ব্যাংকিং খাতে তৈরি হয়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম আর এফ হোসেন। এ বিষয়ে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা, করণীয়, দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি, ব্র্যাক ব্যাংকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।
প্রশ্ন: বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের সার্বিক অবস্থা কেমন?
সেলিম আর এফ হোসেন: ব্যাংকিং খাত থেকে করপোরেট বা কমার্শিয়াল বিনিয়োগ কম হচ্ছে, এটা ঠিক। ৩০ বছর ধরে আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো ঐতিহাসিকভাবে করপোরেট বা কমার্শিয়াল ব্যাংকিংই করে এসেছে। এসএমই ও রিটেইল ব্যাংকিংয়ের প্রতি তেমন কোনো নজর ছিল না। এ ধরনের ব্যাংকিং করা একটু কষ্টকরও বটে। ব্যাংকিং খাতে এখন অতিরিক্ত তারল্য আছে। তাই রিটেইল ব্যাংকিংয়ে বেশি ঝুঁকছে বলে এটা মনে করা ঠিক হবে না, অতিরিক্ত তারল্য আছে বলেই সেটি করা হচ্ছে। রিটেইল ব্যাংকিং হচ্ছে আধুনিক ব্যাংকিংয়ের একটি ধারা। ব্যাংকগুলোও সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এখন ব্যবসায় বা ঋণ বিতরণে বৈচিত্র্য আনছে। করপোরেট বা কমার্শিয়াল খাতে বিনিয়োগ না বাড়ার অন্যতম কারণ কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা। তবে আগের চেয়ে এখন এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে বলে আমরা ঋণের তথ্য থেকে বুঝতে পারছি।
প্রশ্ন: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন এখন ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য এসেছে?
সেলিম আর এফ হোসেন: রিটেইল ব্যাংকিং নতুন ধরনের ব্যাংকিং না হলেও আমাদের দেশে অতীতে এ ধরনের ব্যাংকিংয়ে খুব বেশি নজর দেওয়া হয়নি। গত এক বছরে ব্র্যাক ব্যাংকের সফলতার একটি বড় কারণ এসএমই ও রিটেইল ব্যাংকিংয়ে আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। বর্তমান সময়ে অর্থনীতির জন্য রিটেইল ব্যাংকিং একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পৃথিবীর পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনীতি রিটেইল ইনডেক্স নির্ভর। অনেকে মনে করেন, রিটেইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থনীতির খুব বেশি লাভ হয় না। কিন্তু এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। রিটেইল ব্যাংকিং অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখে।
প্রশ্ন: শিল্প খাতে বিনিয়োগ না বাড়ার পেছনে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কথা বলছিলেন। সেখানে কি ব্যাংক বা আর্থিক খাত বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে পারে না?
সেলিম আর এফ হোসেন: বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবকাঠামোতে বেসরকারি ও আর্থিক খাত থেকে বিনিয়োগ করা হয়। এ জন্য সেসব দেশে উন্নয়ন ব্যাংক, ভেঞ্চার ক্যাপিটালের মতো নানা ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর বাইরে অবকাঠামো খাতে পুঁজিবাজার থেকেও অর্থ জোগান দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে উন্নয়ন ব্যাংক, ভেঞ্চার ক্যাপিটালের মতো বিশেষ ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। আমাদের পুঁজিবাজারটিও এখনো সেভাবে শক্তিশালী ও সুসংগঠিতভাবে গড়ে তোলা হয়নি। ভারত বা অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের শেয়ারবাজার অনেক দুর্বল ও পিছিয়ে রয়েছে। অতীতে আমরা দেখেছি বন্ড ছেড়েও নানা অবকাঠামো প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এখন বন্ড মার্কেটটিও খুব একটা সক্রিয় নয়।
প্রশ্ন: ব্যাংকিং খাতের জন্য এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ কী?
সেলিম আর এফ হোসেন: ব্যাংকিং খাতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম খেলাপি ঋণ। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ আমি মনে করি পরিবর্তনের মানসিকতার অভাব। দীর্ঘদিন ধরে আমরা যে ধারায় ব্যাংকিং করে এসেছি, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত ধারার ব্যাংকিংয়ের বদলে আধুনিক ব্যাংকিং শুরু করতে হলে চিন্তার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সেই চিন্তা বা মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানোও একটি বড় চ্যালেঞ্জ এ খাতের জন্য। আমাদেরও এখন ব্যবসার নতুন নতুন ক্ষেত্র ও পথ খুঁজে বের করতে হবে। তৃতীয় চ্যালেঞ্জটি হলো, প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।
প্রশ্ন: খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা। কেন এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না?
সেলিম আর এফ হোসেন: খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সবার আগে দরকার সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার। সেই সঙ্গে নতুন কিছু আইনকানুন ও বিধিবিধানেরও দরকার হবে। আর্থিক খাতের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আলাদা বিচারিক ব্যবস্থা দরকার। খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে হলে আর্থিক খাত, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সামাজিক সচেতনতা, বিচারিক ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রশ্ন: বড় বড় ঋণ খেলাপির বিরুদ্ধে ব্যাংকগুলোকেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে খুব একটা দেখা যায় না। এটি কেন?
সেলিম আর এফ হোসেন: দেখুন, খেলাপি ঋণ আদায়ে মামলা করা হলে ওই মামলা নিষ্পত্তি হতে এখন ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। তাতে ব্যাংকের কোনো লাভ হয় না। তাই ব্যাংকগুলো মামলার পরিবর্তে বিকল্প উপায়ে যতটা সম্ভব অর্থ আদায়ের উদ্যোগ নেয়। এ ছাড়া আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ও খেলাপিদের জন্য সুবিধাজনক এক অবস্থা তৈরি করেছে।
প্রশ্ন: প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকার কথা বললেন আপনি। কিন্তু আমরা তো সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় প্রযুক্তির হুমকিও দেখলাম। সেই হুমকির বিষয়টি কি তবে অবহেলিত বা উপেক্ষিত ছিল?
সেলিম আর এফ হোসেন: এটা ঠিক, একটা ঘটনা ঘটার পর ওই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ে। আগে যেভাবে আমরা প্রযুক্তিকে ব্যাংকিং খাতে গ্রহণ করেছি তার বিপরীতে ঝুঁকির দিকটিকে হয়তো যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পর এখন সাইবার নিরাপত্তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য ব্যাংকের মতো সাইবার নিরাপত্তায় ব্র্যাক ব্যাংক প্রচুর বিনিয়োগ করছে। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন: শুরুতে আপনি বলছিলেন ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য আছে। এর মধ্যেও আপনারা সর্বোচ্চ ঋণ বিতরণের চেষ্টা করছেন। শিল্পের ক্ষেত্রে কোন খাতে বেশি ঋণ যাচ্ছে এখন?
সেলিম আর এফ হোসেন: সার্বিকভাবে দেখলে ব্যাংকিং খাত থেকে শিল্পে যেসব ঋণ যাচ্ছে তার বড় অংশই যাচ্ছে তৈরি পোশাক ও ওষুধ খাতে। একসময় ট্রেডিংয়ে অনেক ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু সেখানে ব্যাংকের জন্য অভিজ্ঞতাটা মোটেই সুখকর নয়। তাই এখন ট্রেডিংয়ে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে ব্যাংকগুলো।
প্রশ্ন: তার মানে নতুন কোনো সম্ভাবনাময় শিল্প খাতে ব্যাংক অর্থায়ন করছে না। ঘুরেফিরে কয়েকটি খাতেই সীমাবদ্ধ। তাহলে কীভাবে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে?
সেলিম আর এফ হোসেন: ব্যাংকগুলো সাধারণত নতুন কোনো উদ্যোক্তা তৈরি করে না। কাউকে উদ্যোগী হয়ে আগে ব্যবসা শুরু করতে হয়। পরে সেটির গুণমান ও সম্ভাবনা বিচার-বিশ্লেষণ করে ব্যাংক তাতে অর্থায়ন করে। যেকোনো ব্যবসা বা উদ্যোগকে ব্যাংকের অর্থায়ন উপযোগী করে গড়ে তুললে সেখানে ব্যাংক অবশ্যই অর্থায়ন করে বা করছে। ব্র্যাক ব্যাংক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় অর্থায়ন করছে। উত্তরবঙ্গে আমরা ছোট-বড় অনেক চালকলে অর্থায়ন করছি। ভবিষ্যতে আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বেশি বিনিয়োগ করা। আমাদের সাফল্যের সিংহভাগই আমরা সেখান থেকে পেতে চাই। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংককে দেশের সবচেয়ে ভালো ও বড় ব্যাংকে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করছি আমরা।
প্রশ্ন: আমাদের দেশে ব্যাংকিং খাতে কতটা পেশাদারি রয়েছে। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কি আদৌ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে?
সেলিম আর এফ হোসেন: আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে পেশাদারির অভাব রয়েছে। অনেক সময় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে পেশাদারি ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয় না। ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যে আলাদা আলাদা দায়িত্ব রয়েছে, সেটির মধ্যে একধরনের গরমিল হয়ে যাচ্ছে। অথচ ব্যাংকের পর্ষদের দায়িত্ব নীতি গ্রহণ ও পরামর্শ দেওয়া। আর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাজ বাস্তবায়ন। কিন্তু অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, পর্ষদ থেকেই নির্বাহী সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকারদের যখন পেশাদারি ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয় না তখন বিভিন্ন জায়গায় নানা অনিয়ম ঘটতে পারে।
প্রশ্ন: ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য নিয়ে কি আপনারা চিন্তিত?
সেলিম আর এফ হোসেন: ব্যাংকিং খাতে এখন উদ্বৃত্ত তারল্য অনেক। কিন্তু বিনিয়োগের সুযোগ কম। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছেন না। এ কারণে ব্যাংকিং খাতে একধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকাররা পাগলের মতো বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের জন্য ছুটছেন, যা এ খাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। সূত্র: প্রথম আলো।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
সেলিম আর এফ হোসেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড https://corporatesangbad.com/7720/ |