গত ১৩ নভেম্বর সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ ডেসটিনি’র বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ৩১ জুলাই রাজধানী ঢাকার কলাবাগান থানায় দুদকের দায়েরকৃত দু’টি মানি লন্ডারিং মামলায় অভিযুক্ত কারাবন্দি ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল আমীন ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেনের শর্ত সাপেক্ষে জামিন আদেশ বহাল রেখেছেন। জামিনাদেশের শর্তগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, আদেশ প্রদানের ছয় সপ্তাহের মধ্যে ডেসটিনি ট্রি প্ল্যানটেশন (ডিটিপিএল) লিমিটেড'র সারা বাংলাদেশে লাগানো গাছ বিক্রি করে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান বরাবর জমা দিতে হবে অথবা ছয় সপ্তাহের মধ্যে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নগদ জমা সাপেক্ষে জামিন বহাল থাকবে।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আদালত কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গাছ বিক্রি করে টাকা জমা দেয়ার বিষয়ে। আদালতের রায়ের পর ডেসনিটির আইনজীবীরা বান্দরবন জেলায় ডেসটিনির বাগান পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তাঁরা বলছেন, সেখানে ২৬টি বাগানের অনেক গাছ দুর্বৃত্তরা কেটে নিয়েছে গেছে। বাকী যে গাছগুলো আছে সেগুলোও রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে আগাছা জন্মে স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়েছে। আইনজীবী দলের সদস্যরা বলছেন, দুদক ডেসটিনির সকল সম্পত্তি এমন কী বায়নাকৃত সম্পত্তি জব্দ করলেও ট্রি প্ল্যানটেশন বা গাছের বাগান জব্দ করেনি। ফলে বাগানগুলোতে নিরাপত্তা না থাকায় স্থানীয় দুস্কৃতকারীরা ইচ্ছেমত গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। রায় ঘোষণার পর গাছ কাটা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। ফলে গাছের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে।
আইনজীবী পরিদর্শক দলের সাথে কয়েকজন ক্রেতা গিয়েছিলেন সরেজমিনে গাছের অবস্থা দেখতে। বাগানের অবস্থান দুর্গম অঞ্চলে হওয়ায় এবং কাটা গাছ নিয়ে আসার জন্য কোন রাস্তা না থাকায় গাছ ক্রয়ে অনেকেই নিজেদের অপারগতার কথা জানিয়েছেন। এদিকে, যে কয়েকজন ক্রেতা গাছ কিনতে চান তাঁরা ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করতে আগ্রহী। আদালতের নির্দেশে ডেসটিনি গ্রুপের সকল ব্যাংক হিসাব বন্ধ থাকায় সেখানেও সদস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
আদালত ট্রি প্ল্যানটেশনের গাছ বিক্রির দায়িত্ব প্রদান করেছেন ডেসটিনি গ্রুপের সিইও, চাঁদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য ড. মোহাম্মদ শামসুল হক ভূঁইয়াকে। গাছ বিক্রি করে আদালত কর্তৃক নির্ধারিত টাকা সংগ্রহের বিষয়ে সাংসদ শামসুল হকের অভিমত হল, কারো একার পক্ষে এত বড় কাজ শেষ করা কোন ভাবেই সম্ভব না। এজন্য দরকার দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী টিম। আর টিমের সদস্যরা চান প্রয়োজনীয় বেতন ভাতার নিশ্চয়তা। এছাড়াও প্রয়োজন অফিস, আসবাবপত্র, গাড়ি, প্রয়োজনীয় খরচ, যা ব্যাংক হিসাব জব্দ থাকায় মেটানো এমূহুর্তে সম্ভব হচ্ছে না।
ডেসটিনি’র উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গাছ বিক্রির কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে অনীহা প্রকাশ করছেন। তাঁরা বলছেন, আদালত গাছ বিক্রির আদেশ দিলেও ডেসটিনি গ্রুপের কর্মকর্তা তথা গাছ বিক্রির সাথে সম্পৃক্তদের বেতন ভাতাদির বিষয়টি রায়ে উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া গ্রুপের সকল অফিস বন্ধ থাকায় কার্যক্রম পরিচালনায় প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাবেন না বলে তাঁরা জানিয়েছেন। পিয়ন থেকে শুরু করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ দীর্ঘদিন বেতন ভাতা না পাওয়ায় অনেকে চলে গেছেন। আবার যারা আসতে চান, তাঁরাও বেতনের নিশ্চয়তা চাচ্ছেন যা এই মূহুর্তে দেয়া সম্ভব না। ফলে আদালত কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গাছ বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
ডেসটিনির আইনজীবীগণ, গ্রুপের সিইও এবং হাতে গোনা যে কয়েকজন ব্যক্তি গাছ বিক্রির সাথে সংশ্লিষ্ট আছেন, তাঁরা মনে করছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে লাগানো ডেসটিনি’র ট্রি প্ল্যানটেশনের আওতায় লাগানো গাছ বিক্রি করে দুদকে বা আদালতে টাকা জমা দেয়ার ক্ষেত্রে আদালত নির্ধারিত ছয় সপ্তাহ সময় নিতান্তই অপ্রতুল। তাঁদের মতে, স্বল্প সময়ে ক্রেতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, তেমনি যারা সীমিত সংখ্যক গাছ কেনার আগ্রহ দেখাচ্ছেন তারাও সময় স্বল্পতার কথা বলছেন। ক্রেতারা বলছেন, এই স্বল্প সময়ের মধ্যে বৃহৎ এলাকার গাছ ক্রয় করা এবং ক্রয় পরবর্তী সময়ে তা কেটে নিয়ে যাওয়া প্রায়ই অসম্ভব। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আদালত কর্তৃক জামিনের শর্ত হিসেবে নির্ধারিত টাকা জমা দেয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে স্থানীয় পরিবেশবাদীরা বলছেন, ছয় সপ্তাহের মধ্যে ৩৫ লক্ষ গাছ কাটলে পরিবেশ ভারসাম্যহীন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। সেক্ষেত্রে তাঁরা পাহাড়ী এলাকার গাছ কাটার যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে গাছ কাটতে বলছেন। আর সেটা করতে লাগবে পাঁচ থেকে ছয় বছর।
ডেসটিনি’র ৪৫ লক্ষ বিনিয়োগকারী সদস্যরা মোহাম্মদ রফিকুল আমীন ও মোহাম্মদ হোসেনের জামিনাদেশ পাওয়ার খবরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও, জামিনের শর্ত শুনে তাদের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়তে দেখা যায়। কারণ, স্বল্প সময়ের মধ্যে গাছ বিক্রি করে আদালত কর্তৃক নির্ধারিত শর্তের টাকা জমা দেওয়া আদৌও সম্ভব হবে কী-না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ পোষণ করেন তারা। তাছাড়া, ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ দুদক অথবা আদালতে টাকা জমা দিলেও কোন পদ্ধতিতে বিনিয়োগকারীরা টাকা ফেরত পাবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন বলে জানান। তাঁরা এও বলছেন যে, বিনিয়োগকারীদের তথ্য যে সার্ভারে সংরক্ষিত আছে তা এখন বন্ধ আছে। সেটা খোলার ব্যবস্থা না করলে বিনিয়োগকারীদের প্রকৃত তালিকা পাওয়া যাবে না বলে মত তাঁদের। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ডেসটিনি’র বিনিয়োগকারী সদস্যদের প্রায় সবাই বিশ্বাস করেন, ডেসটিনি’র কর্ণধার মুক্তি পেলে তারা তাদের বিনিয়োগকৃত সম্পূর্ণ টাকা ফেরত পাবেন।
এছাড়া উচ্চ আদালতের প্রদত্ত রায়কে বিনিয়োগকারীরা দেখছেন আশাব্যঞ্জক বার্তা হিসেবে। আদালতের আদেশে কারান্তরীণ থেকে ডেসটিনি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দাপ্তরিক কাজে নির্দেশনা দেয়া এবং প্রয়োজনীয় স্বাক্ষর করতে পারাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তাঁরা। বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস, এই রায়ের মাধ্যমে ডেসটিনি’র কর্মচঞ্চলতা ফিরে পাবে এবং দূর হবে সৃষ্ট বিভাজন।
সার্বিক পরিস্থিতিতে ডেসটিনি গ্রুপের শীর্ষ ব্যক্তিদ্বয়ের জামিনে মুক্ত হওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। সেইসাথে এই গ্রুপের ৪৫ লক্ষ বিনিয়োগকারী সদস্যদের বিনিয়োগকৃত অর্থ মুনাফাসহ অর্থ ফেরত প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সংকট সহসা দূর হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদি কোন কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রায়টি বাস্তবায়ন না হয়, সেক্ষেত্রে যদি ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যানকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয় বা বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁদের জন্য সাব-জেলের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে রায় বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে বলে বিশিষ্টজনেরা মনে করেন।
বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন, ডেসটিনি’র বিষয়ে উচ্চ আদালতের প্রদত্ত রায়টি বাস্তবায়নের জন্য যদি কোন প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয়, তাহলে আদালতের রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য তা সহায়ক এবং মঙ্গলকর হবে।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
উচ্চ আদালতের রায়ে উচ্ছ্বসিত হয়েও শঙ্কা কাটেনি ডেসটিনিতে বিনিয়োগকারীদের... https://corporatesangbad.com/690/ |