আমার শিরায় রয়েছে বাবার শেখানো মূল্যবোধ: তপন চৌধুরী

Posted on May 28, 2018
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের এমডি তপন চৌধুরী। স্যামসন এইচ চৌধুরীর প্রয়াণের পর কোম্পানির ইতিবাচক পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। এ পরিবর্তনের ধারায় গত পাঁচ বছরে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের টার্নওভার হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এ সাফল্যের চাবিকাঠি, ব্যবসার নীতি-নৈতিকতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে কথা বলেছেন। 

প্রশ্ন: স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রতিষ্ঠাতা স্যামসন এইচ চৌধুরী প্রতিষ্ঠানকে যে অবস্থায় রেখে গেছেন, সে অবস্থান থেকে গত পাঁচ বছরে টার্নওভার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ সাফল্য কীভাবে অর্জন করলেন?

তপন চৌধুরী: বাবার সঙ্গে আমি দীর্ঘ সময় কাজ করেছি। পড়ালেখা শেষ করে যখন ব্যবসায় আসি, তখন বয়স কম ছিল। অনেক ব্যাপারেই মনে হতো উনি পুরনো দিনের মানুষ- ‘ফ্রম দ্য ওল্ড স্কুল অব থটস’, এজন্য ভ্যালুজ নিয়ে অনেক বেশি কথাবার্তা বলেন, আইন-কানুন নিয়েও বলেন। অথচ আমি দেখতাম, ওই সময় যারা আমাদের প্রতিযোগী, তারা অনেক ক্ষেত্রে কম্প্রোমাইজ করছে। ব্যবসার প্রফিট, লয়্যালটি এ বিষয়গুলোয় তিনি ছিলেন কঠোর। আমার মনে আছে, যখন প্রথম এ দেশে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর চালু হয়, তখন আমাদের প্রতিযোগীরা প্রকৃত টার্নওভার ঘোষণা করত না। এর জন্য হয়তো অনেক পয়সা তাদের সেভ হতো। আমি একদিন সাহস করে তার কাছে বিষয়টি বলাতে তিনি আমাকে বললেন, ভ্যাট কী জিনিস বোঝো? আমি বিব্রত ও অপমান বোধ থেকেই বললাম, ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স। এরপর তিনি প্রশ্ন করলেন, ভ্যাট কে দেয়? বললাম কনজিউমার (ভোক্তা) দেয়। এরপর তিনি জানতে চাইলেন তোমার ভূমিকা কী? বললাম, কালেক্ট করে সরকারের কোষাগারে জমা দেয়া। তখন তিনি বললেন, তাহলে এ টাকার দিকে তোমার নজর কেন? এ টাকা কি তোমার?

এরপর তিনি কড়া কথা শোনালেন। বললেন, তোমার প্রফিট্যাবিলিটি তোমার কস্টিংয়ের মধ্যে যদি বিল্ডআপ না থাকে, যখন দেখছো মুনাফা হচ্ছে না, তখন সে ব্যবসা থেকে বেরিয়ে পড়। তুমি সে পণ্য উৎপাদন কোরো না, যদি দেখো ওই ইন্ডাস্ট্রিতে লাভ নেই। যে টাকা সরকারের, আর দিচ্ছে ভোক্তা, সে টাকার দিকে তোমার নজর কেন? তখন আমি বিপণন পরিচালক, ভেবেছিলাম পুরনো ধ্যান-ধারণার মানুষ এমনই। পরে তিনি ডাকলেন, কথা বললেন পিতা হিসেবে পুত্রকে। বললেন, দেখো তুমি যাদের কথা বলছ, আমি হয়তো বেঁচে না-ও থাকতে পারি, কিন্তু তুমি দেখবে এরা কেউ ব্যবসায় থাকবে না। বাবা যে সঠিক ছিলেন, তিনি জীবিত থাকতেই তা দেখলাম। সাত-আট বছরের মধ্যে কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রশ্ন: স্যামসন এইচ চৌধুরীর নাম এলেই বিজনেস ভ্যালুজের কথা এসে যায়। বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

তপন চৌধুরী: ‘সত্ভাবে কাজ করলে সফল হবেই’- এটা তিনি সবসময় বলতেন। আরো বলতেন, তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে, সত্ভাবে পরিশ্রম করে যেতে হবে। বাবার ওই বিষয়গুলো ভেইনের মধ্যে রয়ে গেছে। সবসময় চিন্তা করতেন কোন উপায়ে ব্যবসায় নিরাপদ থাকা যাবে। দিনে অনেকবার দেখতেন ইল্ড কী হচ্ছে, ওওএস (আউট অব স্পেসিফিকেশন) কোন জায়গাগুলোতে হচ্ছে, কিন্তু মান কম্প্রোমাইজ ছাড়া। যে পণ্যটি তুমি কিনছ, সেটা সর্বোচ্চ কম্পিটিটিভ প্রাইসে কিনছ কিনা, ওল্ড মার্কেটে কী ধরনের প্রাইস আছে, এ বিষয়গুলোতে সচেতন থাকতে বলতেন। ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য খুবই সেনসিটিভ পণ্য। সস্তায় তো অনেক কিছুই পাওয়া যায়, তাই সোর্সগুলো আবার অডিট করতে হয়। এ বিষয়গুলো সবসময় মাথার মধ্যে ছিল। ইচ্ছা করলেই নীতি বিসর্জন দেয়া যায় না বা কম্প্রোমাইজ করা যায় না। এ বিষয়গুলো রক্তে রয়ে গেছে, কখনো বদলাতে পারব না।

১৯৫৮ সালে ৫ হাজার করে চার বন্ধু মিলে ২০ হাজার টাকার মূলধন নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন বাবা। আমার দাদা ছিলেন ডাক্তার, পাবনা শহর থেকে ১২ মাইল দূরে আতাইকুলা এলাকায়। বাবা শহরে এসে যে বাড়িটায় থাকতেন তার ভাড়া ছিল ৩০ টাকা। সেটা নিয়ে তার কোনো যন্ত্রণাবোধ ছিল না। তিনি কখনই ঢাকায় আসতে চাননি। তার কথা ছিল- পাবনাতেই আমার শুরু, যা করব এখানেই করব। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় আসার একমাত্র যে কারণটি ছিল তা হলো ব্যবসা বহুমুখী করা। ওই সময় ইপিজেড হচ্ছিল, গার্মেন্টস খাতটা শুরু হলো। আমরাও ওই খাতে যাওয়া যৌক্তিক মনে করলাম। বাবা বললেন, আমাদের ভালো হবে স্পিনিংয়ে যাওয়া। তখন আমরা স্পিনিং শুরু করলাম। এরপর বেশকিছু সময় পার হলো। পাবলিক লিস্টিংয়ে (পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি) গেলাম। এভাবেই ধীরে ধীরে সফলতা এসেছে। রাতারাতি অনেক কিছু করতে হবে এমন ধারণায় আমরা কখনই বিশ্বাস করতাম না।

প্রশ্ন: অভ্যন্তরীণ বাজারে বাংলাদেশে তৈরি ওষুধের মান নানাভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ওষুধের মান সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

তপন চৌধুরী: আমি বলব না শতভাগ ভালো, কিন্তু লিডিং কোম্পানি যেগুলো আছে, সেগুলোর পণ্যের মান ভালো। আগে ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের লোকবল তেমন প্রশিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ওখানে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। এখন ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে অনেক যোগ্য লোক কাজ করছেন। সরকারের তহবিল থেকে তারা আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। এখন এ কর্মকর্তারা অনেক গভীরভাবে কাজ করতে দক্ষ। এখন যারা ওষুধ রফতানি করছে, তাদের ওষুধের মান রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর এ শিল্পে এখন অনেক শিক্ষিত লোক কাজ করছেন। আসলে ওষুধের বিষয়ে সবার ভাবতে হবে, আমাদেরও সচেতনতার ঘাটতি আছে।

প্রশ্ন: বিদেশের বাজারে বাংলাদেশী ওষুধের ভবিষ্যৎ কেমন হবে বলে আশা করছেন? কেনিয়ায় বিনিয়োগ উদ্যোগ বাস্তবায়ন শুরু করেছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। ওই প্রকল্পকে ঘিরে স্কয়ারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কী?

তপন চৌধুরী: রফতানি বাজার খুব দ্রুত বড় হচ্ছে। এজন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার শুধু প্রস্তুতির জন্য। কেনিয়া আমাদের জন্য বড় সুযোগ। কিন্তু প্রথমে এ দেশে আমাদের জন্য ওষুধ উৎপাদন করতে হবে। এরই মধ্যে আমরা বাজারের প্রায় ২০ শতাংশ জুড়ে আছি। স্থানীয় বাজারে আর কতটা বড় হতে পারবে? এখনই সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বাজার আমাদের। এ রকমভাবে নিজস্ব বাজার আরো বড় করা কঠিন। আর কেনিয়ায় যাওয়ার অভিজ্ঞতাটাও অনেক বড়। ইস্ট আফ্রিকান জোনটা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাজার নয়। প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের বাজার ওখানে। তাই বড় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওখানে ব্যবসা পোষাচ্ছে না। বহুজাতিকরা ভিন্ন কৌশল নিয়ে ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্টে যাচ্ছে না, কন্ট্রাক্ট ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে যাচ্ছে। মার্কিন বাজারে তো আমরা ফার্মার ক্ষেত্রে বড় ব্র্যান্ডের কাজ করে দিচ্ছি, ঠিক তৈরি পোশাকের মতোই। তবে ফার্মার ক্ষেত্রে ইন্টেগ্রিটির বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আন্তর্জাতিক অডিটের ক্ষেত্রে নিয়মগুলো কঠোরভাবে নজরদারি করা হয়।

প্রশ্ন: বিদেশে বাংলাদেশের বিনিয়োগকে নিরাপদ করতে কী ধরনের নীতিমালা প্রয়োজন?

তপন চৌধুরী: পলিসিটা হতে হবে সিকিউরড। এখন আন্ডারটেকিং নেয়া হচ্ছে। আমাদের ক্ষেত্রে যেমন চার বছরের মধ্যে টাকা ফেরত আসতে হবে। এছাড়া অনেক পেনাল্টির ধারা আছে। তারপর আছে প্রফিটের বিষয়, সেই টাকা অনুমোদন ছাড়া অন্য কোথাও ব্যবহার করা যাবে না। এছাড়া আরো কিছু বিষয় আছে, যেমন প্রতি বছর নিয়মিত অডিট করা এবং যেকোনো সময় অডিট করা। অনেক নিয়মনীতি আছে, সেগুলো সরকার যদি কঠোরভাবে অনুসরণ করে, তাহলে বিদেশে বিনিয়োগ নিরাপদ। গার্মেন্টস খাতেও এ সুযোগ দেয়া উচিত। আমরা মনে করি, বিদেশে বিনিয়োগের দ্বার খুলে দিলেই সমস্যা দেখা দেবে, এটা সঠিক নয়। এখন দু-একটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশে গিয়ে টাকা রাখাটা সহজ নয়। ইউরোপ-আমেরিকায় তো প্রশ্নই ওঠে না। কেউই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে না, অনেক কঠিন। সুতরাং টাকা নিয়ে চলে যাবে ওই সময় পার হয়ে গেছে।

প্রশ্ন: ২০৩২ সাল সামনে রেখে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বর্তমান প্রস্তুতি কতটা কার্যকর বলে মনে করেন?

তপন চৌধুরী: এপিআই (অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট) প্রক্রিয়াটি খুবই ধীরগতিতে চলছে। যে প্রকল্পটি চলছে, সেটি শেষ হতে অনেক বেশি সময় লাগছে। বাংলাদেশ থেকে এপিআই রফতানির ভবিষ্যৎও উজ্জ্বল নয়। ভারত-চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে রফতানি করাটা এত সহজ হবে না। এপিআইয়ের জন্য পেট্রোকেমিক্যালসহ যেসব কাঁচামাল প্রয়োজন, সেগুলোর জন্য ভারত ও চীনের ওপর নির্ভর করতে হবে। ওদের কাছ থেকে কাঁচামাল এনে এখান থেকে রফতানি করে টিকে থাকা কঠিন। আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে কিছু চাহিদা আছে, সেগুলোর বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বড় পরিসরে কিছু করার সুযোগ এপিআইয়ে নেই। স্কয়ার, বেক্সিমকো, গ্লোব এপিআই নিয়ে কাজ করছে। এখন বায়োটেকনোলজির সম্ভাবনা উন্মোচন হচ্ছে। আমাদেরও এখন অনেক বিজ্ঞানী প্রয়োজন। বাংলাদেশীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের নিয়ে আমরাও কাজ করছি। আর ফার্মা খাতে বর্তমান যুগে মান নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই, এটা বাধ্যবাধকতা। মান বজায় রাখব, এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই, রাখতেই হবে। মানের কথা বলতে গেলে মানুষ হাসবে আর সন্দেহ পোষণ করবে। ফার্মা পণ্যে এটাই বাস্তবতা। হয় ভালো, নয়তো বাতিল-এর বাইরে অন্য কোনো মাপকাঠির বিষয় নেই।

প্রশ্ন: ব্যাংকঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়া এখন চর্চায় পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সফলভাবে ডেট ফ্রি ব্যবসা পরিচালনা করছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। এর রহস্য কী?

তপন চৌধুরী: যখনই কোনো নতুন প্রকল্প হয়, দেখা যায় লোকজন বিপুল পরিমাণ দায় সৃষ্টি করে। এ দায় শোধ করতে গিয়ে কোম্পানিকে গলদঘর্ম হতে হয়। এর কোনো মানে হয় না। আমার কস্ট অব ক্যাপিটাল কী? আমার তো শুধু ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল। আমি যদি ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিই, তাহলে মাসে মাসে আমাকে ওই টাকার ওপর ইন্টারেন্ট দিতে হবে না? নির্দিষ্ট সময় পর আবার প্রিন্সিপ্যাল অ্যামাউন্টও তো সমন্বয় করতে হবে। প্রথম যখন আমরা ব্যাংক থেকে প্রকল্পের টাকা নিয়েছি, প্রথম দুই বছরে পাই পাই শোধ করেছি। ওই সময় পর্যন্ত একটি পয়সাও নেয়া হয়নি ওই প্রকল্প থেকে। আমরা যখন স্কয়ার হাসপাতাল করি, হাসপাতাল প্রকল্প কিন্তু প্রথম সাত-আট বছর ব্রেকইভেনে আসেনি। প্রথম দিন থেকেই আমরা প্রতিশ্রুতি রক্ষার চেষ্টা করেছি। আর এ প্রকল্প থেকে কোনো টাকা আমরা লভ্যাংশ হিসেবে নিইনি। আমাদের স্পন্সরদের কারো এটা দরকার নেই। এক পয়সাও আমরা এ প্রকল্প থেকে নেব না। এখানে আরেকটি চর্চা আমরা ধরে রেখেছি- আমরা (স্পন্সর) এখান থেকে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো ডিসকাউন্ট নিই না। আমাদের ফার্মার যারা কর্মী আছেন, তারা হাসপাতালে ডিসকাউন্ট পান। কিন্তু তা হাসপাতাল নয়, পরিশোধ করে ফার্মাসিউটিক্যালস। আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীর জন্যই এটা প্রয়োজ্য। এ ধরনের নিয়মাচারের জন্যই সাত-আট বছরের মধ্যে প্রকল্পটি ব্রেকইভেনে চলে এসেছে।

প্রশ্ন: পুঁজিবাজার নিয়ে স্কয়ার ফার্মার দর্শন কী?

তপন চৌধুরী: ক্যাপিটাল মার্কেট আইন অনুযায়ী আজকেই যদি আমি ডিক্লেয়ার করি যে, আট লাখ শেয়ার আমি মার্কেট থেকে নেব, স্পন্সর হিসেবে আমি তা পারি। আপনারা দেখবেন তাত্ক্ষণিকভাবেই মূল্য বেড়ে যাবে। একইভাবে আমি যদি বলি আট লাখ শেয়ার আমি কাল বিক্রি করব, মূল্য নিচে নেমে আসবে। তারপর আবার এক-দেড় মাস পর আমি মার্কেটে ছেড়ে দেব, এগুলো সবই স্বাভাবিক ও বৈধভাবে সম্ভব। বিশ্বের অনেক দেশেই এ ধরনের ব্যাপারগুলো হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা কখনো এ বিষয়গুলো অ্যালাউ করতেন না। বলতেন, আমাদের দেশে যারা ক্যাপিটাল মার্কেটে আসে, তারা অনেকেই ব্যালান্সশিট বোঝেন না, সারা জীবনের পুঁজি ঢেলে লাভ কোত্থেকে আসবে তাও বোঝেন না। এ ধরনের বিষয়গুলোকে তিনি কখনই উৎসাহ দিতেন না। আমরাও এখনো সেগুলো ধরে রেখেছি, মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও। তার দেয়া সব শিক্ষা আমরা ধরে রেখেছি, যার প্রতিফলনও পরে আমরা দেখেছি। কিছু জায়গায় আমরা খুবই কনজারভেটিভ। আমরা কখনই মূল্য সুবিধা নিতে হঠাৎ করে বাজারে স্পর্শকাতর কোনো তথ্য ছড়িয়ে দিইনি। কখনো কখনো আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছেন, ভাই এখন কী কিনব? আমি বলেছি, স্যরি এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না। তবে আমি বলতে পারি, স্কয়ারের ভিত্তি অনেক শক্তিশালী। আপনি আজকে যে দামেই কেনেন, রশিদ রাখেন, বিক্রির প্রয়োজন পড়লে ঠিক সে দামেই কিনে নেব সেটাই গ্যারান্টি। আমাদের দেশে ব্যবসায় এ ধরনের চর্চা অনুপস্থিত। তবে এ ধরনের চর্চা হওয়া প্রয়োজন, তাহলে সবার জন্যই ভালো হতো। এসব মিলিয়েই আমাদের সফলতার চাবিকাঠি। এ সাফল্যকে শুধু টাকা দিয়ে বিচার করলে হবে না।

প্রশ্ন: বর্তমানে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের অবস্থা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

তপন চৌধুরী: আস্থাটা কমে যাচ্ছে- শুধু বিনিয়োগকারী নয়, সাধারণ মানুষেরও। এটা কিন্তু আমরা অবজ্ঞা করতে পারি না। কারণ একটা ধারণা তৈরি হলে মানুষ প্রভাবিত হয়। মানুষ যখন দেখছে অমুক ব্যাংকের এত হাজার কোটি টাকা নেই, তখন তাদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিচ্ছে, প্রশ্ন উঠছে তাহলে হচ্ছেটা কী? বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের জন্য এগুলো ভালো উদাহরণ নয়।

প্রশ্ন: নতুন প্রজন্মকে দেশের উন্নয়নে কীভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

তপন চৌধুরী: আজকে স্কুলের শিশু থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যে কাউকে প্রশ্ন করলে সে বলবে, এ দেশ ছেড়ে আমি বিদেশে চলে যাব। বিস্ময়ের বিষয় হলো, এটা তাদের স্বপ্ন। এখন মা-বাবাও তাই চান। কেউ বিদেশে পড়ালেখা করতে গিয়ে আর ফিরে আসে না। যারা ভালো করছে, তাদের মাধ্যমে ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারলে নতুন প্রজন্মকে ধরে রাখতে না পারার কোনো কারণ নেই। নতুন প্রজন্মকে ধরে রাখতে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। এভাবে ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। প্রবাসীরা বাংলাদেশকে আমাদের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। তারা দেশের জন্য ভাবে। আমাদের আগে তারা দেশের খবরটা পায়। বিজ্ঞানী, ব্যবস্থাপনাসহ সব ধরনের বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশীদের মধ্যে আছে, তাদের শুধু স্বীকৃতি দিতে হবে। দেশে এখন অনেক ভালো প্রকল্প হচ্ছে। মান নিয়ে ভীষণরকম খুঁতখুঁতে জাপানিরা পর্যন্ত স্কয়ারের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ভারতীয়রা প্রকল্প দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে সেদেশের মানুষের কাছে বলছে, শোনো আমরা তো বাংলাদেশের কাছে হেরে গেলাম। ইন্ডাস্ট্রি এখন ভালো হচ্ছে, নতুন প্রজন্ম এগুলো দেখে দেশেই সুযোগ সম্ভাবনার বিষয়ে আশাবাদী হতে পারছে। তবে দেশের শিক্ষাকেন্দ্র বলতে এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। আর আছে অল্প কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বাকিগুলোয় শুধু টাকা ও ড্রাগস। পড়ালেখাটাও এখন পশ্চিমা দেশগুলোর মতো ব্যবসা হয়ে গেছে। এ ডিগ্রি দিয়ে কী হবে?

প্রশ্ন: দেশের অর্থনীতির জন্য পরবর্তী বড় শিল্প কী হতে পারে?

তপন চৌধুরী: একদম নতুন করে কোনো শিল্প এখনই দেখছি না। বড় বিনিয়োগ আসে, এমন নতুন খাতের মধ্যে বিদ্যুৎ ও এলএনজি নিয়ে অনেকে দৌড়াচ্ছে। আমরা মনে করছি, অনেক কিছু আমরা ছোঁব না। ঠিক এ মুহূর্তে আমরা কোর বিজনেসে মনোনিবেশ করব। আমাদের একটা নিশ্চিত শক্তি তৈরি হয়েছে। এটাকেই আরো অনেক বেশি অর্গানাইজড করতে চাই, এক্সপ্যানশনে যেতে চাই, একটু অন্যভাবে দেখতে চাই। সেটা ফার্মা হোক, টেক্সটাইল হোক, টয়লেট্রিজ বা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। দেশে-বিদেশে সব জায়গাতেই এগুলোর বিপুল সম্ভাবনা আছে। প্রথম যখন জুঁই বিক্রি শুরু হয়, তখন খোলাবাজার থেকে বেরিয়ে আটআনা বেশি দিয়ে মানুষ মানসম্পন্ন পণ্যটি বেছে নিল। লোকে ভালো পণ্য চায়, তারা যদি তা না-ই চাইত, তাহলে আমরা এখনকার অবস্থানে থাকতাম না।

প্রশ্ন: স্কয়ার গ্রুপের কোনো ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা আছে, যা জানলে অন্যরা শিখতে পারবে?

তপন চৌধুরী: আমরা কিছু নতুন ফিল্ডে ট্রাই করেছিলাম, যেমন পিএসটিএন নিয়ে ব্র্যাকের সঙ্গে। একটা পর্যায়ে আমরা সরে আসি। সেটা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ ওখানে খুব খারাপ অবস্থায় পড়তে হয়েছে। ওই একটাই ছিল।

প্রশ্ন: দেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য কোনো বার্তা দিতে চান?

তপন চৌধুরী: ‘লেটস হ্যাভ সামথিং ইন্টারঅ্যাকটিভ’- সবাই এ কথাটা সবসময় বলে, ব্যবসায়ীরা সবসময় এটা চান, ওটা চান। ব্যবসায়ীরা আসলেও চান। তবে সরকারের দিকটিও ভাবতে হবে। সরকারের প্রচুর সীমাবদ্ধতা আছে। আমি দুদিকেই ভাবতে চাই। আমরা যদি সবসময় শুধু কমাতে বলি, তাহলে সমস্যা। আর ব্যবসার পরিবেশের বিভিন্ন দিক নিয়ে বলব, সবকিছু নিয়ে যদি আমাদের দৌড়াতে হয়, সেটাও সমস্যা। আমরা কথায় বলি দুর্নীতি হচ্ছে, কিন্তু আমরা কীভাবে নিশ্চিত, ওখানে আমার লোকটি নেই। আসলে নতুন প্রজন্মের জন্যই সবকিছুতে এখন স্বচ্ছতা প্রয়োজন। বহু মানুষ আছে, যারা সৎ কিন্তু তাদের ভুগতে হচ্ছে।

সৌজন্যে: বণিক বার্তা।