এক দিনে ২৬৩৬৫ কোটি টাকা ধার দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক

Posted on May 26, 2024

কর্পোরেট সংবাদ ডেস্ক: তারল্য সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ধার বাড়ছে। গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৪৯টি ব্যাংক ও তিনটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রায় ২৬ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা ধার করে, যা ধারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর আগে গত ২৭ মার্চ রেকর্ড ২৮ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা ধার দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে আন্তঃব্যাংক কলমানি থেকেও তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর ধার বাড়ছে। বৃহস্পতিবার এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকের ধারের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। মঙ্গলবার এই ধার ছিল তিন হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। সোমবার তিন হাজার ৮৯০ কোটি এবং রোববার দুই হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট দীর্ঘদিন ধরে চলছে। তবে এখন তা আরও প্রকট হচ্ছে। কারণ বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে সংকট, আমানতের ধীরগতি, কিছু শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকের প্রতি আস্থার অভাব, রেকর্ড খেলাপি ঋণ ও ঋণ আদায়ে ধীরগতি রয়েছে। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়িয়েছে, এতে তারল্য সংকট আরও প্রবল হয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার খবরে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ফলে অনেক গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৯ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ধারের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৯২ কোটি টাকা। ২০ মে এই ধার ছিল ১২ হাজার ৭০৮ কোটি এবং ২১ মে ১২ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সম্প্রতি সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর জন্য অর্থ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। কারণ আমানতের হারের চেয়ে দুই শতাংশ বেশি সুদ পাওয়ায় গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছেন। এ কারণে ব্যাংক খাত এখন চরম তারল্য সংকটে ভুগছে।

গত ১২ মে সরকারের ঋণ নেয়ার উপকরণ ট্রেজারি বিলের সুদহার প্রথমবারের মতো ১২ শতাংশে ওঠে। এর আগে ট্রেজারি বিলে সুদের রেকর্ড ছিল ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ। আইএমএফের শর্ত মেনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার বাড়ানো ও বাজারে সুদহার বাজারভিত্তিক করার প্রভাবে সরকারের ঋণের সুদহার এভাবে বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের বিপরীতে গত ১৯ মে চার হাজার ৫৬৯ কোটি ১২ লাখ টাকা ঋণ নেয় সরকার। এর মধ্যে ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলে ১২ শতাংশ সুদে ৩৯৮ কোটি টাকা নিয়েছে। ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলে ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ সুদে সরকার ঋণ নিয়েছে তিন হাজার ৮৩৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আর ১৮২ দিন মেয়াদি বিলে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ সুদে নিয়েছে ৩৩২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। প্রসঙ্গত, ট্রেজারি বন্ডে সুদ ১২ শতাংশের ওপরে আছে। বন্ড হলো দীর্ঘমেয়াদি উপকরণ। সরকারের ঋণের সুদহার বাড়লে ভবিষ্যতে বাজেটের ওপর সুদ পরিশোধের চাপ বাড়বে। বর্তমানে সুদ পরিশোধে পরিচালন বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হয়।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছে ৪৫ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের শেষ দিনের তুলনায় অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ঋণ কমেছে ১৯ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৬৫ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা বেড়েছে।

ব্যাংক থেকে ঋণ বৃদ্ধির প্রবণতার এ সময়ে আমানত তেমন বাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশে। এ প্রবৃদ্ধি গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোনো মাসেই আমানতের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের নিচে নামেনি। ফেব্রুয়ারিতে আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমেছে।

তাছাড়া ব্যাংক খাতে ১০ শতাংশের কম ঋণখেলাপি দেখানো হলেও অনাদায়ী ঋণ ৩০ শতাংশের মতো। এসব ঋণের একটি অংশ বেনামি। এতে টাকার প্রবাহ কমেছে। কয়েক বছর ধরে এ সমস্যা চলতে থাকলেও এখন বড় আকারে দেখা দিয়েছে। আর ডলার সংকট মেটাতে গিয়ে চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা উঠে এসেছে।

সব মিলিয়ে তারল্য সংকটে রয়েছে অনেক ব্যাংক। এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে আশানুরূপ ধার না পেয়ে এখন নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিচ্ছে।

একটি সূত্র জানায়, সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণ করতে পারছে না। আটটি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে তাদের চলতি হিসাবে ঘাটতি নিয়ে চলছে। এসব ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকায়। বেশিরভাগ ব্যাংকের উদ্বৃত্ত থাকলেও সামগ্রিক ঘাটতি ১৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকার মতো। সাধারণভাবে ব্যাংকগুলো সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদের (এসএলআর) অতিরিক্ত বিল ও বন্ড লিয়েন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিতে পারে। তবে কিছু ব্যাংকের কাছে ধার নেয়ার মতো বিল ও বন্ড নেই। টাকা ফেরতের অনিশ্চয়তার কারণে এসব ব্যাংক আন্তঃব্যাংক থেকেও ধার পাচ্ছে না।