দূষণ রোধে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়

Posted on December 21, 2019

পরিবেশের বিভিন্ন ধরনের দূষণ জীবনযাপনের নিত্যদিনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পলিথিন-প্লাস্টিক দূষণ, আলোদূষণ, দৃশ্যদূষণ, মাটিদূষণ, বর্জ্যদূষণ ও পানিদূষণে অতিষ্ঠ নগরবাসী। ঢাকাবাসীর জীবনে দূষণকে সাধারণ সংস্কৃতির অংশ বললেও অত্যুক্তি হবে না! নীতিনির্ধারক থেকে সাধারণ নগরবাসী দূষণ নিয়ে যেন কারোরই কোনো বিকার নেই। ঢাকা শহর এখন দূষণের শীর্ষে অবস্থান করছে। রাজধানী ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। কমবেশি সবাই বায়ুদূষণের শিকার। শীত তথা শুষ্ক মৌসুমে বায়ুদূষণ যেন সীমা ছাড়িয়ে যায়। ঢাকা কেন্দ্রীক বসবাস, ব্যবসা বানিজ্য গড়ে ওঠলেও শহরটার বাসযোগ্যতার কথা কেউ ভাবেন না।

শিল্প-কারখানার বর্জ্য, পলিথিন ও মানববর্জ্যরে দূষণে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশপাশের অন্যান্য নদ-নদীর পানি দূষিত কালো বর্ন ধারণ করেছে।নেই নদ-নদী খাল-বিল রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের কোন জোড়ালো পদক্ষেপ। পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার ‘নিষিদ্ধ’ করা হলেও এর জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি বরং বেড়েছে। অবশ্য পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ও কাগজের ব্যাগ সহজলভ্য না করার কারণে পলিথিন দূষণ থামানো যাচ্ছে না। তাই এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে আরো  কঠোর হতে হবে।

বিশ্বের অন্যতম বায়ুদূষণের শহর মেগাসিটি ঢাকা। বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি এক তথ্যমতে, বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে বছরে ক্ষতি হয় প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা। আর দূষণের কারণে ২০১৫ সালেই শহরাঞ্চলে মারা গেছে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। ২০১৫ সালেই রাজধানী ঢাকায় শুধু বায়ুদূষণে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে শহরের শিশুদের একটা বড় অংশ বায়ুদূষণের শিকার। বায়ুদূষণে শিশুর বিকাশ ও মেধা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মূলত বায়ুতে ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম বা পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫-এর পরিমাণ যত বেশি; সে শহর তত বেশি দূষণে জর্জরিত (যদিও পিএম ২.৫-এর মাত্রা ২০-এর বেশি হওয়া উচিত নয়)। তথ্যমতে, ২০১৫ সালে রাজধানীতে ‘পিএম ২.৫’-এর গড় ছিল ৮১ মাইক্রোগ্রাম। যতই দিন যাচ্ছে ঢাকার বাতাসে ‘পিএম ২.৫’-এর দূষণ বাড়ছে। এ ব্যাপারে দূষণমুক্ত জ্বালানি এবং সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে ইটভাটার আধুনিকায়ন ও পোড়া ইটের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার বাড়াতে হবে। শিল্প-কারখানা ও যানবাহনের দূষণ রোধে আধুনিক প্রযুক্তি এবং পরিবেশবান্ধব গণপরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ‘বিধিমালা-২০০৬’ যেন থেকেও নেই। বাস্তবে এই আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে! রাজধানী ঢাকায় শব্দদূষণ দিন দিন বেড়েই ছলছে। ঢাকা শহরে স্থানভেদে সহনীয় মাত্রার চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে। শব্দদূষণ ঠেকাতে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে হবে। মাটি ও পানিদূষণেও শহরবাসীকে ভুগতে হচ্ছে। পানিতেও ভেজাল। নিরাপদ পানি পাওয়া এ শহরবাসীর জন্য এক চ্যালেঞ্জ! বর্জ্য তথা ময়লা-আবর্জনার দূষণ এ শহরে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আধুনিক ও টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় ময়লা-আবর্জনা রাস্তাঘাটের চারপাশ দখল করে নিচ্ছে।ঢাকার রাস্তাঘাট যেন ময়লার ভাগারে পরিণত হচ্ছে। এ শহরটাকে পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত করে গড়ে তোলার দায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সবার।

যেখানে সেখানে সব ধরনের বর্জ্য একসঙ্গে না রেখে নির্দিষ্ট স্থানে  আলাদা আলাদা করে রাখলে পরবর্তীতে তা সংগ্রহ করে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ, আঠা, সার ও অন্যান্য বিকল্প অনেক কিছু তৈরি করা সম্ভব।কিন্তু  দিনের পর দিন এভাবে পরিবেশ দূষণ করতে করতে আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদেরই অসুস্থ পরিবেশে ঠেলে দিচ্ছি।পরিবেশ ধ্বংস করতে করতে এমন একটা সময় আসবে, যখন থাকবে শুধু অপরিকল্পিত উন্নয়ন, দূষণ, রোগগ্রস্ত জীবন তখন আর কোনো কিছুর বিনিময়ে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা ও সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব হবে না!

ইপিএর প্রতিবেদন অনুসারে, পরিবেশ দূষণ রোধে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০ দেশের মধ্যে ১৭৯তম। তথ্যমতে, প্রতি বছর কালো ধোঁয়ায় সৃষ্ট শ্বাসকষ্টসহ অসংক্রামক রোগে প্রায় ৮৫ হাজার লোক মারা যাচ্ছে। কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) বিবেচনা করা হচ্ছে না! এককথায়, পরিবেশ বিপর্যয়ে সার্বিক অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। দূষণের কারণে শিশুসহ সব বয়সির স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দূষণ বন্ধে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়ার এখনই সময়। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ (সংশোধনীসহ), পরিবেশ আদালত আইন-২০১০, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন-২০১৭, পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৬, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬, চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা-২০০৮, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ (সংশোধনীসহ), জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন-২০১০, মোটরযান আইন-১৯৪০, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫, পণ্যে পাটজাত পণ্যের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন-২০১৩ ইত্যাদি আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় না! পরিবেশ আইনের প্রয়োগ হলে জনসাধারণের মধ্যে যেমন সচেতনতা তৈরি হবে, তেমনি পরিবেশও রক্ষা পাবে। তাই দূষণ রোধে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়।