ব্যাংকের বাইরে চলে গেছে মোবাইল ব্যাংকিং; আবুল কাশেম মো. শিরিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লি:

Posted on August 5, 2017

সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম ও এটিএম বুথের কারণে অন্যভাবে চেনা যায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংককে। বেসরকারি খাতের এই ব্যাংকের আমানত ২২ হাজার কোটি টাকা ও ঋণ ১৯ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটির শাখার গ্রাহক ৬০ লাখ, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক ১ কোটি ৩০ লাখ ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে ৬ লাখ। সারা দেশের ১৫৭ শাখা, ৫ হাজার এটিএম বুথ ও ৮০০ ফাস্ট ট্র্যাক নিয়ে গ্রাহকসেবা দিচ্ছে ব্যাংকটি। ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন। 

প্রশ্ন: কেমন চলছে ব্যাংক খাত, ঋণ প্রস্তাব কেমন আসছে।

আবুল কাশেম মো. শিরিন: ব্যাংকগুলোর মুনাফা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেও বেশির ভাগ ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে। এ কারণে বলা যায়, ব্যাংকগুলোর ব্যবসা ভালো চলছে। তবে বড় ঋণের চাহিদা কম। যারা করপোরেট গ্রাহক, তাদের তো অনেক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া আছে। এখন যারা কম সুদে ঋণ দিতে পারছে, গ্রাহক সেদিকেই যাচ্ছে। সুদের হার কমাতে অন্য ব্যাংকগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এক অঙ্কে সুদ তো অনেক দিন ধরেই চলছে, এরপর আর কত কমানো যেতে পারে, সেদিকেই সবার নজর। ফলে আমানতের সুদের হারও কমছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমানতকারীরা।

প্রশ্ন: মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের সুদ কম। গ্রাহকেরা কেন ব্যাংকে টাকা রাখবেন?

আবুল কাশেম শিরিন: আমি যদি ১০০ টাকার ঋণে ৯ টাকা সুদ নিই, এ থেকেই বেতন, ভাড়া, পরিষেবা বিলসহ বিভিন্ন খরচ মেটাতে হচ্ছে। অর্থাৎ ৯ টাকার মধ্যে ৪ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে, এরপর আসছে ব্যাংকের মুনাফা। ফলে আমানতকারীকে ৫ টাকাও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য সবাই সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের একটা সীমা থাকায় মানুষ এখনো ব্যাংকে আসছে। এ ছাড়া যারা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করছে, তারা ব্যাংকে টাকা রাখছে। যাদের বেতন হয় ব্যাংকে, তারা টাকা রাখছে। এ আমানতগুলো থাকবেই। তবে সঞ্চয়ের প্রবণতা নিয়ে ব্যাংকে টাকা রাখার পরিমাণ কমে গেছে।

প্রশ্ন: আমানত কমে যাচ্ছে, ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি। ভবিষ্যতে তারল্য সংকট কি তৈরি হবে?

কাশেম শিরিন: ঋণের প্রবৃদ্ধি যদি বেশি হয়, তাহলে ঋণের সুদ হারও বেড়ে যাবে। এতে করে আমানতের সুদ হারও বাড়বে। তখন মানুষের মাঝে আবারও সঞ্চয়ের প্রবণতা বাড়বে। বাজার স্বাভাবিক নিয়মে সংশোধন হয়ে যাবে।

প্রশ্ন: যেসব ঋণ যাচ্ছে তাতে কোন খাতের ঋণের চাহিদা বেশি?

কাশেম শিরিন: নতুন যেসব ঋণ প্রস্তাব আসছে, তার বেশির ভাগই ছোট ছোট ঋণ। বড় করপোরেট গ্রাহকের সব পুরোনো, এক ব্যাংক থেকে তারা অন্য ব্যাংকে আসছে। বড় আকারের শিল্পায়ন না হওয়ায় বড় ঋণের চাহিদাও কম। ঋণ প্রস্তাব যা আসছে সবই ছোট ও মাঝারি আকারের ঋণ। এ ছাড়া ভোক্তা ঋণ তো আছেই। গাড়ি, বাড়ি, ফ্রিজ, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র—এসব ঋণের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। জেলা, উপজেলা পর্যায়ে ছোট ঋণের ভালো চাহিদা আছে। আগে ব্যাংকগুলো এসব গ্রাহককে গুরুত্ব দেয়নি, করপোরেট গ্রাহক নিয়েই ব্যস্ত ছিল। করপোরেট গ্রাহককে সেবা দিতে কম জনবল লাগে, এ জন্য সুদ হারও কম। আর একজন করপোরেট গ্রাহক যে ঋণ নেয়, তা রিটেইল হিসেবে দিতে গেলে ১০০ জন গ্রাহক খুঁজতে হয়। এ জন্য খরচ বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে সুদ হারে।

প্রশ্ন: খেলাপি ঋণ তো বেড়ে যাচ্ছে। দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংকগুলো।

কাশেম শিরিন: ৫০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ কিন্তু সরকারি ৫ ব্যাংকের, এটা খুবই উদ্বেগজনক। খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশ বাকি ব্যাংকগুলোতে, এটা তো বেশি নয়। তবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। অন্য দেশে খেলাপি ১ শতাংশ, আমাদের ১০ শতাংশ। এর মাধ্যমেই পুরো জাতির চিত্র চলে আসে। আমাদের আরও নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সব নিয়ম-আচার মেনে চলতে হবে।

প্রশ্ন: কাগজের ব্যবহার কমে আসছে, তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগও বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক কিছুটা অগ্রগামী, সুবিধাটা কী?

কাশেম শিরিন: আমরা ২০০৪ সাল থেকে তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ শুরু করি। পরিচালকদের উদ্যোগেই আমরা এ খাতে বিনিয়োগ করেছি। তারা চেয়েছে তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যাংকটি এগিয়ে থাকবে। এ জন্য কোনো মুনাফা না পাওয়ার পরও আমরা এটিএমে বিনিয়োগ বাড়িয়ে চলছি। প্রতিবার টাকা তুলতে আমাদের ৪০ টাকা খরচ হয়, কিন্তু আমরা গ্রাহক থেকে কোনো মাশুল আদায় করি না। শুধু কার্ডের জন্য বছরে একটা মাশুল নেওয়া হয়। অন্য ব্যাংকের গ্রাহকেরা আমাদের এটিএম ব্যবহার করছে, ওই ব্যাংক আমাদের ২০ টাকা দেয়, বাকি ২০ টাকা লোকসান দিই আমরা। প্রতিটি এটিএমে মাসে ১ লাখ টাকা খরচ হয়, এতে কোনো আয় নেই। এ কারণে আমাদের মুনাফা কম। এটিএমের কারণে আমরা কম খরচের বেশ কিছু আমানত পেয়েছি, তবে পরিচালনা ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এটিএমে একসময় কম সুদে আমানত পেয়েছিলাম, এখন আর সেই দিন নেই। এভাবে চলতে থাকলে এটিএম, ডিজিটাল ব্যাংকিং কঠিন হয়ে পড়বে। এ কারণে নতুন করে কোনো ব্যাংক এটিএম করছে না। সবাই আমাদের সঙ্গে শেয়ারিং ব্যবসা চালিয়ে আসছে। কারণ, নিজেরা করলে তাদের লোকসান অনেক বেড়ে যাবে। আমাদের অনেক এটিএম হওয়ায় খরচটা একটু কম।

প্রশ্ন: ফাস্ট ট্র্যাক করতে গেলেন কেন?

কাশেম শিরিন: একটি এটিএম বুথে নানা সমস্যা হয়। বাসার ইলেকট্রনিক মেশিনেও সমস্যা হয়। এ ছাড়া এটিএমে টাকা শেষ হতে পারে, টাকা জড়িয়ে যেতে পারে। এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে টাকা আসতে। এতে এটিএম মেশিনগুলোতে অনেক সময় সমস্যা হয়। প্রকৌশলী না আসা পর্যন্ত মেরামত হয় না। ফলে গ্রাহকসেবা বঞ্চিত হয়। এ জন্য আমরা একই জায়গায় একাধিক এটিএম মেশিন বসানোর সিদ্ধান্ত নিই। এ ছাড়া ফাস্ট ট্র্যাকগুলোতে তিন-চারটি এটিএম, ডিপোজিট মেশিন দেওয়া হয়েছে। একজন অফিসার কাজ করছেন। এর মাধ্যমে ব্যাংকের অনেক সেবাই মিলছে এসব ফাস্ট ট্র্যাকে।

প্রশ্ন: ডিজিটাল পদ্ধতিতে কেমন লেনদেন হচ্ছে?

কাশেম শিরিন: প্রতি মাসে চার হাজার কোটি টাকা এটিএমের মাধ্যমে উত্তোলন হয়। মোট উত্তোলনের ৫০ শতাংশই হয় এটিএমে। জমা মেশিনের মাধ্যমে মাসে ৬০০ কোটি টাকা জমা হয়। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে আমাদের ৫০০ জনবল কাজ করছে। এটিএম আমাদের কোনো ব্যবসা নয়, এটা সেবা। এটিএমই ডাচ্-বাংলাকে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে।

প্রশ্ন: আপনারাই প্রথম মোবাইল ব্যাংকিং শুরু করেছিলেন। এ নিয়ে অভিজ্ঞতা কেমন?

কাশেম শিরিন: মোবাইল ব্যাংকিং ছিল ব্যাংকনির্ভর বা ব্যাংক লেড মডেল। এর উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংকের সেবা যেন পায় সবাই। গ্রামগঞ্জের মানুষের জন্য এটা করা হয়েছিল। ব্যাংকের পুরো সেবাই পাবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক। পরিষেবা বিল পরিশোধ করবে এর মাধ্যমে। ব্যাংকিং চেহারা দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এটা ব্যাংকের বাইরে চলে গেছে। কুরিয়ার সার্ভিসের টাকা পাঠানোর মতো হয়ে গেছে মোবাইল ব্যাংকিং। এটা আমাদের একটা খারাপ অভিজ্ঞতা। আমরা চেয়েছিলাম প্রত্যেকের একটা হিসাব থাকবে, নিজস্ব ওয়ালেট থাকবে, তার মাধ্যমে লেনদেন করবে। কিন্তু এটা হয়ে গেল ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) নির্ভর। এজেন্টের মাধ্যমে টাকা লেনদেন হচ্ছে, কে টাকা পাঠাচ্ছে, কে গ্রহণ করছে, তার কোনো চিহ্ন থাকছে না। প্রথমে এটা ছিল স্থানীয় হুন্ডি, পরে আন্তর্জাতিক হুন্ডিতে পরিণত হলো। দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। সব ধরনের অবৈধ অর্থায়ন হচ্ছে। আমাদের বিরাট স্বপ্ন ছিল, সবাই ব্যাংকিং সেবা পাবে। পুরো স্বপ্নই ভেঙে গেছে, স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করা হয়েছে। ব্যাংকের বাইরে চলে যাওয়ায় এ সেবার ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে গেছে। বলা হয়েছিল ব্যাংকভিত্তিক মডেল হবে, কিন্তু আসলেই কি হয়েছে। আমার মোবাইল ব্যাংকিং সেবার রকেট গ্রাহক যেকোনো শাখায় গেলেই সেবা পাচ্ছেন, অন্য প্রতিষ্ঠানের সেবায় তা হচ্ছে না। তাদের সঙ্গে ব্যাংক হিসাবের কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে কে টাকা তুলছে, জমা করছে, তা চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। এতেই অপব্যবহার হচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও শক্তিশালী অবস্থান নিতে হবে। না হলে একদিন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পরিবর্তে এজেন্ট ব্যাংকিং প্রধান হয়ে উঠবে।

সৌজন্যে : প্রথম আলো