তথ্যপ্রযুক্তিতে পরনির্ভরশীলতা কমাতে কাজ করছে ওয়ালটন: মো. লিয়াকত আলী

Posted on April 30, 2018

ওয়ালটনের হাত ধরে স্মার্টফোনের পর কম্পিউটার নির্মাতা দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। কম্পিউটার কারখানা চালুর দুই মাসের মধ্যে গত ২১ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ল্যাপটপ রফতানি কার্যক্রমও শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার উৎপাদন কারখানা এবং স্থানীয় হার্ডওয়্যার শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি এক জাতীয় দৈনিকের সাথে কথা বলেন ওয়ালটনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর এবং কম্পিউটার প্রজেক্ট ইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার মো. লিয়াকত আলী।

প্রশ্ন: স্মার্টফোনের পর কম্পিউটার উৎপাদন কারখানা চালু করেছে ওয়ালটন। ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের পাশাপাশি ওয়ালটন কারখানায় আর কী কী কম্পিউটিং ডিভাইস তৈরি হচ্ছে?

মো. লিয়াকত আলী: আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে, গত বছরের ৫ অক্টোবর দেশের প্রথম স্মার্টফোন উৎপাদন কারখানা চালু করতে পেরেছি। পাশাপাশি চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি ওয়ালটন কম্পিউটার উৎপাদন কারখানা উদ্বোধন করা হয়। ওয়ালটন কম্পিউটার কারখানায় ডেস্কটপ এবং ল্যাপটপ ছাড়াও মনিটর ও কম্পিউটারের অন্যান্য অ্যাকসেসরিজ তৈরি হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ল্যাপটপের এ কভার, বি কভার, কিবোর্ড, মাউসপ্যাড, পাওয়ার কর্ড ইত্যাদি। এছাড়া ওয়ালটন কারখানায় দুই স্তরের মাদারবোর্ড তৈরি হচ্ছে। শিগগিরই আমরা মাল্টিলেয়ার মাদারবোর্ড উৎপাদনে যাব। ওয়ালটনের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হলো, প্রসেসর বাদে কম্পিউটার ও ল্যাপটপ তৈরির সব যন্ত্রাংশ দেশে তৈরি করা।

প্রশ্ন: দেশে কম্পিউটার কারখানা চালুর উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি সাহসী পদক্ষেপ। এত বড় একটি উদ্যোগ নেয়ার কারণ কী?

মো. লিয়াকত আলী: বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। মানুষ এখন প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। এটা আধুনিক যুগের চাহিদা। বর্তমানে প্রযুক্তির বাইরে একটি পদক্ষেপও সম্ভব নয়। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সব ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির সুফল পেতে যেসব ডিভাইস প্রয়োজন, তা আমাদের নিজেদের ছিল না। প্রযুক্তিপণ্যের পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ ও মেধাবীরা দেশে কাজের পর্যাপ্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতেন। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতসংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি সরকারের ইচ্ছে ছিল তথ্যপ্রযুক্তি ও সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলো দেশেই উৎপাদন হবে। ওয়ালটন সে প্রেক্ষাপটে দেশে ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ কম্পিউটার তৈরির লক্ষ্য নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে কাজ শুরু করে। কারণ এসব ডিভাইস আমদানিতে দেশের অর্থের একটি বৃহৎ অংশ বাইরে চলে যেত। ওয়ালটন দেশের মেধা ও কষ্টার্জিত অর্থের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের প্রযুক্তিপণ্যের জোগান দিয়ে বর্তমান অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে প্রবহমান রাখতে কম্পিউটিং ডিভাইসের জন্য পরনির্ভরশীলতা হ্রাসের প্রয়াস থেকে কম্পিউটার কারখানা স্থাপনে উদ্যোগ নেয়।

প্রশ্ন: ওয়ালটন কম্পিউটার কারখানার বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা কত?

মো. লিয়াকত আলী: ওয়ালটন কারখানার আয়তন, মেশিনারিসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত যে সুবিধা আছে, তাতে ডেস্কটপ কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মনিটরের পাশাপাশি অন্যান্য পণ্য মিলিয়ে বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ লাখ ইউনিট।

প্রশ্ন: ওয়ালটন কারখানায় প্রতি মাসে কত ইউনিট কম্পিউটার উৎপাদন হচ্ছে?

মো. লিয়াকত আলী: প্রাথমিকভাবে ওয়ালটন কারখানায় প্রতি মাসে ৬০ হাজার ল্যাপটপ, ৩০ হাজার ডেস্কটপ এবং ৩০ হাজার মনিটর উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করি। বর্তমানে ওয়ালটন কারখানায় ৬ হাজার ল্যাপটপ, ৩ হাজার ডেস্কটপ এবং ৩ হাজার ইউনিট মনিটর তৈরি হচ্ছে।

প্রশ্ন: কারখানায় কর্মী সংখ্যা কত?

মো. লিয়াকত আলী: ওয়ালটন কম্পিউটার কারখানায় সাত শতাধিক মানুষ কাজ করছে। এছাড়া বিপণন এবং ব্যবস্থাপনায় আরো প্রায় এক হাজার মানুষ যুক্ত আছে।

প্রশ্ন: ডিজাইন, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে কোনো বিভাগ আছে কি?

মো. লিয়াকত আলী: কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মনিটরসহ মাউস, কিবোর্ড, পেন ড্রাইভ ও অন্যান্য অ্যাকসেসরিজের ডিজাইন ও উন্নয়নের জন্য ওয়ালটনের নিজস্ব রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আরঅ্যান্ডডি) বিভাগ রয়েছে। বিভিন্ন কম্পিউটিং ডিভাইসের ডিজাইন ও মান নিয়ে সেখানে প্রতিনিয়ত গবেষণা হচ্ছে। ওয়ালটন পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কোয়ালিটি কন্ট্রোল (কিউসি) বিভাগ। যেখানে উৎপাদিত প্রতিটি প্রযুক্তিপণ্যের মান নিশ্চিত করা হচ্ছে। ওয়ালটন কম্পিউটার কারখানার গবেষণা, উন্নয়ন ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগে কাজ করছে একদল দক্ষ ও মেধাবী প্রকৌশলী।

প্রশ্ন: এ পর্যন্ত দেশে তৈরি কয়টি মডেলের ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ কম্পিউটার বাজারে ছেড়েছে ওয়ালটন?

মো. লিয়াকত আলী: কম্পিউটার উৎপাদন কারখানা চালুর দুই মাসের মধ্যে আমরা দেশে তৈরি ১৫টি মডেলের ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ কম্পিউটার বাজারে এনেছি। এর মধ্যে রয়েছে নয়টি মডেলের ল্যাপটপ এবং ছয়টি মডেলের ডেস্কটপ। এছাড়া দেশে তৈরি দুই মডেলের মনিটর আমরা বাজারে ছেড়েছি।

প্রশ্ন: গ্রাহক পর্যায়ে ওয়ালটন কম্পিউটার কেমন সাড়া পাচ্ছে?

মো. লিয়াকত আলী: বেশ ভালো। কারণ ওয়ালটন পণ্য উচ্চমানের, কিন্তু দামে সাশ্রয়ী। আমরা ইন্টেল, মাইক্রোসফট এবং বিজয় বাংলার সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে ল্যাপটপ তৈরি করছি। তবে দেশেই যে ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ কম্পিউটারের মতো উচ্চ প্রযুক্তিপণ্য তৈরি করা সম্ভব, এটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য ছিল। এছাড়া দেশীয় পণ্যের প্রতি মানুষের আস্থা অর্জনে একটু সময় লাগে। এর আগে আমরা দেখেছি ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত ইলেকট্রনিকস পণ্য যেমন টিভি, ফ্রিজ, এসি কেনা নিয়ে মানুষ দ্বিধায় ভুগত। কিন্তু এখন দেশে তৈরি এসব পণ্যে মানুষের আস্থা এতটাই বেড়েছে যে, অনেকে বিদেশে তৈরি পণ্যের গায়েও ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লিখে চালাতে চায়। এটা সম্ভব হয়েছে দেশে তৈরি পণ্যের গুণগত মানের কারণে। সেজন্য দেশে তৈরি ল্যাপটপ ও কম্পিউটারে ক্রেতাদের আস্থা আসতে একটু সময় লাগছে। তারপরও খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা ক্রেতাদের কাছ থেকে যে সাড়া পাচ্ছি, তা এক কথায় অসাধারণ। ক্রেতাদের এ আস্থা ও বিশ্বাস আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। আমাদের ওয়ালটন ব্র্যান্ডের অন্যান্য ইলেকট্রনিকসের মতো ডেস্কটপ, ল্যাপটপসহ অন্যান্য ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত প্রযুক্তিপণ্যও শিগগিরই মানুষের মন জয় করবে।

প্রশ্ন: ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত কম্পিউটারের বিক্রয়োত্তর সেবা নিয়ে বলুন।

মো. লিয়াকত আলী: দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের মান ও সেবা ওয়ালটনের মূল স্ট্র্যাটেজি। দেশে তৈরি পণ্যের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিতে আমরা শতভাগ আন্তরিক। একই সঙ্গে ক্রেতাদের সর্বোত্তম বিক্রয়োত্তর সেবা দিতেও বদ্ধপরিকর। ওয়ালটন পণ্যের সুবিধা হলো, যেকোনো সমস্যায় খুব দ্রুত সার্ভিস পাওয়া যায়। এসব পণ্যের যন্ত্রাংশেরও পর্যাপ্ত জোগান থাকে। দেশব্যাপী ওয়ালটনের ৭০টির বেশি সার্ভিস সেন্টার রয়েছে। চলতি বছর এ সংখ্যা ১০০-তে উন্নীত হবে। এর ফলে গ্রাহকরা আরো দ্রুত ও সহজে বিক্রয়োত্তর সেবা পাবেন।

প্রশ্ন: এরই মধ্যে ল্যাপটপ রফতানি কার্যক্রম শুরু করেছে ওয়ালটন। কয়টি দেশে কত ইউনিট রফতানি হচ্ছে?

মো. লিয়াকত আলী: গত মাসে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়শীল দেশের পথে উত্তরণ ঘটেছে বাংলাদেশের। একই সঙ্গে ল্যাপটপ কম্পিউটার উৎপাদক থেকে রফতানিকারক দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারে প্রবেশ করেছে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত ওয়ালটন ল্যাপটপ। বর্তমানে বাংলাদেশে তৈরি ওয়ালটন ল্যাপটপ যাচ্ছে নাইজেরিয়ায়, নেপাল ও পূর্ব তিমুরে। প্রতি মাসে রফতানি হচ্ছে ৫০০ ইউনিট ল্যাপটপ। এছাড়া বেশকিছু দেশের সঙ্গে ল্যাপটপ রফতানির বিষয়ে আমাদের আলোচনা চলছে। শিগগিরই আরো কয়েকটি দেশে বাংলাদেশে তৈরি ল্যাপটপ রফতানির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে পারব বলে আশা করছি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশকে কম্পিউটার উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় যুক্ত করেছে ওয়ালটন। আগামীতে কম্পিউটার রফতানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে কোন পর্যায়ে দেখতে চান?

মো. লিয়াকত আলী: এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়, ওয়ালটন ল্যাপটপ রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশে তৈরি প্রযুক্তিপণ্য বিশ্ববাজারে প্রবেশ করেছে। আমরা স্বপ্ন দেখছি দেশের বাজারে শীর্ষে থাকার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ওয়ালটনের তৈরি ল্যাপটপ কম্পিউটার সবার পছন্দের শীর্ষে থাকবে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প যেভাবে আমরা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পেরেছি, সেভাবে হার্ডওয়্যার শিল্পেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারব। অবশ্যই আমরা স্বপ্ন দেখি একদিন কম্পিউটিং হার্ডওয়্যার রফতানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে ১ নম্বর স্থান দখলে নেবে।

সৌজন্যে: দৈনিক বণিক বার্তা

আরও পড়ুনঃ 

আগামী পাঁচ বছরের রূপরেখা চূড়ান্ত করেছি: রাহেল আহমেদ