উদ্বেগ-আতঙ্কে সীমান্তের মানুষ, বিপর্যস্ত নিম্নবিত্ত

Posted on February 13, 2024

মোহাম্মদ রিদুয়ান হাফিজ, কক্সবাজার প্রতিনিধি: মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান সংঘাত ও সহিংস পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফসহ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

বেশি বেকায়দায় পড়েছে নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এপারে কখন গুলি এসে পড়ে; কখন মর্টারশেল এসে পড়ে! এই আতঙ্কেই রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে কৃষক থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মানুষের আয়ের পথ।

চাষি আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ কর্মস্থলের উদ্দেশে পথে বের হয়ে ক্ষেত-খামারে যাচ্ছেন আতঙ্ক নিয়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানদের পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন, আবার পাঠালেও থাকছেন উৎকণ্ঠায়। গত কয়েকদিনে মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষা নানা মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।

এলাকাবাসীর মনে কোনোভাবেই স্বস্তি নেই। ভয়ের কারণ হচ্ছে, এপারে কখন গুলি এসে পড়ে; কখন মর্টারশেল এসে পড়ে সেই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে তারা। মলিন চেহারায় এমন কথা বলছিলেন হোয়াইক্যং ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জালাল আহমদ।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুবককে কুপিয়ে-গুলি করে হত্যা জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইনে এখনো যে সংঘাত চলছে, তা বোঝা যাচ্ছে থেমে থেমে বিস্ফোরণের বিকট শব্দে। তাতে সীমান্তের এপারে ছড়াচ্ছে আতঙ্ক। কখন গুলি এসে লাগে, কখন গোলা এসে পড়ে, সেই ভয় নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বাসিন্দারা।

ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তে গোলযোগ, বিপর্যস্ত শিক্ষা একই পরিস্থিতি বিরাজমান বান্দরবানের ঘুমধুম ইউনিয়নেও।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সংঘাত তীব্র রূপ নিয়েছে। রাখাইন প্রদেশে বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির হামলায় টিকতে না পেরে মিয়ানমারের সরকারি সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কয়েকশ সদস্য এরই মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।

সেখানে সংঘাত চলছে দুই পক্ষে। তাতে গোলা এসে পড়ে বাংলাদেশেও দুজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। মাঝে সংঘাতের তীব্রতা কমলেও আবার বাড়ছে বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে এপার থেকে।

সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ওপারে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী, কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা যায়। এদিন মধ্যরাতে ঘুমধুম ইউনিয়নের বাইশফাঁড়ি সীমান্তের ওপারে বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ পাওয়া গেছে।

হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জালাল বলেন, মঙ্গলবার ভোর ৪টার পর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে বিকট শব্দের বিস্ফোরণ বলে দিচ্ছে, ওখানে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বা যুদ্ধ চলছে।

নানা মাধ্যমে খবর পাওয়া গেছে, মিয়ানমারের চাকমাকাটা, কোয়াংচিমন ও কুমিরখালী এলাকায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির ঘাঁটি ঘিরে এখন যুদ্ধ চলছে।

জালাল বলেন, ‘ওখানে যুদ্ধ হোক, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু তাতে এখানেও যে হতাহতের আশঙ্কা রয়ে যায়।’

ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ‘সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া এলাকায় কখনও কালো ধোঁয়া, আবার কখনও গুলি বা মর্টারশেলের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে এখানে উদ্বেগ থাকাটা স্বাভাবিক।’

হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারও জানান, নাফ নদীর ওপারে বিস্ফোরণের শব্দ সোমবারের চেয়ে বেড়ে গেছে। এতে এপারে গুলি-মর্টারের গোলা এসে পড়ার শঙ্কার পাশাপাশি রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের অন্য নাগরিকদের অনুপ্রবেশের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। আতঙ্কিত সীমান্তবাসী এখন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কায়।

ওই এলাকার ব্যবসায়ী তোফায়েল হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ সীমান্তের ৩১ নম্বর পিলার থেকে ৫৬ নম্বর পিলারের প্রায় ৯২ কিলোমিটার সীমান্তের ওপারে শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে উদ্বেগ বাড়ছে। সেখানে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে ২০১৭ সালের কথা মনে হচ্ছে’।

তখন এমন ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখার পর প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে রোহিঙ্গারা চলে আসে বাংলাদেশে। সেই দফায় ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এসেছিল।

এর আগে আসা ৪ লাখের বেশি মিলিয়ে এখন ১৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে আছে বাংলাদেশে। তাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ কূটনৈতিক উদ্যোগে চেষ্টা চালিয়ে গেলেও এখনও তাতে সফল হয়নি। মিয়ানমার এখনও ফেরত নেয়নি তার দেশের বাসিন্দাদের। বর্তমান পরিস্থিতিতে অস্ত্রধারী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ভয়ও পাচ্ছেন সীমান্তবাসী।

এদিকে, সীমান্ত এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বিজিবির সদস্য সংখ্যা ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী লোকজন ছাড়া বহিরাগত লোকজনকে সীমান্ত এলাকায় যাতায়াত করতে দিচ্ছে না বিজিবি। সীমান্ত পরিস্থিতি উত্তপ্তের কারণে কাঁটাতার সংলগ্ন জমি ও পাহাড়ে কৃষকরাও ভয়ে যেতে পারছেন না। চাষ করা জমিগুলোতে পরিচর্যা করতে পারছেন না কৃষকরা। গত এক মাস ধরে সীমান্ত পরিস্থিতির কারণে সেখানকার কৃষক ও জুম চাষিরা দুর্ভোগে পড়েছেন।

মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তারা সতর্ক রয়েছে। তবে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবির টেকনাফের ২ নম্বর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ।

তিনি গণমাধ্যমে বলেন, ‘নাফ নদী অতিক্রম করে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের পাশাপাশি কোনো দুষ্কৃতকারী যাতে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।’

সোমবার পর্যন্ত অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী ১৩৭ জনকে প্রতিহত করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।