ফ্রা লুকা ডি প্যাসিওলি’র ‘পার্টিকুলারিস ডি কম্পিউটিস এট স্ক্রিপচার্স’ (এ্যাকাউন্টিং বুকস্ এ্যান্ড রেকর্ডস) এর অধ্যাপক জেরেমি ক্রিপসকৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে বঙ্গানুবাদ

Posted on January 27, 2024

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ৪র্থ অংশ

ইংরেজী অনুবাদকের ভূমিকা

এন জি চক্রবর্তী।। আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে ১৪৯৪ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে আমাদের পৃথিবীর প্রথম মুদ্রিত বইয়ের একটি অংশ ছিল হিসাবরক্ষণ বিষয়ে। বিচ্ছিন্ন সব ধাতব অক্ষর জোড়া দিয়ে ছাপাবই সবেমাত্র আলোর মুখ দেখছে আর মুদ্রনশিল্প ভীরু গুটিগুটি পায়ে তার শৈশবকাল অতিক্রম করছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশকেরা চাইবেন এমন বই ছাপতে, বাজারে যার কাটতি বেশী হওয়ার সম্ভাবনা। তখনকার বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র ইতালীর ভেনিসের পাঠককুেলর কাছে আভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক ব্যবস্থাপনা আর ডাবল এন্ট্রি সিস্টেমের যে সহজ সৌন্দর্য রয়েছে তা আকর্ষণীয় হবে একথা প্রকাশকেরা আগেই বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন।

পাঁচশ বছর আগে হিসাবরক্ষণের যে নীতি পদ্ধতি রচিত হয়েছিল আজো তা বিশ্ব অর্থনৈতিক কেন্দ্র সমূহে সমানভাবে সমাদৃত। পৃথিবীর প্রথম হিসাবরক্ষণের নীতি পদ্ধতি’র রচয়িতা ছিলেন ফ্রা লুকা প্যাসিওলি। ’সুম্মা ডি এ্যারিথমেটিকা জিওমেট্রিকা প্রর্পোশনি এট প্রর্পোশনালিটা’র অর্ন্তভুক্ত হিসাবরক্ষণ বিষয়ে বিশ্বের যে প্রথম রচনা-তা নি:সন্দেহে প্রতিভাবানের কীর্তি।

যদিও বারবার নকল করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তারপরেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্যাসিওলি’র এই এ্যাকাউন্টিং পুস্তিকাটি নবীন প্রবীন সব হিসাবরক্ষকের কাছে সমানভাবে একমাত্র নির্ভরযোগ্য বই হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। কোন একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সার্থকভাবে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য কি কি মূল তথ্য প্রয়োজন তা প্যাসিওলি সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। হিসাবরক্ষণের কলাকৌশল যত উন্নত হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র যতবার বিবর্তিত হয়েছে আর ইংরেজী যতই বানিজ্যের একমাত্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে নুতন নুতন গ্রন্থকারেরা ততই বেশী বেশী পরিমানে তাঁর এ বইটা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। পরিতাপ এই যে, প্যাসিওলি’র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তো দূরের কথা, উদ্ধৃতিগুলো যে প্যাসিওলির তাও উল্লেখ করতে তাঁরা বেমালুম ভুলে গেছেন। বাস্তবিক প্যাসিওলি’র ধারণার ব্যাপ্তি আর গভীরতা এতটাই ছিল যে, আজ আমরা সেগুলোকেই ’হিসাব প্রণয়নের সাধারণ নীতি’ হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছি। দু:খের সাথে বলতে হচ্ছে মানুষ যাকে হিসাববিজ্ঞানের জনক হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে তাঁকে আজ সবাই এমনকি বিশ^বিদ্যালয় পর্যন্ত ভুলতে বসেছে।

নবীন ব্যবসায়ীরা তাঁদের জীবনে সফলতা চাইলে প্যাসিওলি আর অন্যান্য গ্রন্থকারদের বর্ণিত মৌলিক বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁর বন্ধু লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র শিল্পকর্মের মতই প্যাসিওলি’র দৃষ্টিভংগী ছিল বিস্ময়করভাবে গভীর। তাঁর ওই ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভংগীকে আপামর জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন এমন এক ভাষা যা বিদ্বজ্জনের নয় বরং স্থানীয় জনসাধারণের মুখে মুখে ফিরত ভাষার এমন এক কথ্য রুপ। বস্তুত তিনি বেছে নিয়েছিলেন রেনেসাঁ ইতালীর স্থানীয় কথ্য ভাষা। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর জ্ঞান ও অর্ন্তদৃষ্টিকে সবার বিশেষত: নবীন হিসাবরক্ষকের কাছে পৌছে দিতে।

প্যাসিওলি’র ভাষা

পনেরশ’ শতকে রেনেসাঁকালীন ইতালীতে ক্ল্যাসিক্যাল ল্যাটিন থেকে বিবর্তিত হয়ে প্যাসিওলি’র সময়কালে সে ভাষা যে রুপ নেয় সে ভাষাতেই সুম্মা রচিত হয়। ল্যাটিনের মতই এলিগ্যান্ট হলেও এ ভাষা ততটা ফর্মাল নয়। এর কোন ব্যাকরণ, সুসংবদ্ধ পদবিন্যাস এমনকি বানানেরও কোন নিয়ম কানুন ছিল না। তবে একজনের মনের ভাব অন্য জনের কাছে প্রকাশের যে ক্ষমতা এ ভাষার ছিল সেটাই হলো এর শক্তি ও সৌন্দর্য। ঠিক এ কারণে প্যাসিওলি ল্যাটিনের পরিবর্তে তখনকার মুখের প্রচলিত ভাষাকে বেছে নিয়েছিলেন।

দান্তে’কে বলা হয় আধুনিক ইতালীয় ভাষার জনক। ইতালীতে ১৫০ বছর ধরে ভাষার ক্ষেত্রেও যে বিপ্লব ঘটে গেছে দান্তের ব্যবহৃত ভাষা সেই স্বাক্ষ্যই দেয়। এ সময়ের লেখকেরা ছিলেন চোদ্দশ শতকের পেত্রার্ক ও বোকাচ্চিও, পনের’শ শতকের লরেঞ্জো ডি মেডিসি আর ফ্রাসিওলি, ষোল’শ শতকের মেকিয়াভেলি। সিসেরিয় ভাষার সংগে স্থানীয় ভাষার মেলবন্ধনে এ ভাষা তার নিজস্ব বিশিষ্টতা পেয়েছে।

তাঁর সময়কার যে ভাষায় প্যাসিওলি লিখেছেন সে ভাষার সৌন্দর্য ও বিশিষ্টতা আজ সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে। উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক তাঁর এ লেখাটির নাম তিনি দিয়েছেন ”pticularis de computis” ।বুঝতেই পরছেন এটার মধ্যে একটা শব্দের সংক্ষিপ্ত রুপ আছে। সে রকম শব্দের সংক্ষিপ্তরুপ সারা বইটি জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে আর কোন কোন জায়গায় এটা এমন ব্যাপকভাবে রয়েছে যে লেখক এ দিয়ে কি বোঝাতে চেয়েছেন তা বের করাই মুষ্কিল হয়ে দাঁড়ায়। ধরা যাক, একুশ অধ্যায়ের শুরুতে ব্যবহৃত সংক্ষিপ্তরুপ ’কম’- যা দিয়ে ’কমপ্রা’ বা ’কম্পাগ্নি’ (কোম্পানি) দুরকমই হতে পারে। ’এ্যামপাস্যান্ডস’ বা ’এ্যাটসেট্রা’ ’সো সো’ বা ’সো অন’এর এমন বহুল ব্যবহার যে, এগুলো দয়ে তখন যা বোঝাত তা বের করা কষ্টসাধ্য। এছাড়া তখনকার দিনের ছাপাখানার সীমাবদ্ধতার কারণেই হয়তো ভিতরের কোন কোন শব্দকে লাইনের শেষে জোড়া দিয়ে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

যতিচিহ্নের ব্যবহার প্রায় নাই বললেই চলে। ব্যবহৃত ঊর্ধ কমার একাধিক অর্থ থাকতে পারে। অন্য যে কোন ভাষার মত একেতো ভাষাটির জ্ঞানের অভাবে যতিচিহ্ন অনুমান করা মুস্কিল। তার উপর আমরা এটা শুনছি পাঁচশ বছর পরে। এমনকি একটা শব্দের বানান এক এক জায়গায় একেক রকম। হয়তো এর ভিন্ন ভিন্ন অর্থ ছিলো, কিন্তু তা আমাদের জানারও উপায় নেই। কোন একটা নির্দিষ্ট শব্দের ভিতর একটা বর্ণ প্রায় সব জায়গায় নিয়মিতভাবে নেই। এ থেকে অনুমান করা অমূলক হয়না যে তখনকার দিনেও শর্টহ্যান্ড স্পিডরাইটিং এর প্রচলন ছিল। এই বহুমুখি বৈচিত্র্য এ বইটাকে করেছে একদিকে যেমন দু:ষ্পাঠ্য কারণ এর ভাষা সুসংবদ্ধ বা নিয়মতান্ত্রিক নয়, আর অন্যদিকে করেছে সুখপাঠ্য কারণ এর ভাষাটি আকর্ষণীয়।

অনুবাদের ঝুঁকি

কোন শিল্পের ভাষা ও তার মর্মবস্তু এ দুয়ের সার্থক মিলনের উপর নির্ভর করে শিল্পের সার্থকতা। ভাষান্তরিত হলে সে সার্থকতা হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। প্যাসিওলি’র মূল লেখা থেকে অনুবাদের সময়ও একই কথা প্রযোজ্য। তবে আমার এ অনুবাদটি এর আগের তিনটি অনুবাদের চাইতে পৃথক, কারণ-শাব্দিক অনুবাদের চাইতে আমি তাঁর বক্তব্যকে স্পষ্ট করার উপর বেশী জোর দিয়েছি।

এ কারণে মধ্যযুগীয় পদের বদলে আমি সমকালীন আধুনিক বাগধারা ও পদ ব্যবহার করেছি। তাই প্যাসিওলি যেখানে অর্থ প্রদানের ’প্রতিজ্ঞা’ লিখেছেন সেখানে আমি তার বদলে লিখেছি ’প্রদানের অঙ্গীকার’। আবার সমকালীন আধুনিক অর্থ ব্যবস্থাপনার সংগে সংগতিপূর্ণ কিছু মধ্যযুগীয় এ্যাকাউন্টিং টার্মকে অবিকৃত রেখেছি। আবার বাজারে কর কর্তৃপক্ষের আরোপিত ’চার্জেস ফর এক্সপেন্স’কে আমি আধুনিক ধারণার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য করেছি ’বিক্রয় কর’। ক্ল্যাসিক্যাল ল্যাটিন কিম্বা আধুনিক ইতালীয় বা ইংরেজী ভাষার যে শব্দক্রম তার কোনটাই মধ্যযুগীয় ভাষার শব্দক্রমের সংগে মেলে না। কাজেই আমাকে অর্থ ঠিক রেখে পুরানো শব্দের নুতন শব্দান্তর করতে হয়েছে।

কিছু মূল লেখার বা কোন বর্ণনার অর্থপ্রবাহকে ঠিক রেখে যাকে সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে তা ফুটনোট আকারে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে এ্যাকাউন্টিং এর বেলায় যে সমস্ত ছক ব্যবহৃত হয়েছে তার পরিবর্তন আমাকে করতে হয়েছে। আধুনিক কালের হিসাবশাস্ত্রের বইতে সেগুলো যেভাবে লিখতে হতো সেগুলোকে ঠিক সেভাবে লিখেছি। শেষের কথা এই যে, বহুবিধ মুদ্রা ব্যবহারের পরিবর্তে আমি একটি মাত্র মুদ্রা ব্যবহার করেছি।

পূর্বতন অনুবাদকদের বিষয়ে

অনাকর্ষণীয় আর বিরক্তিকর এই অজুহাতে প্যাসিওলি উল্লেখিত বেশকিছু নাম পদ ইত্যাদি পূর্বেকার তিন অনুবাদক সবাই এড়িয়ে গেছেন। হিসাব সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক বিধিনিয়ম ও বিশ্বমানচিত্রের প্রতি আমার আগ্রহের কারণে ওই নাম ও পদ আমার কৌতুহল উদ্রেক করেছে। ওই বিদেশী টার্মগুলো আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়স্ত্রণ ও ডকুমেন্টারী ক্রেডিটে আজো সমানভাবে প্রযোজ্য। পুরানো নামগুলো আবিষ্কারের নেশা জাগায়।

আগের অনুবাদকেরা প্যাসিওলি’র ব্যবহৃত ভাষাকে ল্যাটিন বা সেই পুরানো ইতালীয় ভাষা থেকে আলাদা করতে পারেননি। তাই স্বভাবত:ই ওটা তাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়েছে। তাঁরা ধরে নিয়েছেন যে কোন লেখা আবশ্যিকভাবে স্ব-ব্যাখ্যামূলক। পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ¯বীকার করতেই হবে যে ওগুলোর ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই রয়েছে।

প্যাসিওলি’র লেখার ধরণ আর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের পুনরাবৃত্তির সমালোচনা করেছেন আগের অনুবাদকেরা। এমনকি এ পর্যন্তও তাঁরা গেছেন যে প্যাসিওলির ভাষা নাকি অশ্লীল। আমি বরং তার ভাষায় সৌন্দর্য খুঁজে পাই। শব্দতত্বের দিক থেকে প্রাচীন রোম আর রেনেসাঁকালীন ইতালীর ভাষার যে সমন্বয় তিনি ঘটিয়েছেন তাতে নতুন শক্তি, উত্তেজনা আর আশার সঞ্চার হয়েছে। প্যাসিওলি’র মূল রচনা সঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য প্রয়োজন হিসাবরক্ষণ বিষয়ে পারদর্শিতা। এ বইটিতে ঘটেছে একাধারে ইতিহাস, সমাজ, সাহিত্য ও দর্শনের এক অপূর্ব সমন্বয়।

ভাষা নির্বাচন

গ্রন্থকার আর তাঁর লেখার প্রতি যদি অনুবাদকের শ্রদ্ধা আর ভালবাসা থাকে তবে তিনি অনুবাদটি কিভাবে করবেন, কি ভাষা ও আঙ্গিক ব্যবহার করবেন তার ধন্দে পড়ে যেতে হয়। শাব্দিক আর মুক্ত অনুবাদ মূলগতভাবে পরস্পর বিরোধী। এ দুয়ের মাঝখানে পড়ে তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ ধন্দের সংগে সর্বোত্তম তুলনা হতে পারে ’চসার’ এর লেখা ’বাথ এর বেী এর গল্প’ এ নাইট বেচারার ধন্দের। ’কুৎসিত আর বুড়ি কিন্তু বিশ্বস্ত, নাকি ’সুন্দরী আর যুবতী কিন্তু অবিশ্বস্ত, কোন ধরণের বৌ কাঙ্খিত- এ দুয়ের ধন্দে পড়ে গিয়েছিল গল্পের সে নাইট। অনেকটা একইভাবে যে অনুবাদক চমৎকার অনুবাদ চান তার জন্য গ্রন্থকারের মূল লেখার শাব্দিক অনুবাদ আর আকর্ষণীয় ভাবানুবাদ-এ দুই বিকল্পের যাঁতাকলে তাঁকে পড়তেই হবে।

অধ্যাপক ফ্রান্সিস উইলিয়াম নিউম্যান ’ইলিয়াড’ গন্থের অনুবাদকালে এ দুই বিপরীতমুখী বিকল্প থেকে উদ্ধারের উপায় বাৎলেছেন। তাঁর মতে অনুবাদকের করণীয় হবে,- যাই কিছু হোক না কেন, মূলের বৈশিষ্ট্যকে ঠিক রেখে অনুবাদটি যত্ন করে করতে হবে। পাঠকের কথা মাথায় রেখে বিকল্পও ভাবা যেতে পারে। পড়ার সময় পাঠকের পক্ষেও ’এটা অনুবাদ’ এ কথা ভুলে গিয়ে ’আমি আসলটাই পড়ছি’ এ মনোভাবটি জাগিয়ে রাখা দরকার। ল্যাটিন থেকে অনুবাদক হোরেস ’একেবারে শব্দ থেকে শব্দ অনুবাদ’ না করাই ভাল বলে পরামর্শ দিয়েছেন।

প্যাসিওলির কাজকে রেনেসীঁয় ইতালী থেকে বিংশ শতাব্দীর আমেরিকার জগতে স্থাপন করতে হয়েছে। যে ভাষায় প্যাসিওলি লিখেছেন তাকে আমি নাম দিয়েছি ’রেনেসীঁয় ইতালীয়ান’। যে ভাষার ব্যাকরণ কোন সূত্রাবদ্ধ নয় বরং স্বতোৎসারিত। সমস্ত সৌন্দর্য সত্বেও এটা আজ মৃত ভাষা। হাওয়ার্ড ডব্লিউ ক্লার্ক তাঁর ’আর্ট অব অডিসি’তে যেমন বলেছেন ’কিসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে তাও আমরা জানিনা’।

নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

প্যাসিওলি’র ’সুম্মা’র এ অনুবাদটি ইতিপূর্বেকার বাকীসব অনুবাদের চেয়ে পৃথক। তিনি বিজ্ঞজনের যে ল্যটিন ভাষা তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সাধারণের মুখের ভাষাকে তার বইটির ভাষা করেছেন। সে অনুযায়ী আমাকে তাঁর ব্যবহৃত রীতি ও পদ’কে সমকালীন করতে হয়েছে। এ্যাকাউন্টিং এন্ট্রি যা ছিল, তাকেও সমকালীন করেছি। নবীন পাঠকেরা তাতে উৎসাহিত হবেন। সমকালীন ভাষা ও ফরম্যাট বর্তমানকালে সহজবোধ্য। ল্যাটিন ভাষার সংগে পনের শতকের নবীন ও যুবক পাঠকদের যে পরিমান অপরিচয়ের দূরত্ব ছিল এ অনুবাদের মাধ্যমে বর্তমান কালের পাঠকদের সংগে ঐ সময়কার এ্যকাউন্টিং রীতি-পদ্ধতি, তার চেয়ে নিশ্চয়ই বেশী দূরত্ব তৈরী হবে না।

হিসাব সংরক্ষণের যে প্রাচীন ঐতিহ্য আমাদের রয়েছে তার অংশবিশেষ আমাদের আজকের ও আগামী দিনের পাঠকের কাছে তুলে ধরা ছিল আমার এ অনুবাদের উদ্দেশ্য। প্যাসিওলি’র বইটা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ধারণার ক্রমবিকাশের ঐতিহাসিক মুহুর্তগুলো এতে ধরা পড়েছে। হিসাববিদকে হিসাবের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী হিসাব তৈরীতে এটা সাহায্য করে। হিসাবের নীতিসমূহ কতখানি প্রতিপালিত হলো তা বুঝতেও এটা সাহায্য করে।

আগের অনুবাদকেরা হিসাবশাস্ত্রকে না দেখেছেন কোন শিক্ষণীয় বিষয় হিসাবে, না লিবারেল আর্ট হিসাবে। তবে, রেনেসাঁ অধ্যাপক প্যাসিওলি ’বীজগণিত’কে ’মানবিক বিদ্যা’র সংগে সেতুবন্ধ রচনা করতে কাজে লাগিয়েছেন। বীজগণিতের সূত্রের সামান্য ব্যবহার সাধারণ ব্যবহারকারীর কাছেও আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণে স্বাধীন হাতিয়ার হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। একইভাবে আধুনিক হিসাব বিজ্ঞানের যে মৌল ভিত্তি তাকে শক্ত কাঠামোয় রুপ দিতে পেরেছেন। এবং তিনি সংশ্লিষ্ট সকল ধারণার মিশ্রনে যেটি তৈরী করেছেন তা ব্যবসা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষসহূহের মধ্যে যোগাযোগের সফল ভাষা হয়ে উঠেছে। তাই তাঁর রচিত এ বই ক্লাশের খটমট বই না হয়ে, হয়ে উঠেছে শিল্পসুষমা সমৃদ্ধ লিবারেল আর্ট। শিল্পমন্ডিত এ রুপকে বোঝার সুবিধার জন্য পাদটীকা সংযোজন করেছি।

অনুবাদের শত সমস্যা সত্বেও স্বীকার করতেই হবে যে প্যাসিওলি হিসাবরক্ষণের ব্যাপারে যে ধারণা পোষণ করতেন তা ছিল সহজ ও স্বচ্ছ। তিনি চোখে চোখ রেখে কথা বলেছেন। তাঁর লেখা গতিশীল। যে কোন ভাল শিক্ষকের মতই তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়মকানুন সমেত বারবার তাঁর ছাত্রদেরকে বলেন। আর তিনি সেগুলোর মধ্যেকার সব খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো এমনভাবে বলেন যাতে ছাত্ররা আনন্দ পায়। প্যাসিওলি’র বলার ভঙ্গি এমনই যে তা শুনতে ইচ্ছা করে (মনে রাখতে হবে যে ’অডিট’ মানে ’শোনা কথা’)। তিনি চিন্তাও করতেন সাধারণের মত করে। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে তিনি এমন সহজ স্বচ্ছন্দভাবে যান যে পড়তে একঘেঁয়ে লাগে না।

তিনি নিজে নি:শব্দ থেকে হিসাবাবিজ্ঞানকে দিয়ে কথা বলিয়ে নিয়েছেন। একজন শিক্ষকের লেখা আারেকজন শিক্ষকের কাছে সম্পূূর্ণভাবে ধরা দেয়া অসম্ভব নয়। গ্রন্থকার হিসাববিজ্ঞানের বাণীটি যে সহমর্মীতাসহ সবার কাছে পৌছে দিতে চান, আমার আকাঙ্খা আমার এ অনুবাদও যেন তাঁর মত একই বিশ্বস্ততা আর সহানুভুতিসহ বর্তমান পাঠকের কাছে গিয়ে পৌছায়। আমার আশা প্যাসিওলি’র এ্যাকাউন্টিং ম্যানুয়ালের এ অনুবাদ এখনকার নবীন হিসাবরক্ষকদের কাছে আনন্দময় হয়ে উঠবে, প্যাসিওলি’কে নতুনভাবে আবিষ্কার করবে, হিসাবরক্ষণের যে ঐতিহ্য তা আরো বিস্তৃত হবে।

জেরেমি ক্রিপস
হাইডেলবার্গ কলেজ
টিফিন, ওহাইয়ো
মার্চ ১৯৯৪

লেখক: এন জি চক্রবর্তী, গবেষক কোম্পানি ল, পেশাদার হিসাববিদ ও সহ প্রতিষ্ঠাতা, আইসিএসবি।