প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সচিবের সম্পর্ক ‘বিশ্বাস ও সততার’: মোহাম্মদ আলী বোস্তামী এফসিএস

Posted on October 2, 2017

একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিভাগ-প্রধানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও’র সফলতা। সিইও সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেশি হয়। খুশি হন শেয়ারহোল্ডাররা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সিইও’র সুনাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব, চিফ মার্কেটিং অফিসারসহ এইচআর প্রধানরা থাকেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। টপ ম্যানেজমেন্টের বড় অংশ হলেও তারা আলোচনার বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। অন্তর্মুখী এসব কর্মকর্তা সব সময় কেবল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন।এসব বিষয় নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন এবার সিয়াম সিটি সিমেন্ট (বাংলাদেশ) লিমিটেডের (পূর্ববর্তী নাম সিমেক্স সিমেন্ট) মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক ও কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আলী বোস্তামী এফসিএস।

মোহাম্মদ আলী বোস্তামী সিয়াম এফসিএস সিটি সিমেন্ট (বাংলাদেশ) লিমিটেডের (পূর্ববর্তী নাম সিমেক্স সিমেন্ট) মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক ও কোম্পানি সচিব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্নের পর কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। পরে সম্পন্ন করেছেন চার্টার্ড সেক্রেটারি পেশাগত ডিগ্রি। তিনি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশের (আইসিএসবি) একজন সম্মানিত ফেলো

প্রশ্ন: ক্যারিয়ারের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই

মোহাম্মদ আলী বোস্তামী: ক্যারিয়ার শুরু করি গ্রামীণ টেলিকমে (গ্রামীণ ব্যাংকের একটি প্রতিষ্ঠান) সহকারী কোম্পানি সচিব হিসেবে। প্রায় পাঁচ বছর কাজ করার পর কোম্পানি সচিব হিসেবে গ্রামীণফোন আইটি লিমিটেডে যোগ দিই। ওই প্রতিষ্ঠানে প্রায় পাঁচ বছর কাজ করার পর হোলসিম সিমেন্ট (বাংলাদেশ) লিমিটেডে কোম্পানি সচিব হিসেবে দায়িত্ব বুঝে নিই। এরপর ২০১৭ সাল থেকে সিয়াম সিটি সিমেন্ট (বাংলাদেশ) লিমিটেডে মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক ও কোম্পানি সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।

প্রশ্ন: পেশা হিসেবে কোম্পানি সচিবকে কেন বেছে নিলেন?

মোহাম্মদ আলী বোস্তামী: আমরা যখন স্কুলে পড়ি, তখনই সাধারণত পরিবারের কেউ না কেউ ক্যারিয়ারের দিকনির্দেশনা দেন। সে ধারায় আমার বাবা ও মেজো মামা আমাকে ক্যারিয়ারের দিকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। ইচ্ছা ছিল প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করবো। তাই ম্যানেজমেন্টে বিবিএ সম্পন্নের পর পেশাগত ডিগ্রি নিতে আগ্রহী হই। তখন চার্টার্ড সেক্রেটারি ডিগ্রি সম্পর্কে জানতে পারি এবং ভর্তিও হই। এরপর সচিব পেশার নানা কার্যক্রম ও চ্যালেঞ্জ ভালো লেগে যায়। একই সঙ্গে ম্যানেজমেন্ট টিমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক কাজ করার বিষয়টি আমার বেশ ভালো লাগে।

প্রশ্ন: প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোম্পানি সচিবের সম্পর্ক কেমন?

মোহাম্মদ আলী বোস্তামী: প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সচিবের সম্পর্ক বিশ্বাস আর সততার। কারণ কোম্পানি সচিবের কাছে প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকে। সঙ্গত কারণেই বিশ্বাস ও সততার সম্পর্ক তৈরি হয়। সাধারণত কোম্পানি সচিব প্রতিষ্ঠানের একজন কমপ্লায়েন্স অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পরিচালনা পর্ষদ ও ম্যানেজমেন্টের মধ্যে তথ্য-উপাত্ত ও ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেন। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠান ও শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে সেতুবন্ধনকারী। এখানে পরিচালনা পর্ষদ, ম্যানেজমেন্ট ও শেয়ারহোল্ডার সবার কাজের পরিধি ও দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। কেবল একটি ক্ষেত্রে সবার উদ্দেশ্য এক। তা হলো প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পনা অনুযায়ী সাফল্য এনে দেওয়া। সবার মধ্যে সমন্বয়কারীর ভুমিকা পালন করে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন দক্ষ কোম্পানি সচিব।

প্রশ্ন: প্রতিষ্ঠানে একজন সচিবের ভুমিকা গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে চাই

মোহাম্মদ আলী বোস্তামী: অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন কোম্পানি সচিব। কমপ্লায়েন্স ও গভর্নেন্সনির্ভর প্রতিষ্ঠানের জন্য কোম্পানি সচিব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ। প্রতিষ্ঠানে কমপ্লায়েন্স সঠিকভাবে কমপ্লাই না করা হলে সে প্রতিষ্ঠান কখনও সম্মানজনকভাবে টিকে থাকতে পারে না। কোম্পানি সচিব আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় কমপ্লায়েন্স কমপ্লাই করে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেন। ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নসহ নানা কাজে সহযোগিতা করে থাকেন তিনি। প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারিয়েল কাজ, কমপ্লায়েন্স, করপোরেট গভর্নেন্স, করপোরেট অ্যাফেয়ার্স প্রভৃতি কাজের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের সব বিভাগের সঙ্গে তাকে কাজ করতে হয় এবং বিভিন্ন বিভাগের কার্যক্রম সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক।

প্রশ্ন: প্রতিষ্ঠানে একজন সচিবের জন্য চ্যালেঞ্জিং বিষয় কী?

মোহাম্মদ আলী বোস্তামী: কোম্পানি সচিবকে কাজ করতে হয় শেয়ারহোল্ডার, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পর্ষদ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে। সবার প্রত্যাশা সমান কিংবা এক নয়। এমন অবস্থা কোম্পানি সচিবকে সব সময় পর্যবেক্ষণ করতে হয়। প্রতিষ্ঠানকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ব্যবস্থাপনা পর্ষদকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করতে হয়। একটি ভুল সিদ্ধান্ত ভয়ানক বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে।

সব প্রতিষ্ঠান সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করতে চায়। সেক্ষেত্রে শুধু একটি নন কমপ্লায়েন্সও প্রতিষ্ঠানে বিপর্যয় এনে দিতে পারে। তাই কোম্পানি সচিবকে সার্বক্ষণিক সচেতন থাকতে হয়। তিনি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি ও গ্রুপ নির্দেশনা মেনে ব্যবসা বিস্তারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সঠিক কাজের জন্য সঠিক ব্যক্তি নির্বাচন করার পাশাপাশি তার মধ্যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগ্রহ তৈরি করাও চ্যালেঞ্জের।

প্রশ্ন: একই সঙ্গে কোম্পানি সচিব মানবসম্পদ পরিচালক দুই পেশাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

মোহাম্মদ আলী বোস্তামী: মানুষকে বোঝা, তাদের সঙ্গে চলাফেরা, প্রতিদিন শেখা, কাউন্সিল, গঠনমূলক সমালোচনা করা প্রভৃতি আমার ভালো লাগে। আমার মনে হয়েছে, মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান হিসেবে ব্যবসায় ভ‚মিকা রাখতে পারব। তাই কোম্পানি সচিবের পাশাপাশি মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছি। এ দুটি পেশার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে তথা ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। আমি এ চ্যালেঞ্জ বেশ উপভোগ করছি। পেশা হিসেবে কোম্পানি সচিব অনেক সম্মানজনক একটা পেশা। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ আছে এখানে। অন্যদিকে মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান হিসেবে ওই নেতৃত্বের লক্ষ্য প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়াটা অপেক্ষাকৃত সহজ। কোম্পানি সচিব জানেন, একটি কোম্পানির আগামী দিনের লক্ষ্যমাত্রা কী। একই ব্যক্তি যখন মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্বে থাকেন, তিনি বুঝবেন কীভাবে কর্মী ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন কার্যক্রম নিলে প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যতে ভালো হবে। তিনি বুঝবেন, পাঁচ বছর পর কোন ধরনের নেতৃত্ব প্রয়োজন। সেভাবেই পরিকল্পনা করবেন তিনি। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা জরুরি। সে সঙ্গে সবাইকে নিয়ে একত্রে বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করার জন্য এ দুটি পদের সমন্বয় করতে পারলে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য পাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ।

প্রশ্ন: দায়িত্ব পালনে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখতে আপনার মূলমন্ত্র কী?

প্রশ্ন: সুসম্পর্ক ধরে রাখতে প্রথম যে বিষয়টি আসে তা হলো সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা। দ্বিতীয়ত, কেউ কোনো ভুল করলে বা কারও কোনো বিষয়ে সংশোধনের প্রয়োজন মনে করলে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলা। আড়ালে কারও সমালোচনা না করে সরাসরি তার সঙ্গে সুন্দর করে আলোচনা, মিটিংয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করা। আমি মনে করি, একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি। অন্যের কথা আগে ভালোভাবে শুনতে হবে, তারপর নিজের বক্তব্য তুলে ধরা উচিত।

প্রশ্ন: যারা পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে ইচ্ছুক, তাদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী?

মোহাম্মদ আলী বোস্তামী: তাদের স্বাগত জানাই। সবার উদ্দেশে বলতে চাই এই পেশা বেছে নেওয়ার আগে পেশার মৌলিকত্ব বুঝতে হবে। পেশার প্রতি আসক্তি থাকতে হবে। শুধু শেখার জন্য যদি কেউ এ পেশায় আসতে চান, তাহলে আসতে পারেন; এখানে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু শেখার আছে যা অন্য কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু পেশা হিসেবে নিতে চাইলে নিজেকে প্রশ্ন করুন এ পেশা আপনার জন্য উপযুক্ত কি না? আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুত কি না। এ পেশায় আপনি আনন্দ পাবেন কি না।

দায়িত্ব পালনের সময় অনেক সমস্যার মুখোমুখি হবেন, যার সমাধান কোনো বইয়ে পড়ে আসেননি। বুদ্ধিমত্তা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে সে সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রয়োজনে অন্যের সাহায্য নিতে হবে। দায়িত্ব পালনে সতর্ক থাকতে হবে। অন্যথায় চাকরিই করে যাবেন; কিন্তু অধরা থেকে যাবে সাফল্য। কিছু ফরমাল কাজ করার জন্য এ পেশা নয়। একটু কঠিন করে বলবো ক্লারিক্যাল কাজের জন্য কোম্পানি সচিব পেশা নয়। যাদের ব্যবসা সম্পর্কে আগ্রহ আছে, ব্যবসা বুঝতে চান, ব্যবসায় ভূমিকা রাখতে চান তারা এ পেশায় ভালো করবেন।

মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা থেকে নতুনদের জন্য কিছু বলতে চাই। আমরা অনেক বেশি গুগল ও ফেসবুককেন্দ্রিক হয়ে গেছি। যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য গুগলে সার্চ করে দেখে নিই। অনেক সময় দিই ফেসবুকে; এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু জীবনের স্বাদ তো প্রযুক্তি দিয়ে উপভোগ করা যায় না। এমন জীবনধারা ঠিকও নয়। মনে হয়, বই পড়াটা আমাদের নতুন প্রজন্ম ভুলেই যাচ্ছে। ই-বুক পাঠও মন্দের ভালো।

আমাদের যুবকদের আরেকটি সমস্যা হলো তাদের স্বপ্ন থাকে সম্মানজনক (সিক্স ডিজিট) বেতন, গাড়ি ও একটি ফ্ল্যাট। এটুকু কোনো যুবকের স্বপ্ন হতে পারে না। তারুণ্যের শক্তি ও ক্ষমতার কাছে এটা খুবই সামান্য। এই ধ্যান-ধারণা থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিত। স্থানীয়ভাবে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা দরকার। উদ্যোক্তা হওয়া জরুরি। প্রথমে জ্ঞানার্জন ও অভিজ্ঞতা অর্জন করুন। নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখার অভ্যাস করুন। যতদিন চাকরি করবেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে চিন্তা করুন ও সততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিন। একদিন নিজে কিছু করুন, কিছু মানুষের কর্মসংস্থান করুন; কিছু পরিবারের দায়িত্ব নিন। প্রসঙ্গত, পরিবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কখনও কখনও করপোরেট লিডাররা বিষয়টি উপেক্ষা করেন। নিজের শখ, পরিবারের জন্য সময় দেওয়া আপনার নিজের জন্যই প্রয়োজন।

প্রশ্ন: সফল কোম্পানি সচিব হতে হলে আপনার পরামর্শ কী?

মোহাম্মদ আলী বোস্তামী: আনন্দের সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে। উপযুক্ত শিক্ষা ও সততা থাকতে হবে। ব্যবসা সম্পর্কে জানার আগ্রহ থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসার উন্নয়নে ভুমিকা রাখার ইচ্ছা থাকতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মানসিকতা থাকতে হবে। পরিশ্রমী হতে হবে। নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে। সূত্র: শেয়ার বিজ