কদমবুসি আল্লাহর ওলীদের রেওয়াজ এবং এটি সুন্নত

Posted on June 27, 2024

মৌলভী মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।। ইদানিং কালে সবার মাঝে ছড়িয়ে পরেছে পায়েধরে সালাম করা বা কদমবুসি করা হারাম। ছোটকাল থেকে আমাদের ঘরে পায়ে ধরে সালাম করার নিয়ম। আজকাল এই নিয়মটির বিরুদ্ধে অনেকেই নানা রকম যুক্তি উপস্থপান করে থাকেন। বেদাত থেকে শুরু করে হারাম পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। পায়ে ধরে সালাম জানানো ইসলামে জায়েজ নয়, বলে ফতোয়াবাজি করে থাকেন অনেকেই। এরি মধ্যে আরেকটি বিষয় মাথা চারা দিয়ে উঠে তা হলো পায়ে ধরে সালাম বা কদমবুসি করা শিরক। মা বাবা বা মুরুব্বি বা শিক্ষক কে সালাম করলে নাকি আল্লাহ উনার সাথে শিরক করা হয়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয় ,সালাম করার সময় মাথা নিচু হয়ে যায় আর আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারো কাছে মাথা নত বা সেজদা করা যাবে না। জ্ঞানি মাত্রতো বুঝেই সাথে পাগল ও বিশ্বাস করে আল্লাহ ব্যতিত অন্য কাউকে ইবাদতের উদ্যেশে সেজদা দেওয়া হারাম তো বটেই এবং শিরকি কাজ। কিন্তু খাস সুন্নাত কদমবুসির সাথে গুলিয়ে ফেলা হয় সেজদা কে।

ছোটবেলা থেকেই জেনে আসছি, মা বাবা কে সম্মানের খাতিরে সালাম করতে হবে। এই ক্ষেত্রে মায়ের অধীকার তো আরো বেশি, কারণ মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত। এখন বেহেস্ত যেহেতু মায়ের পায়ের নিচে তাহলে বেহেস্ত খোঁজ তো মায়ের পায়ের নিচেই করতে হবে। কিন্তু আজকাল সেই মায়ের সম্মান টুকুও উঠিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন ফতুয়ার ধাক্কাতে। কদমবুসি বা পায়ে চুম্মন করা শিরক তো নয়ই বরং খাস সুন্নাত এর অন্তর ভুক্ত।

কদমবুসি ফার্সি শব্দ। কদম অর্থ পা আর বুচি অর্থ চুম্বন। অর্থাৎ বুযুর্গানে কেরাম, সম্মানী বাক্তিবর্গ, মা বাবা, উস্তাদ ও আপন মুর্শিদকে সম্মান ও তাজিমের সহিত পায়ে চুম্বন করাকেই বলে কদমবুচি। তবে সর্বসাধারণের জন্য ইহা প্রযোজ্য নয়। আর মাথা নত হওয়া মানেই সিজদাহ হয়না। সিজদাহর জন্য শর্ত হলো ৮ টি অঙ্গ প্রতঙ্গ মাটিতে লাগাতে হবে।

যথা : ২ হাতের তালু, ২ হাটু, ২ পায়ের আঙ্গুল, কপাল ও নাক। এর মধ্যে বিনা ওজর ছাড়া একটি বাদ পড়লে সিজদাহ হবেনা। অতএব মাথা নত মানেই সিজদাহ নয়। প্রত্যেক কাজের আমল নির্ভর করে নিয়্যাতের উপর। (বুখারী শরীফ, নাসাই শরীফ)।

হাদিসের দৃষ্টিতে কদমবুসি :
১নং হাদীস :
عن الوازع بن عامر (رض) قال: قّدِمْنَ فَقِيْلَ ذَاكَ رسول الله (ص) فَاَخَذْنَا بِيَدِهِ وَ رِجْلَيْهِ نُقَبِّلَهَا (بخاري/الأدب المفرد/باب تقبيل الرجل/٤٤٦)
অর্থ: ওয়াযি’ ইবনে আমের (রা:) বলেন, আমি একদা রাসুল (সা:) এর দরবারে গিয়ে হাজীর হলাম, আমাকে বলা হল ইনিই হলেন আল্লাহর রাসুল। আমরা তখন তাহার হস্তদ্বয় ও পদদ্বয় ধরে চুমু খেলাম। (ইমাম বুখারি, আল-আদাবুল মুফরাদ, অনুচ্ছেদ ৪৪৬, (তাক্ববিলুর রিজল), কদমবুছি বা পদচুম্বন) (৪)

২ নং হাদিস:
ِعن ذكوان عن صهيب قال رَأيْتُ عَلِيًّا يُقْبَلُ يَدَ اْلعَبَّاسِ وَرِجْلَيْه
অর্থ: হযরত যাকওয়ান রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হযরত ছুহাইব রদ্বিয়াল্লাহু আনহ হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুকে (স্বীয় চাচা) হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহ’র হাত ও পা যুগল চুম্বন করতে দেখেছি। (ইমাম বুখারি, আল-আদাবুল মুফরাদ, অনুচ্ছেদ ৯৮৮, (তাক্ববিলুর রিজল), কদমবুচি বা পদচুম্বন। এবং মিশকাত শরিফ।) (৫)

৩নং হাদিস:
عن زارع وكان فى وفد عبد القيس قال لما قدمنا المدينة وجعلنا نتبادر من رواحلنا فنقبل يد رسول الله صلى الله عليه وسلم ورجله
অর্থ: হযরত যারেঈ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ যিনি আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তিনি বলেন, আমরা যখন মদীনা শরীফে আগমন করলাম তখন আমাদের বাহন হতে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম এবং রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাত ও পা মোবারক চুম্বন করলাম। (আবূ দাউদ, হাদিস নং ৫২২৪, ৩য় খন্ড, ৪ নং অধ্যায়। (৬)

৪নং হাদিস:
عن صفوان بن عسال ان قوما من اليهود قبلوا يد النبى صلى الله عليه وسلم ورجله
অর্থ: হযরত ছাফওয়ান বিন আসসাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই ইয়াহুদীদের একটি গোত্র হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র হাত ও পা মোবারক চুম্বন করেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩৭০৫, ৫ম খন্ড, ১৬ নং অধ্যায়, পৃ: ৩২। (৭)

৫নং হাদীস:
হযরত বুরাইদা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-
سأل أعربى النبى صلى الله عليه وسلم أية فقال له قل لتلك الشجرة رسول الله صلى الله عليه وسلم يدعوك فقال فمالت الشجرة عن يمينها وشمالها وبين يديها وخلفها فقطعت عروقها ثم جاءت يتخذ الارض تجر عروقها مغبرة حتى وقعت بين يدى رسول الله صلى الله عليه وسلم ثم قال له السلام عليك يا رسول الله قال الاعرابى مرها فلترجع الى منبتها فرجعت فدلت عروقها فاستوت فقال الاعربى ائذن لى اسجد لك قال لو أمرت احدا ان يسجد لاحد لامرت المرأة ان
تسجد لزوجها قال فأذن لى ان اقبل يديك ورجليك فاذن له
অর্থাৎ, একজন বেদুঈন হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র কাছে মুজিযা দেখতে চাইল, হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেদুঈনকে এরশাদ করলেন ওই বৃক্ষটাকে বলো আল্লাহর রসূল তোমাকে ডাকছেন, সে যখন বললো বৃক্ষ তার ডানে-বামে, সম্মুখে পেছনে ঝুকল তখন ওটার শিকড়গুলো ভেঙ্গে গেল। তারপর তা মাটি খোদাই করে শিকড়গুলো টেনে বালি উড়িয়ে হুজুর এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র সম্মুখে এসে দাড়াল এবং বলল আস্‌সালামু আলায়কা ইয়া রাসূলাল্লাহ! বেদুঈন বললো “আপনি তাকে আদেশ করুন যেন এটা ওখানে (উৎপত্তিস্থল) ফিরে যায়” তাঁর নির্দেশে ওটা ফিরে গেল এবং তার শেকড়গুলোর উপর গিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। বেদুঈন বললো “আমাকে অনুমতি দিন আমি আপনাকে সিজদা করবো” তিনি এরশাদ করলেন, “যদি কাউকে সাজদাহ করার হুকুম দিতাম তাহলে স্ত্রীকে আদেশ দিতাম সে যেন তার স্বামীকে সাজদাহ করে।” বেদুঈন লোকটি আরজ করলো “হুযুর তাহলে আমাকে আপনার হস্ত ও পদদ্বয় মোবারক চুম্বন করার অনুমতি দিন” তিনি (নবীজী দঃ) তাকে অনুমতি প্রদান করলেন। (শিফা শরিফ) তিরমিযি, কিতাবুল আদাব, হাদিস নং ৩১৫৫, অধ্যায় ১৮। আহমদ ১৮৮১৪. (৮)

৬ নং হাদীস :
روى عن النبى صلى الله عليه وسلم كان يقبل فاطمة ويقول اجد منها ريح الجنة وقبل ابو بكر رأس عائشة وقال النبى صلى الله عليه وسلم من قبل رجل امه فكان قبل عنبة الجنة
অর্থ: হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, হযরত ফাতেমা (নবীজীর স্নেহের কন্যা) রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহাকে চুমু খেতেন আর তিনি বলতেন আমি ফাতেমা রদ্বিয়াল্লাহু আনহার কাছ থেকে বেহেশতের সুঘ্রান পাচ্ছি। হয়রত আবু বকর রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হযরত আয়েশা রদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহার মাথা মোবারক এ চুমু খেয়েছেন। আর প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- যে ব্যক্তি তার মায়ের পা চুম্বন করবে সে যেন বেহেশতের চৌকট চুমু খেল। (আবু দাউদ মাধ্যমে মাবসুত লিস সারাখছি, খন্ড-১০, পৃষ্ঠা: ১৪৯। (৯)

৭ নং হাসিদ :
ﻋﻦ ﻭﺍﺯﻉ ﺑﻦ ﺯﺍﺭﻉ ﺭﺿﻴﺎﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﻋﻦ ﺟﺪﻫﺎ ﻭﻛﺎﻥ ﻓﻲ ﻭﻓﺪ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻘﻴﺲ ﻗﺎﻝ ﻟﻤﺎ ﻗﺬﻣﻨﺎ ﺍﻟﻤﺪﻳﻨﺔ ﻓﺠﻌﻠﻨﺎ
ﻧﺘﺒﺎﺩﺭ ﻣﻦ ﺭﻭﺍﺣﻠﻨﺎ ﻓﻨﻘﺒﻞ ﻳﺪ ﺭﺳﻮﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭ ﺳﻠﻢ ﻭ ﺭﺟﻠﻪ
অর্থ : হযরত ওয়াজে ইবনে যারে উনার দাদা হতে বর্ননা করেন, আর তিনি ছিলেন আব্দুল কায়েস গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। তিনি বলেন , আমরা যখন মদীনা শরীফে আসতাম, তখন আমরা আমাদের সাওয়ারী হতে তাড়াতাড়ি অবতরন করে হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হাত এবং পা মুবারকে চুম্বন করতাম।”

কদমবুসির শরয়ী অনুমোদনে ফোক্বাহায়ে কেরাম ও মুহাদ্দিসীনে ই’জামদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য :
(১): রদ্দুল মোহতার গ্রন্থকার বলেন-
قال الامام العينى بعد كلام فعلم اباحة تقبيل اليد والرجل والرأس كما علم من احاديث المتقدمة اباحتها على الجبهة وعلى العينين و على وجه المبرة والكرام
অর্থ: আল্লামা আইনী বলেন দীর্ঘ আলোচনায় প্রমাণিত হলো যে, হাত চুম্বন, কদমবুচি, মাথা বুচি ইত্যাদির বৈধতা প্রমানিত হলো। যেভাবে বর্ণিত হাদীস হতে কপালে, দুই চোখের মাঝে চুমু দেয়ার বৈধতা প্রমাণিত হল, তবে এ সকল ক্ষেত্রে চুম্বন তখন জায়েয যখন সম্মান ও বরকত হাসিল উদ্দেশ্য হয়। (১০)

(২): বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফতহুল বারী’ এর মধ্যে আল্লামা ইবনে হাজর আল আসকালানী (রহ:) বলেন,
والحديث يدل على جواز تقبيل اليد والرجل -وقال الابهرى انما كرهها مالك اذا كانت على التعظيم والتكبر واما اذا كانت على وجه التقرب الى الله تعالى لدينه اولعلمه او لشرافته فان ذالك جائز-
অর্থ: (তিনি বলেন) হাদীস শরীফ দ্বারা হাতবুচি ও কদমবুচির বৈধতা ও অনুমোদন প্রমাণিত তবে ইমাম মালেক ও ইমাম আবহারী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আনহুমা এগুলিকে মাকরুহ বলেছেন এই শর্তে যে যদি তা বড়ত্ব/আহমিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য হয়। কিন্তু যদি আল্লাহ তা’য়ালার নেকট্যবান বান্দা বা জ্ঞানগত সম্মান ও মর্যাদার কারনে হয় তাহলে উহা নি:সন্দেহে জায়েয এবং উত্তম । (১১)

(৩) বুখারী শরীফে মুকাদ্দামায় আল্লামা আহমদ আলী সাহারানপুরী (রাহ:)বর্ণনা করেন-
قال جاء مسلم بن الحجاج الى البخارى فقبل بين عينيه وقال دعنى اقبل رجليك يا استاذ الاستاذين ويا سيد المحدثين ويا طبيب الحديث فى علله –
অর্থ: একদা হযরত ইমাম মুসলিম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি হযরত ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সাক্ষাৎ পানে ধন্য হওয়ার জন্য আগমন করে ইমাম বুখারীর উভয় চোখের মাঝখানে চুম্বন করলেন, অত:পর তিনি ইমাম বুখারীকে সম্বোধন করে বললেন, হে শিক্ষককূল শিরমণি! মূহাদ্দিসগণের সম্রাট ও হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার কারনসমূহ অনুসন্ধানে ডাক্তারের ভূমিকা পালনকারী সম্মানিত ও পবিত্র সত্ত্বা, আমাকে একটু মেহেরবানী করে আপনার পদযুগল চুম্বন করে ধন্য হওয়ার সুযোগ দিন। (মুকাদ্দামাতু সহিহীল বুখারী)। (১২)

(৪). পাক ভারত উপমহাদেশের সর্বজন স্বীকৃত অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস শায়খ আব্দুল হক মহাদ্দিসে দেহলভীর অভিমতঃ
قال الشيخ عبد الحق المحدث الدهلوى: وفى هذا الحديث دليل على جواز تقبيل الرجل –
অর্থ: হযরত শায়খ এ দেহলভী (রহ:) বিশিষ্ট সাহাবী হযরত জারে (রা:) কর্তৃক বর্ণিত কদমবুচি অনুমোদিত হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, (মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি চিত্তে) বুর্জগানে দ্বীন ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের পদযুগল চুমু দেয়ার বৈধতা অত্র হাদীস দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত।

(৫) কদমবুছী সম্পর্কে হাফিজে হাদীস আল্লামা কাজী আয়াজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং হাফিজে হাদীস আল্লামা নববী রহমাতুল্লাহি আলাইহি স্বস্ব কিতাবে একখানা বিশুদ্ধ হাদীস শরীফ বর্ননা করেন–
ﻋﻦ ﺑﺮﻳﺪﺓ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﻗﺎﻝ ﻓﺎﺀﺫﻥ ﻟﻲ ﺍﻗﺒﻞ ﻳﺪﻳﻚ ﻭﺭﺟﻠﻴﻚ – ﻓﺎﺫﻥ ﻟﻪ ﺍﻱ ﻓﻲ ﺗﻘﺒﻴﻞ ﻳﺪﻳﻪ ﻭﺭﺟﻠﻴﻪ-
ﻓﻘﺒﻠﻬﻤﺎ
অর্থ: হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্নিত, তিনি বলেন, (গাছের সিজদা দেয়ার ঘটনার পর) আমি হুজুর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! আমাকে আপনার উভয় হাত এবং পা মুবারক বুছা বা চুম্বন দেয়ার অনুমতি দিন। তখন উনাকে উভয় হাত এবং পা মুবারক চুম্বন দেয়ার অর্থাৎ কদমবুছী করার অনুমতি দেয়া হলে, তিনি হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হাত এবং কদম মুবারক চুম্বন করলেন।”

হযরত আল্লামা ইমাম আইনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
قال الامام العينى بعد كلام فعلم اباحة تقبيل اليد والرجل والرأس كما علم من احاديث المتقدمة اباحتها على الجبهة وعلى العينين وعلى الشفتين على وجه المبرة والكرام
অর্থাৎ, আল্লামা আইনী বলেন দীর্ঘ আলোচনার পরে হাত চুম্বন, কদমবুচি, মাথা বুচি, ও ইত্যাদির বৈধতা প্রমানিত হলো। যেভাবে বর্ণিত হাদীস হতে কপালে, দুই চোখের মাঝে, দু’ঠোটের উপরে চুমু দেয়ার বৈধতা প্রমাণিত হল, তবে এ সকল ক্ষেত্রে চুম্বন তখন জায়েয যখন সম্মান ও বরকত হাসিল উদ্দেশ্য হয়। — রদ্দুল মোখতার, খন্ড-৬, পৃষ্ঠা- ৩৮০।

মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন
لا يكره التقبيل لزهد وعلم وكبرسن -قال النبوى رحمةالله تعالى عليه تقبيل اليد للغير ان كان لعلمه وصيانته وزهده وديانته ونحو ذالك من الامر الدينيه لم يكره بل يستحب
অর্থাৎ, তিনি বলেন, চুমু দেয়া মাকরুহ হবেনা যখন তা কোন পরহেজগারিতা, ইলম বা জ্ঞান ও বয়োযষ্ঠের কারনে হবে। ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হাত চুম্বন, যদি ব্যক্তির জ্ঞানগত মার্যাদা, খোদা ভীরুতা ও ধামির্কতা ইত্যাদি কারনে হয় তাহলে মাকরুহ তো হবে না; বরং মুস্তাহাব বা উত্তম আমল হিসেবে বিবেচিত হবে। — মিরকাত, খন্ড ৯ম, পৃঃ ৭৬।

বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফতহুল বারী’ এর মধ্যে আল্লামা ইবনে হাজর আল আসকালানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
والحديث يدل على جواز تقبيل اليد والرجل -وقال الابهرى انما كرهها مالك اذا كانت على التعظيم والتكبر واما اذا كانت على وجه التقرب الى الله تعالى لدينه اولعلمه او لشرافته فان ذالك جائز-
অর্থাৎ, (তিনি বলেন) হাদীস শরীফ দ্বারা হাতবুচি ও কদমবুচির বৈধতা ও অনুমোদন প্রমাণিত। তবে ইমাম মালেক ও ইমাম আবহারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুমা এগুলিকে মাকরুহ বলেছেন যদি বড়ত্ব আহমিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য হয়। কিন্তু যদি আল্লাহ তা’য়ালার নৈকট্যবান বান্দা বা জ্ঞানগত সম্মান ও মর্যাদার কারনে হয় তাহলে উহা নি:সন্দেহে জায়েয। — ফতহুল বারী শরহে বুখারী, খন্ড- ১১তম, পৃ: ৫৭

কদমবুসি সম্পর্কে দেওবন্দীদের অভিমত :
১) মৌলভী রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী
وفی الفتاویٰ رشیدیہ: سوال:کسی شخص کے لئے تعظیم کو کھڑا ہو جانا اور پاوں پکڑنا اور چومنا تعظیما درست ہے یا نہیں؟ جواب: برائے تعظیم دینداروں کے لئے کھڑا ہونا درست ہے اور پاوں چومنا اس جیسی شخص کا بھی درست ثابت ہے۔
অর্থ, দেওবন্দি মৌলভী রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী তার রচিত “ফতুয়ায়ে রশিদিয়ার” মধ্যে প্রশ্নোত্তরে বলেন- প্রশ্ন: কোন ব্যক্তির সম্মানে দাড়ানো বা তাকে কদমবুচি করা বৈধ কিনা ?উত্তর: দ্বীনদার ব্যক্তির সম্মানে দাড়ানো ও তাদের পায়ে চুমু খাওয়া বৈধ এবং তা হাদীসে রসূল দ্বারা প্রমাণিত। — ফতুয়ায়ে রশিদিয়া

২) দেওবন্দী মুফতি শফির অভিমত
حضرت شیخ محمد عابد سندھی نے اپنی رسالہ میں تحریر فرمایا کہ تعظیم و تکریم کیلئے دست بوسی یا قدم بوسی صرف ان لوگوں کی جائز ہے جو عالم صالح یا سلطان عادل ہویا کوئی دینی شرف و بزرگی رکھتا ہو۔
অর্থ- তিনি বলেন, হযরত শায়খ মুহাম্মদ আবেদ সিনদী বলেছেন, তাকওয়াবান আলেম, ন্যায়পরায়ন বাদশা, ধর্মীয় দৃষ্টিতে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী শুধুমাত্র এমন লোকদের হাত ও পা চুম্বন করা জায়েয। — জাওহারুল ফিকহ: খন্ড ১, পৃ: ১৮৫

৩) এমদাদুল ফতোয়া কিতাবের ভাষ্য মতে
پس صحیح جواز تقبیل قدم فی نفسہ ہے اور فقہاء کی منع عارض مفسد۔
অর্থ- কদমবুচি মূলত একটি জায়েয আমল। তবে দিক বিবেচনা করে তা নিষেধ করেছেন। — জাওহারুল ফিকহ, খন্ড ৫, পৃ: ৪৫

৪) এমদাদুল আহকাম গ্রন্থে আছে-
عالم،والدین کہ تقبیل ید ورجل جائز ہے مگر انحناء مثل رکوع حرام ہے۔
অর্থ, আলেম, পিতা-মাতা ইত্যাদির হাত ও পায়ে চুম্বন করা জায়েয, কিন্তু রুকুর উদ্দেশ্য মাতা ঝুকানো হারাম। — এমদাদুল আহকাম: খন্ড, ১ম পৃ: ৩৫ পৃষ্ঠা।

৫) ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া গ্রন্থে আছেঃ
جو شخص واجب الاکرم ہو اس کی قدم بوسی کے اجازت ہیں لیکن اعتقاد میں غلو نہ ہو اور سجدہ کی ھیّت نہ ہوئی پائی۔
অর্থ, যে ব্যক্তি সম্মানের পাত্র তার কদমবুচি করা বৈধ। তবে ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং সেজদার মত হবেনা। — ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া: খন্ড-১ পৃষ্ঠা: ১৭৫

৬) মৌলভী আশরাফ আলী থানভীর অভিমত
اس حدیث پہ بھی معلوم ہوا ہے یہ جو محبین کے عادت ہے کہ پیر کے ہاتھ کو یا پیشانی وغیرہ کو بوسہ دیتے ہیں اسکا بھی کچھ حرج نہیں البتہ اذن شرعی سے تجاوز نہ چاہئے۔
অর্থ, তিনি “আওাকাশুফ” গ্রন্থের একটি হাদীস উদ্ধৃত করে বলেন, এই হাদীসের জ্ঞাতব্য মূল কথা হল- পীরের প্রায় মুরীদগণের অভ্যাস হল স্বীয় পীরের হাত, পা ও কপালে চুম্বন করা। সুতরাং এতে কোন অসুবিধা নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে এ ক্ষেত্রে শরয়ী হুকুমের কোন ব্যাত্যয় যাতে না ঘটে। — আত্তাকাশুফ।

হযরত খাজা মাঈনুদ্দীন চিশতী (রহ)-ও কদমবুসি করতে্নঃ
একবার খাজা সাহেব সে সময়ের বড় বুজুর্গ হযরত ওসমান হারুনী (রহ)-এর সাথে দেখা করতে এলেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে খাজা সাহেবের মনে অনেক ভক্তি তৈরী হলো। তিনি ওসমান হারুনী (রহ)-কে কদমবুসি করলেন।

এই সম্পর্কে যারা সন্দিহান, তাঁদেরকে হাটহাজারী মাদ্রাসার মাওলানা সৈয়দ মোঃ মিজানুর রহমান সম্পাদিত 'গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মাঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ)' নামক বইয়ের ১৩৪-নং পৃষ্ঠা পড়ার আহবান থাকলো।

বিশুদ্ধ হাদীস শরীফ, সাহাবায়ে কেরামের আমল ও বিশ্ব বরেন্য ওলামায়ে কেরাম-এর অভিমত ও আমল দ্বারা প্রমাণিত যে, হাত ও কদমবুসি শুধু জায়েযই নয়’ বরং সুন্নাত।

কদমবুসি সার্বজনীনভাবে সবাইকে নয় বরং মুত্তাকি পরহেজগার বুজুর্গ লোকদের বিশেষ করে মা- বাবা, শিক্ষকমন্ডলী, পীর-মাশায়েখ, বুজুর্গানে দ্বীনকে করা বৈধ ও উত্তম একটি সুন্নাতী আমল। এতে শ্রদ্ধা, সম্প্রীতি, স্নেহ, মমতা ও ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। তবে এ ক্ষেত্রে জেনে রাখা জরুরী যে, পুরুষ ও মহিলাগণ পরষ্পর যাদের সামনে বের হওয়া জায়েয নয় তাদের দস্তবুছি বা কদমবুছি করাও জায়েয নয়।

লেখক: মৌলভী মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ভুইয়া, শিবপুরী আল-ক্বাদলী-চিশতী, আল-নক্সবন্দী-মোজাদ্দেদী-ওয়াইসী পরিচালক, বিশ্ব আশেকান মজলিস পাক দরবার শরীফ দুলালপুর, শিবপুর, নরসিংদী।