শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস: অপূরণীয় ক্ষতির মাঝে জেগে উঠুক আলোকিত বাংলাদেশ

Posted on December 14, 2023

যে ব্যক্তি নিজের কর্ম, চিন্তাধারা, জীবনের প্রতিফলন ও দর্শনবোধের মাধ্যমে সমাজকে প্রভাম্বিত করে থাকে সাধারণত তাঁকেই মূলত বুদ্ধিজীবি বলা হয়ে থাকে। আবার বিজ্ঞানী, স্থপতিবিদ, দার্শনিক, কবি ও সাহিত্যিক কিংবা সাংবাদিকসহ যাঁরাই সমাজকে আরো প্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত তাঁদের সকলকেও বুদ্ধিজীবির মর্যাদা দেয়া হয়। এটি কোন পেশাভিত্তিক পরিচয় নয়, বরং এক বুদ্ধিদীপ্ত সংগ্রামীদের উপাধি। প্রত্যেক মানব সমাজের উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের পেছনে বুদ্ধিজীবিদের অবদান থাকে সবচেয়ে বেশি। ইউরোপের রেনেঁসা থেকে শুরু করে বাংলার রেনেঁসা বা নবজাগরণ এসবই ছিল মূলত এক সমন্বিত বুদ্ধিদীপ্ত সংগ্রামের প্রতিফলন; যার কারণে সমাজে হয়েছে সংস্কার, এসেছে সব আধুনিক নতুন ব্যবস্থা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনেও রয়েছে এক বুদ্ধিদীপ্ত সংগ্রাম। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি গঠিত হবার পর থেকেই পূর্ব বাংলার (আজকের বাংলাদেশ) বা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের অধিকারের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে তৎকালীণ এখানকার সচেতন রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা কখনও সন্তুষ্ট হতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি সংখ্যাগুরুর বাংলার বদলে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণাটি। যার কারণে ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের মত এক ব্যতিক্রমী গণমানুষের অধিকার আন্দোলনের বিষয়টি রচিত হয়। এছাড়াও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ বাংলার মানুষ অবহেলিত ও বঞ্চিত হতে থাকে বিধায় তাদের প্রতিবাদের ধারাবাহিকতার চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে জয়লাভ করার কারণেই আজকের এই বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন বাংলার বুদ্ধিজীবিদের উপর পাকিস্তান সরকারের বিশেষ ক্ষোভ ছিল। এজন্যই যুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে বেছে নেয় বুদ্ধিদীপ্ত সংগ্রামীদের নিশ্চিহ্ন করার নির্মম হত্যাযজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অন্য সময়ে বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হলেও যুদ্ধের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসম্বরে এদেশের দোসরদের সহায়তায় তালিকা করে দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী। তাঁদের স্মৃতি প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রতি বছরের ১৪ ডিসেম্বরে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস। বুদ্ধিজীবিদের উপর পাকিস্তানের এত ক্ষোভ থাকার কারণটি ছিল তাদের বুদ্ধিদীপ্ত সংগ্রাম। কারণ সে সময়কার বুদ্ধিজীবিদের অনেকেই তাদের ভাবধারার দ্বারা মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি তরান্বিত করেছেন। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, চিকিৎসকসহ বাঙালি জাতি হারায় তার বহু মেধাবী সন্তানদের। তবে যুদ্ধে পরাজয় বুঝতে পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে বুদ্ধিজীবিদের নিধন করার পেছনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূণ্য করার উদ্দেশ্যও পাকিস্তানের ছিল।

গুহুঠাকুরতা, মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীদের মত উচ্চ শিক্ষিত বুদ্ধিজীবি ছিলেন। তাদের হারানোর কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয়েছে তা আজও পূরণীয় নয় বলে বলা যায়। এদের সবাই বেঁচে থাকলে আজকের বাংলাদেশ হয়তো বা অন্যরকম থাকতো। প্রগতিশীলতার একটি নির্দিষ্ট ভাবধারা থাকতো। তাঁদের কারণে দেশের শিক্ষিত সমাজের একটা সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন থাকতো। শুধু তাই নয়, তাদের কারণে দেশের অবকাঠামো ও উন্নয়ন পরিকল্পনাও এগিয়ে থাকতো। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্যিই তাদের সবাই আজ ইতিহাস। আর এ বুদ্ধিজীবি নিধনের পেছনে পাকিস্তানের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা যত না কষ্টদায়ক, তার চেয়েও বড় কষ্টদায়ক হচ্ছে সে সময়কার কিছু বিপথগামী বাঙালি পাকিস্তান বাহিনীকে এ রকম নিষ্ঠুর কর্মকান্ডে সহায়তা করে। মূলত তাদেরই সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবিদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারে।

আমরা একাত্তরের শহীদ হওয়া সকল বুদ্ধিজীবিদের প্রতি জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা। যা হারিয়েছে তা ফিরে পাওয়া না গেলেও সে সময়কার বুদ্ধিজীবিদের চেতনা ও ভাবধারাকে নতুন করে এ দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা যেতে পারে। শুরু করা যেতে পারে আরো একটি নবজাগরণ; যার উদ্দেশ্য হতে পারে নতুন এক আলোকিত বাংলাদেশ গড়ার।