একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিভাগ-প্রধানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও’র সফলতা। সিইও সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেশি হয়। খুশি হন শেয়ারহোল্ডাররা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সিইও’র সুনাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব, চিফ মার্কেটিং অফিসারসহ এইচআর প্রধানরা থাকেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। টপ ম্যানেজমেন্টের বড় অংশ হলেও তারা আলোচনার বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। অন্তর্মুখী এসব কর্মকর্তা সব সময় কেবল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। সেসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন ‘টপ ম্যানেজমেন্ট’। একান্ত সাক্ষাৎকারে এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কোম্পানি সচিব অলি কামাল এফসিএস।
প্রশ্ন: ক্যারিয়ারের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই।
অলি কামাল: ২০০২ সালে একটি সিএ ফার্মে অডিট স্টাফ হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করি। পরবর্তী সময়ে ২০০৪ সালে সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডে প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে যোগ দিই। ২০০৬ সালে সেন্ট্রাল হসপিটাল লিমিটেডে কোম্পানি সচিব হিসেবে যোগ দিই। ওই প্রতিষ্ঠানে দুই বছর কাজ করার পর ২০০৮ সালে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডে অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কোম্পানি সচিব হিসেবে কাজ শুরু করি। ২০০৯ সালে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডে অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কোম্পানি সচিব হিসেবে যোগদান করি। এরপর একই প্রতিষ্ঠানে সচিবের পাশাপাশি পদোন্নতি পেয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট,
সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ২০১৭ সাল থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কোম্পানি সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
প্রশ্ন: পেশা হিসেবে কোম্পানি সচিবকে কেন বেছে নিয়েছিলেন?
অলি কামাল: কোম্পানি সচিব হিসেবেই যে নিজের ক্যারিয়ার গড়বো এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। লক্ষ্য ছিল ভালো কিছু করতে হবে। গতানুগতিক ধারার বাইরে সুন্দর একটা ক্যারিয়ার গড়তে হবে। স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে একদিন পত্রিকায় চার্টার্ড সেক্রেটারি (সিএস) ডিগ্রির বিজ্ঞাপন দেখি। মূলত তখন কোম্পানি সচিব পেশা ও সিএস পেশাগত ডিগ্রি সম্পর্কে জানতে পারি। কোর্স সম্পর্কে জানার পর বেশ আগ্রহী হই। ২০০১ সালের মাঝামাঝিতে ভর্তি হয়ে যাই। এরপর কোম্পানি সচিব পেশার দায়িত্ব, কর্তব্য, পদমর্যাদা সম্পর্কে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারি ও এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে মনস্থির করি।
প্রশ্ন: প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একজন সচিবের সম্পর্ক কেমন?
অলি কামাল: প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোম্পানি সচিব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতিষ্ঠানের স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করেন কোম্পানি সচিব। শেয়ারহোল্ডার, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, রেগুলেটরি বডির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, অডিটরের সঙ্গে কাজ করা বিশেষ করে পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে সরাসরি সচিবকে কাজ করতে হয়। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন সচিব। কোম্পানি সচিব প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
প্রশ্ন: প্রতিষ্ঠানে একজন দক্ষ সচিবের ভূমিকা বা গুরুত্ব সম্পর্কে বলুন।
অলি কামাল: পেশা হিসেবে কোম্পানি সচিব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি চলছে কি না তা দেখভাল করতে হয়। বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কি না সেটি দেখা সচিবের দায়িত্ব। তাছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোম্পানি সচিব পদটি বাধ্যতামূলক করেছে। বর্তমানে সারাবিশ্বে গভর্ন্যান্স একটা আলোচিত ইস্যু। সবাই এখন আইনকানুন, গভর্ন্যান্স ও কমপ্লায়েন্স পরিপালনে সচেতন। এসব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে কোম্পানি সচিব থাকা বাধ্যতামূলক করেছে। কোম্পানি সচিবকে প্রতিষ্ঠানে চিফ কমপ্লায়েন্স অফিসার হিসেবে গণ্য করা হয়। একটি প্রতিষ্ঠান কমপ্লায়েন্স কমপ্লাই করছে কি না, আইনকানুন পরিপালন করছে কি না, সবকিছু কোম্পানি সচিব দেখভাল করেন।
এজন্য সচিবকে নির্দিষ্ট কাজে বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন বা দক্ষ হতে হয়। তাকে প্রতিষ্ঠানের সবকিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হয়। ব্যবসা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হয়। ব্যবসা বুঝতে হয়। ব্যবসার উদ্দেশ্য, কীভাবে ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে, ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে হয়। তাই প্রতিষ্ঠানে একজন দক্ষ সচিবের কোনো বিকল্প নেই।
প্রশ্ন: প্রতিষ্ঠানে একজন সচিবের জন্য চ্যালেঞ্জিং বিষয় কী?
অলি কামাল: ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বা পরিচালনা পর্ষদের কোনো সিদ্ধান্তে স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থরক্ষা না হলে কিংবা আইন পরিপন্থি হলে বিষয়টি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বা পরিচালনা পর্ষদকে অবহিত করতে হয়। সিদ্ধান্তটি আইনের পরিপন্থি কি-না, তা সুন্দর ও ইতিবাচকভাবে পর্ষদকে বলাটাই চ্যালেঞ্জের। এছাড়া যুগোপযোগী দক্ষতা অর্জন করার সুযোগটাও একটি চ্যালেঞ্জ।
প্রশ্ন: পেশা হিসেবে কোম্পানি সচিবকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
অলি কামাল: খুবই চ্যালেঞ্জিং পেশা এটি। প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদগুলোর একটি কোম্পানি সচিব। তিনি সরাসরি পরিচালনা পর্ষদকে সহায়তা করেন। প্রতিষ্ঠানের কলাকৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকেন। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা অবস্থান। এখানে থেকে প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে সরাসরি ভূমিকা রাখা যায়। একই অবস্থান থেকে কোঅর্ডিনেটর, চিফ রেগুলেটরি অফিসার, রিপ্রেজেনটিটিভ অব দ্য বোর্ডসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয় কোম্পানি সচিবকে। আবার প্রতিষ্ঠানের বাইরের অনেক আইনকানুন রয়েছে, সেগুলো দেখতে হয়। কোম্পানি সচিব ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করেন। একইসঙ্গে তিনিই প্রতিষ্ঠান ও শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে সেতুবন্ধনকারী। অর্থাৎ কোম্পানি সচিব প্রতিষ্ঠানের সব স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করেন।
প্রশ্ন: ব্যাংকিং সেক্টরে এ পেশাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অলি কামাল: এটি একটা স্পেশাল সেক্টর। এর প্রাইমারি রেগুলেটর হিসেবে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সিকিউরিটিজ আইন ও কোম্পানি আইনের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মনীতি অনুসরণ করে ব্যাংক পরিচালিত হয়। যেহেতু সচিব কোম্পানির আইনকানুন, কমপ্লায়েন্স, গভর্ন্যান্স নিয়ে কাজ করেন, তাই একটু সচেতনতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হয়। আর ব্যাংক যেহেতু অর্থ নিয়ে ব্যবসা করে, অর্থাৎ ট্রাস্টি হিসেবে কাজ করে, তাই সেক্টরটি তুলনামূলক বেশি আইনকানুনের মধ্যে চলে। এজন্য এ সেক্টরে কোম্পানি সচিবের দায়িত্ববোধ বেশি থাকতে হয়।
প্রশ্ন: দায়িত্বপালনে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখতে আপনার মূলমন্ত্র কী?
অলি কামাল: সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সততা। এরপর ভালো ব্যবহার। সর্বোপরি সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখার ইচ্ছা। এর বাইরে থাকে নলেজ শেয়ারিং, অর্থাৎ যা শিখলাম তা কনিষ্ঠ বা সমান্তরাল সহকর্মীর সঙ্গে শেয়ার করা, তাদের কাছ থেকে নতুন কিছু শেখার ইচ্ছা পোষণ করা প্রভৃতি। এভাবে একে অপরকে শেখানো বা শেখার মাধ্যমে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে বলে আমি মনে করি। এছাড়া কর্মস্থলে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়াটাও ইতিবাচক বিষয়।
প্রশ্ন: যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
অলি কামাল: চার্টার্ড সেক্রেটারি ডিগ্রিটি নিয়ন্ত্রণ করে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)। এখানে ভর্তি হয়ে ডিগ্রিটা নিলে সহজে কোম্পানি সচিব হওয়া সম্ভব। এছাড়া অন্য পেশাগত ডিগ্রি, যেমন, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিং, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিং বা এলএলবি ডিগ্রি নিয়েও কোম্পানি সচিব হওয়া যায়। তবে কোম্পানি সচিব হওয়ার জন্য বিশেষ ডিগ্রি হলো চার্টার্ড সেক্রেটারি। এখানে সচিব পেশার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন ও নানা কাজ হাতে-কলমে শেখা যায়।
প্রশ্ন: সফল কোম্পানি সচিব হতে চাইলে আপনার পরামর্শ কী?
অলি কামাল: কোম্পানি সচিব হিসেবে সফল হতে যোগাযোগে দক্ষ হওয়া জরুরি। সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। জ্ঞানস্তর আপডেট রাখতে হবে। বিভিন্ন রেগুলেটরি বডির নিয়মকানুনে যেসব পরিবর্তন হয়, গাইডলাইন, অর্ডার বা নির্দেশনা আসে, সেগুলো সম্মন্ধে আপডেট থাকতে হবে। উপস্থাপনে দক্ষ হতে হবে। সবসময় জ্ঞানার্জনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ধৈর্যশীল আর পরিশ্রমী হতে হবে। প্রযুক্তিগত দক্ষতা একটি অপরিহার্য বিষয়।
সৌজন্যে: দৈনিক শেয়ার বিজ
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কোম্পানি সচিব: অলি কামাল এফসিএস https://corporatesangbad.com/92554/ |