ী কোনও লক্ষণ বা চিকিৎসা ছাড়াই রোগী যুগ যুগ কাটিয়ে দিতে পারে। অনেক সময় এর তেমন চিকিৎসার প্রয়োজনও হয় না। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসায় সম্পূর্ণ নির্মূলও সম্ভব।

তবে অনেক সময় চিকিৎসকরা পরিস্থিতি বিবেচনায় চিকিৎসা নির্ধারণ করেন কারণ চিকিৎসায় ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা যৌন সক্ষমতায় প্রভাব, এবং প্রস্রাব সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এজন্য ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি অনুযায়ী চিকিৎসা বেছে নেয়া হয়।

আর বাংলাদেশে এর চিকিৎসা খুব বেশি হয় না কারণ রোগীরা সাধারণত দেরিতে চিকিৎসকের কাছে যান যখন কি না খুব বেশি চিকিৎসার সুযোগ থাকে না। তবুও এর বৃদ্ধি ধীরগতির হওয়ায় এটি সেরকম দ্রুত ভয়ানক অবস্থা সৃষ্টি করে না, বলছিলেন ড. কল্লোল।

প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণ কম থাকলেও প্রস্রাবের সমস্যাকে প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়। যেমন বেশি টয়লেট যাওয়ার প্রবণতা, মূত্র নির্গমনে চাপ এবং মূত্রাশয় পুরোপুরি খালি না হওয়ার মতো অনুভূতি। এটি যেমন ধীরগতিতে বাড়ে তেমন প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা গেলে সুস্থ হওয়ার হার অনেক বেশি।

কোলন এবং রেকটাম
কোলন ক্যান্সার বৃহদন্ত্রের ক্যান্সার নামেও পরিচিত। আর রেকটাম হচ্ছে মলদ্বার। এই দুই ধরনের ক্যান্সার সমস্যার হলেও এর চিকিৎসা তুলনামূলক বেশি প্রচলিত বলে উল্লেখ করেন ড. কল্লোল।

“কোলন ক্যান্সার অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় পলিপ থেকে যেটা কেটে ফেললেই সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে যায়। কারণ পলিপটাই আস্তে আসে পাঁচ-সাত বছর, দশ বছর পার হয়ে ক্যান্সারে রূপান্তর হয়,” বলছিলেন তিনি। সেক্ষেত্রে দুই তিন বছর পর পর কোলনস্কপি করানো ভালো বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এছাড়া এই ক্যান্সার হয়ে গেলে বেশ কিছু লক্ষণ থাকে। যেমন মলের ধরনে পরিবর্তন, মলের সাথে রক্ত, বা এমনিতে রক্ত, মলত্যাগ করার পরও অস্বস্তি, পেট ব্যথা, ওজন কমা, দুর্বলতা এমন অনেক বিষয় রয়েছে।

এর কোনওটা তিন সপ্তাহ বা তার বেশি হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে বলছে এনএইচএস।

পাকস্থলীর ক্যান্সার
চিকিৎসা করে পাকস্থলীর ক্যান্সারও প্রাথমিক পর্যায়ে সারানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সাফল্য পাওয়া গেছে। যদিও এর লক্ষণ ধরতে পারাটা অনেক সময় কঠিন হয়।

এক্ষেত্রে এনএইচএস যে লক্ষণ উল্লেখ করছে এর মধ্যে রয়েছে বুক জ্বালাপোড়া বা অ্যাসিডিটি, খাবার গেলার সমস্যা, শরীর খারাপ লাগা, হজমে সমস্যা, খাবার অল্প খেয়ে পেট ভরে যাওয়া, ক্ষুধামন্দা, পেটের উপরের দিকে ব্যথা বা দলার মতো বোধ হওয়া, হঠাৎ ওজন কমা এমন বিষয়। তিন সপ্তাহের বেশি লক্ষণ থাকলে চিকিৎসকের কাছে যেতে বলা হয়।

যেসব ক্যান্সার মারাত্মক হয়ে ওঠে
কিছু ক্যান্সার বেশি প্রাণঘাতি হয় কারণ এর লক্ষণগুলো সেভাবে প্রকতভাবে সামনে আসে না, যখন আসে ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে যায়। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার, ফুসফুস অথবা অগ্নাশয়ের ক্যান্সারের রোগীরা সাধারণত তাদের কাছে আসেন বেশ দেরিতে কারণ লক্ষণগুলো বুঝে উঠতে অনেক সময় দেরি হয়ে যায়।

অগ্নাশয়ের ক্যান্সার
অগ্নাশয় বা প্যানক্রিয়াসের অবস্থান পাকস্থলির ঠিক নিচ দিকে থাকে। এটি খাবার হজম বা ইনসুলিনের মতো হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে।

এর লক্ষণ হিসেবে এনএইচএস উল্লেখ করছে চোখ বা ত্বক হলুদ বর্ণ ধারণ, ত্বক চুলকানি ভাব, মলমূত্রের রঙ পরিবরতন, ক্ষুধামন্দা, দুর্বল বোধ করা, কারণ ছাড়া ওজন কমে যাওয়া, জ্বর ওঠা, ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠ্যকাঠিন্য, হজমে সমস্যা, পেটের উপরের দিকে ব্যথা যেটা খাওয়ার সময় বা শুলে বেড়ে যায় ও সামনে ঝুঁকলে কম মনে হয়।

ফুসফুসের ক্যান্সার
ফুসফুসের ক্যান্সার ব্যাপকভাবে আলোচিত হওয়া গুরুতর ধরনের ক্যান্সার। ন্যাশনাল ক্যান্সার সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী স্তন ও প্রস্টেট ক্যান্সারের পর সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ফুসফুসের ক্যান্সার।

এটির বিস্তার দ্রুত হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে না। এর মাঝেও বেশ কিছু লক্ষণ থাকে বলে উল্লেখ করছে এনএইচএস। যেমন অবিরাম কাশি, কাশির সাথে রক্ত, ক্রমাগত শ্বাসকষ্ট, কারণ ছাড়া ক্লান্তি ও ওজন কমা, শ্বাস বা কাশির সময় ব্যথা বা ব্যথা ভাব।

ইসোফেগাস বা খাদ্যনালীর ক্যান্সার
খাদ্যনালী দিয়ে খাবার সাধারণত পাকস্থলি পর্যন্ত পৌঁছায়। “খাদ্যনালী ক্যান্সারে খুব বেশি লক্ষণ বুঝা যায় না, যেমন রোগী প্রথম লক্ষণ নিয়ে আসেন যে খাবার গিলতে কষ্ট হচ্ছে, এটা শুনলে বুঝা যায় এটি বেশ অ্যাডভানসড পর্যায়ে চলে গেছে, বলছিলেন ড. কল্লোল।

এর আগে তেমন ভালো লাগছে না, অথবা খাবার খেলে গ্যাস বা অ্যাসিডিটি হওয়া মতো বোধ হচ্ছে সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। এজন্য এই ধরনের ক্যান্সার বেশি খারাপ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এনএইচএস বলছে গিলতে সমস্যা, ওজন কমা, তিন সপ্তাহের বেশি বুক জ্বালাপোড়া, অকারণে ওজন কমা এমন লক্ষণ থাকলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হেলাফেলা করা যাবে না।

ওভারিয়ান ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার
নারীর প্রজননের সাথে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ডিম্বাশয়। এটিকে নীরব ঘাতক হিসেবে দেখা হয় কারণ চিকিৎসকদের মতে- এই ক্যান্সারের প্রাথমিক উপসর্গ প্রায় লক্ষ্যই করা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যথা হয় না।

তবে পরিবারে এই ধরনের ক্যান্সারের প্রবণতা থেকে থাকলে এ বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এছাড়া যে লক্ষণ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলা হয় তার একটি হলো- ক্ষুধামন্দা।

এর বাইরে পেট ব্যথা, যোনীপথে রক্তক্ষরণ, মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন, এমন কোনও লক্ষণ দুই সপ্তাহ বা এর বেশি হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বা সিডিসি।

সূত্র-বিবিসি।