১০ বছর পর চাল নিয়ে সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। উৎপাদন কম হওয়ায় বাজারে প্রধান এই খাদ্যপণ্যের দাম উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে আমদানি করছে, সেখানেও দাম বেড়েছে। আগামী মে মাস নাগাদ বোরো মৌসুমের চাল বাজারে না আসা পর্যন্ত চালের বাজারে স্বস্তি ফেরার আশা দেখা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে চালের বাজার নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কাজী সাহাবউদ্দিন, যিনি ১৯৯৮ সালে বন্যার পর দেশে খাদ্যসংকটকালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন।
প্রশ্ন: দেশে প্রতিবছর আশ্বিন-কার্তিক মাসে চালের দাম কিছুটা বাড়ে। কিন্তু এ বছর অনেক আগে থেকেই দাম বাড়ছে। এটা কেন হলো বলে আপনার মনে হয়?
কাজী সাহাবউদ্দিন: এটা হয়েছে হাওরে ফসলের ক্ষতি ও পরবর্তী বন্যায়। গত বোরো মৌসুমে প্রায় ২০ লাখ টন চাল কম উৎপাদিত হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। চালের দাম মে মাস থেকেই বাড়তে শুরু করে। তখনই যদি সরকার থেকে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে আজকের পরিস্থিতি তৈরি না-ও হতে পারত। কারণ তখন আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কম ছিল। এরপর কিন্তু সরকারের মজুত একেবারে কমে গেল। সাধারণত দেখা যায়, সরকারের মজুত কমে গেলে খোলাবাজারে চালের দাম বেড়ে যায়। বেসরকারি খাত কিন্তু জানে, সরকারের মজুত কত। কিন্তু বেসরকারি খাতে মজুত কত, তা কিন্তু সরকারের অজানা। যদিও ২০১৩ সালে একটি আইন করা হয়, বেসরকারি খাতে মজুত কত, সে হিসাব তারা প্রতি মাসে দেবে। কিন্তু সেটা বাস্তবায়িত হয়নি।
প্রশ্ন: চাল এখন বেশি আসছে মূলত ভারত থেকে। এ দেশের মানুষের খাওয়ার উপযোগী সেদ্ধ চাল কেনার উৎস কোন কোন দেশ হতে পারে?
কাজী সাহাবউদ্দিন: সব দিক বিবেচনায় ভারতই আমাদের জন্য উপযোগী। ওই দেশ থেকে দ্রুত আমদানি করা যায়। কিন্তু ভারত তো চালের দাম বাড়িয়ে দিল। আবার শুনছি, তারা আড়াই মাস রপ্তানি বন্ধ রাখবে। যদিও এর সত্যতা আমি জানি না।
প্রশ্ন:এ রকম একটি চিঠি বেনাপোল বন্দরে ব্যবসায়ীদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এটি ঠিক না। ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করেনি।
কাজী সাহাবউদ্দিন: ভারতের তো রপ্তানি করার কোনো বাধা নেই, তাদের তো মজুত বেশ ভালো। তবে ভারত অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে। আমরা শুল্ক কমালাম, কিন্তু তারা দাম বাড়িয়ে দিল। এতে চালের দামে যে প্রভাব পড়ার কথা, সেটি পড়েনি।
প্রশ্ন: ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে কি চাল আমদানি সম্ভব?
কাজী সাহাবউদ্দিন: এটা তো ভারত সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের আমদানি না, আমদানি করছে বেসরকারি খাত। রপ্তানি করছেন ভারতের ব্যবসায়ীরা।
প্রশ্ন: ভারত সরকার বাংলাদেশের কাছে প্রতি টন চালের দাম ৬০০ ডলার চাইছে, যা অন্যান্য দেশে ৪৫০ ডলার। এটা কি রপ্তানি না করার এক ধরনের মূল্যগত বাধা?
কাজী সাহাবউদ্দিন: ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। কিন্তু এর প্রতিফলন আমরা খুব বেশি দেখি না। যেমন তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এখনো হয়নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও আমরা ভারতের যে সমর্থন আশা করেছিলাম, তা-ও পাইনি। চীনও বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে সমর্থন দেয়নি।
প্রশ্ন:চালের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এখন কী করা উচিত?
কাজী সাহাবউদ্দিন: বেসরকারি চালকল মালিকদের গুদামে অভিযান চালালে পরিস্থিতি হিতে বিপরীত হতে পারে। এতে বাজার আরও অস্থিতিশীল হবে। আমাদের আমদানি করে মজুত বাড়াতে হবে, সেটা যত দ্রুত সম্ভব। এরপর খোলাবাজারে চাল বিক্রি কর্মসূচি (ওএমএস) চালু করতে হবে এবং তা বেশ বড় আকারে। বেসরকারি খাতকে আমদানির যথেষ্ট প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতকে সঙ্গে নিয়েই এ ধাক্কা সামলাতে হবে। কারণ সরকারের পক্ষে এটা সামলানো কঠিন।
এখন আমরা একটা সংকটে পড়ে গেছি। এ সংকট কাটাতে হবে আপৎকালীন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। যত উৎস আছে, সেখান থেকে আমদানি করতে হবে। যত কৌশল আছে, তা ব্যবহার করতে হবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে চালের সংকট তৈরি হলো ১০ বছর পর। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংকটকালে দেখা গেল, চাল পাওয়া যাচ্ছে না। এখন আবার বাংলাদেশ আমদানি শুরুর পর দাম বেড়ে গেল।
কাজী সাহাবউদ্দিন: সাধারণত আমাদের চালের ঘাটতি থাকে না। বন্যা বা খরার কারণে উৎপাদন কম হলে ঘাটতি হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ বছর বাংলাদেশে উৎপাদন কম হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বের আটটি দেশে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে ওই সব দেশে দাম বেড়েছে। এসব দেশে ঘাটতি না হলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ত না। ২০০৮ ও ২০০৯ সালেও এমন হয়েছিল। তখন তো ভারত রপ্তানি বন্ধই ঘোষণা করেছিল। দাম উঠেছিল টনপ্রতি ১ হাজার ডলার। আমরা একটি সংকটের দিকে যাচ্ছি, এখন আমাদের বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানি করতে হবে, সেটা যত দামই হোক। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বেশ ভালোই আছে। তাই আমদানি করতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
প্রশ্ন: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মাসিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে সতর্কবার্তা দেওয়া হলো, এটা আসলে কী বোঝাচ্ছে?
কাজী সাহাবউদ্দিন: সরকারের যদি টনক না নড়ে থাকে, তাহলে এ সতর্কবাতার মাধ্যমে নড়বে আশা করা যায়।
প্রশ্ন: গত কয়েক বছর মোটা চালের দাম কমই ছিল। মনে করা হয়, এতে কৃষকেরা ধান চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। হঠাৎ আবার দাম অনেক বেড়ে গিয়ে ভোক্তার ওপর চাপ বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে আপনার মত কী হবে?
কাজী সাহাবউদ্দিন: আসলে চালের দামে একটা ভারসাম্য দরকার। এ ক্ষেত্রে কৃষকের স্বার্থও দেখতে হবে, আবার ভোক্তার কথাও মাথায় রাখতে হবে। বুধবার সংসদে বলা হয়েছে, কেন এত আমদানি হচ্ছে। এতে তো কৃষকদের স্বার্থ ব্যাহত হবে। এতে আমি কিছুটা আশ্চর্য হয়েছি। নিকট-ভবিষ্যতে আমি এ ধরনের কোনো আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছি না। এ বছর কৃষকেরা দাম ভালো পেয়েছে, আগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পেরেছে। এখন ভোক্তাদের দিকে নজর দেওয়ার সময়। আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, ছোট কৃষকেরা কিন্তু চালের ক্রেতাও। ধান ওঠার পর তারা তা বিক্রি করে দেয়, আবার পরে চাল কেনে।
প্রশ্ন:চালের দাম বাড়িয়ে কৃষকদের উৎসাহ দেওয়া হবে, নাকি ধান চাষের উপকরণের মূল্য কমিয়ে উৎপাদন খরচ কম রাখার ব্যবস্থা করা হবে এ দুই কৌশলের কোনটিকে আপনি যৌক্তিক মনে করেন?
কাজী সাহাবউদ্দিন: এ ক্ষেত্রে দুটো কৌশলই ব্যবহার করা দরকার। একদিকে চালের দাম ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়া দরকার, অন্যদিকে উপকরণ খরচও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সরকার সারসহ অন্যান্য উপকরণের কিন্তু ভর্তুকি দিচ্ছে।
প্রশ্ন: বেনাপোল বন্দরে জটের কারণে চাল খালাসে ১৮ থেকে ২০ দিন লাগছে। চট্টগ্রাম বন্দরেও একই অবস্থা। এ ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী হবে?
কাজী সাহাবউদ্দিন: চালের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। বন্দরে জটের কারণে যদি ট্রাক ভাড়া বেড়ে যায়, সেই প্রভাব চালের দামেও পড়ে।
প্রশ্ন:আমাদের আগামী বোরো মৌসুমের চাল বাজারে আসতে তো এপ্রিল-মে মাস লেগে যাবে।
কাজী সাহাবউদ্দিন: এ সময়ে সরকার কীভাবে চালের সংকট সামাল দেয়, সেটাই দেখার বিষয়।
সৌজন্যে: প্রথম আলো
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
চালকলে অভিযানে বাজার অস্থিতিশীল হতে পারে: কাজী সাহাবউদ্দিন https://corporatesangbad.com/97921/ |