উচ্চ মধ্যবিত্তের মাঝে জনপ্রিয় করতে পারলে শক্তিশালী হবে পুঁজিবাজার

Posted on January 11, 2022

হেলাল সাজওয়াল: দেশের পুঁজিবাজার এখন একটি আলোচিত সেক্টর। নানা কারনে অনেক বার আলোচনায় উঠে আসে শেয়ার বাজার। তবে ইতিবাচক আলোচনা এবারেই বেশী দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে সর্বস্ব হারানোর ঘটনা বিস্তর। বেশী আলোচিত ঘটনার মধ্যে ১৯৯৬ সালের শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি অন্যতম। এরপর এধরনের ঘটনা আরও ঘটেছে তবে একসাথে এতো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। যদিও শেয়ার বাজার সেই অনাস্থা থেকে আজও বেড়িয়ে আসতে পারেনি।
উল্লেখ্য ১৯৯৬সালে শেয়ারবাজার কেলেংকারী বাংলাদেশের একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা, যার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কারসাজির দ্বারা শেয়ারের দাম বাড়ার পরবর্তীতে বাজারের পতন শুরু হয় এবং এর ফলশ্রুতিতে দেশের পূজিবাজারে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয় ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
অর্ধশত বছরের এ দীর্ঘ পথপরিক্রমায় দেশের পুঁজিবাজার আজও মাথা উচু করতে পারেনি। সংশ্লিষ্টদের মতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো আমরা আমাদের পুঁজিবাজারকে সার্বজনীন করতে পারিনি। বাজার বিশ্লেষক এবং পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট সকলের একই কথা আমাদের পুঁজিবাজার যতটা আধুনিকায়ন দরকার ছিলো সেখান থেকে আমরা অনেক পেছনে রয়ে গেছি।
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে পুঁজিবাজারকে লাভজনক এবং বিরাজমান করতে পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সাধারনের মাঝে বন্টন করা সহজ হবে।
সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এর এক মত বিনিময় সভার প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম বলেন, ‘যেকোনো দেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের বড় জায়গা পুঁজিবাজার। কিন্তু আমাদের দেশে ঠিক উল্টো। উদ্যোক্তারা সবাই ব্যাংকনির্ভর। ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিচ্ছে। এর মাধ্যমে ব্যাংক খাতে একধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। শেয়ারবাজারে কোনো কোম্পানি আসা মানে, ওই কোম্পানির করপোরেট সুশাসনের আওতায় চলে আসা। এতে বড় সুবিধা হচ্ছে, কোম্পানিতে পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠে।’
এদিকে পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানির সংকট রয়েছে জানিয়ে প্রাইম শেয়ারের অধিকার এনটাইটেলমেন্ট সার্টিফিকেট (টিআরইসি) ধারকদের ট্র্রেড করার প্ল্যাটফর্ম ডিবিএ নেতারা পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে মানসম্পন্ন কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন। সম্প্রতি পুঁজিবাজারে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন পুঁজিবাজার সাংবাদিক ফোরামের (সিএমজেএফ) নবনির্বাচিত কমিটিকে অভিনন্দন জানানোর সময় তারা এ কথা বলেন।
এ সময় ডিবিএ সভাপতি বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বিভিন্ন সিকিউরিটিজ বিধিমালা সংস্কারসহ বিভিন্নভাবে প্রশংসনীয় কাজ করছে। তবে এসব কাজের সুবিধা পেতে হলে ভালো শেয়ারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বিএসইসি সহ সকল স্টেকহোল্ডারদের এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে। একই সময় সিনিয়র সহ-সভাপতি সাজেদুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে তারা সিএমজেএফ-এর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবেন।
ডিবিএর ভাইস-প্রেসিডেন্ট মোঃ সাইফুদ্দিন বলেন, গ্রামীণফোনের পর গত এক দশকে কোনো উল্লেখযোগ্য কোম্পানি বাজারে আসেনি। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের তথ্য জানতে চাইলে ২০/২৫টির বেশি কোম্পানির নাম বলা যাবে না। বাজারের গভীরতা বাড়াতে ইউনিলিভার, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড এবং মেটলাইফ(আলিকো)সহ আরও বহুজাতিক কোম্পানিগুলিকে বাজারে আনতে কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন বলেন তিনি। এছাড়া দেশের পুঁজিবাজারের আরও উন্নয়েনে একসঙ্গে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ)।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক মিজানুর রহমান এফসিএস বলেন, সবাই যখন ভাবছে পুঁজিবাজারকে সামনে নিয়ে যাওয়া দরকার আরও নতুন কোম্পানি দরকার এ ব্যাপারে আমিও একমত, তবে একটি বিষয়ের প্রতি আমাদের সকলের গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো কর্পোরেট গভর্নেস যেনো সঠিকভাবে পরিপালিত হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কেননা কর্পোরেট গভর্নেস কোড সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে কর্পোরেট সু শাষন প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি আরও বলেন প্রয়োজনে ঐসব কোম্পানি সমুহ এসইসি’র আওতায় নিয়ে পরিচালনা করতে হবে, যারা কোম্পানিতে সু শাষন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হবে তাদের জন্য সামগ্রীক বাজারকে কলুষিত হতে দিলে সকল উদ্যোগ বিফলে যাবে। ব্যর্থ হয়ে যাবে সব প্রচেষ্টা। এসইসিকে এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে মনে রেখে কাজ করতে হবে। তবেই সম্ভব হবে একটি উন্নত পুঁজিবাজার গড়ে তোলা।
শেয়ার বাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ কর্পোরেট সংবাদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনার সময় বলেন, শেয়ার বাজারকে উচ্চ মধ্যবিত্তের মাঝে জনপ্রিয় করতে পারলে আমরা একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার সৃষ্টি করতে পারবো। তবে বর্তমান বাজার নিয়ে তাদের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। আবু আহমেদ বলেন যারা টাকা ব্যাংকে জমা রাখছেন বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র কিনছেন এমনকি অনেক মানুষ টাকা নিয়ে বসে আছেন তারা বিনিয়োগের কোন ক্ষেত্র পাচ্ছেন না। এই শ্রেনীর লোকেদের কাছে যদি একটি নিশ্চিত মুনাফার সচ্ছ শেয়ার বাজার উপস্থাপন করা যায় তবে শেয়ার বাজারের পরিধি আরও বিস্তৃত হবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে যে ধোয়াশা চলছে এ ধোয়াশা দুর করতে হলে সরকারকে যে কাজটি করতে হবে তা হলো মানুষের আয় বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। এর জন্য পুঁজিবাজার একটি বিশাল ভুমিকা রাখতে পারে যদি পুঁজিবাজারকে বিনিয়োগের জন্য আস্থার জায়গা হিসেবে প্রস্তুত করা যায় এবং কর্পোরেট দূর্ণীতি রোধ করে প্রতিটি কোম্পানিকে লাভজনক করে সুষম বন্টন নিশ্চিত করা যায় তবে।
আর এজন্য দরকার সরকারের পদক্ষেপ; তবে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর বিরোধ মীমাংসা সংক্রান্ত এমন পদক্ষেপ নয় বরং কেমন করে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে অর্ন্তভুক্ত করা যায় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সরকার যদি তার সাফল্য জনগনের দোরগোড়ায় পৌছাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে একঘাটে পানি খাওয়াতে হবে, মীমাংসার প্রশ্ন কেন? সরকারের নীতি নির্ধারক যারা আছেন আমার মনে হয় তারা এ বিষয়টি ভাবছেন না যে, সরকারের অর্জিত সাফল্য দেশের মানুষের মধ্যে পৌছে দিতে এবং অর্জিত অর্থনৈতিক সুফল সমবন্টন করে, আয় বৈষম্য কমিয়ে একটি সতস্ফুর্ত সমাজ নির্মানে পুঁজি বাজারের ভুমিকা অন্যতম।