কোম্পানীর কমন সীল

Posted on November 18, 2023

নন্দ গোপাল চক্রবর্তী : কোম্পানীর কমন সীল একটি নিরীহ বস্তু। এই নিরীহ সীল কেন যে কর্তা ব্যক্তিদের রোষের কারণ হলো ঠিক বুঝতে পারলাম না। গত ২০২০ সনের ২৫শে ফেব্রুয়ারি তারিখের ৭ নং আইনের মাধ্যমে ১৯৯৪ সনের কোম্পানী আইনের নিচের ধারাগুলোতে কোম্পানীর সীল বিষয়ে যা যা বলা ছিল তা বিলোপ করা হয়েছে।

সিকি শতক আগে হয়ত বা কমনসীলের দরকার ছিল, আজ আর নেই। যদি অপ্রয়োজনীয়ই হয় তা হলে বলতে হবে ভালই হয়েছে। তা হলে দেখতে হচ্ছে সীলের দরকারটা কি। কোম্পানী সীলের কথা বাদ দিলাম। সরকারি বেসরকারি যে কোন অফিসের নির্বাহী কর্মকর্তার সীল আর তারিখ ছাড়া সই সাধারণত বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই সীল ও সই দুটোই চাই। কোম্পানী কোন কর্মকর্তাতো দূরের কথা, কোন রক্তমাংসের মানুষই নয়। তার পক্ষ থেকে কোন ক্ষমতা প্রাপ্ত মানুষ কোন দলিলে বা কাগজে সই করে। সেখানে যদি কোন সীল না থাকে তাহলে তা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে পারে।

আমাদের দেশে প্রচলিত কমনসীলের রকমফের আছে। রাবার ষ্ট্যাম্প হতে পারে। তবে তাতে ঝামেলা। প্যাডের দরকার, বাঁকাতেরা হতে পারে, কালি সব জায়গায় সমান না হলে ঝাপসা বা অষ্পষ্ট হতে পারে। তার চেয়ে ফø্যাক্সো সীল নিরাপদ। সেখানে এ সমস্ত ঝামেলা নেই সত্য, তবে নীলখেতে এসবই সহজলভ্য। তার চেয়ে খানিকটা নিরাপদ হলো লোহার তৈরি এমবোজ সীল, যেটা নকল করা ষম্ভব হলেও যেখান সেখান থেকে তৈরি করা যায় না। এই সীলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাগজে এটা কোম্পানীর নাম স্থায়ীভাবে খোদাই করে দেয়।

সীলের কথা উঠতেই এ বিষয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৭৩ সন। ঢাকায় থাকি। আমাদের ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের একটা সীল জরুরি দরকার । আমাকে খবর পাঠালেন। আমি একটা খসড়া করে নীলখেতে গেলাম। আজকের মত এত দোকান তখন ছিল না। তবে সীল তৈরির দোকান ছিল একাধিক। তার একটা দোকানে গিয়ে খসড়াটা দিয়ে একটা রাবার ষ্ট্যাম্প বানিয়ে দিতে বল্লাম। দোকানি আমাকে ’অথরাইজেসন’ দেখাতে বল্ল। আমার মাথায়ই আসেনি যে সীল বানাতে অথরাইজেসন লাগতে পারে। ফলে আর সে সীল বানানো হলো না। সে দিন আজ আর নেই।

এখন দেখা যাক ভারতে কমনসীলের অবস্থা কি। ২০১৫ সনের ২১নং আইন দিয়ে ২০১৩ সনের সংশোধিত ভারতীয় কোম্পানী আইনের ১২(৩)(বি) ধারা বলছে: যদি কোম্পানীর কোন কমন সীল থেকে থাকে তবে তাতে কোম্পানীর নাম এমনভাবে খোদাই করা থাকবে যাতে তা পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। অন্যান্য ধারায়ও প্রায় একই কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সীল থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। এবার দেখা যাক বিলাতের পরিস্থিতি কি। ২০০৬ সনের কোম্পানী আইনের ৪৫ ধারার ১ থেকে ৬ উপধারা ভারতীয় আইনের মতই বলছে: প্রয়োজনবোধে সীল থাকতেও পারে আবার প্রয়োজন না থাকলে নাও থাকতে পারে। অর্থাৎ প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে সে প্রয়োজনটা কে নির্দ্ধারণ করবে তা বলা নেই। আর যদি সীল থাকেই তবে যেন তার মধ্যে কোম্পানীর নামটা স্পষ্টভাবে খোদাই করা থাকে। সেটা না হলে দন্ড পেতে হবে।

দেখা গেল আমাদের দেশের মত ঐ দুটো দেশের কোনটাই নির্বিষ কমনসীলকে একেবারে সমূলে উৎপাটন করেনি। ব্যবসাবান্ধব বলে হয়ত আমাদের সরকার তা করেছেন। তবে ১৪০০শ বছর আগেও যে শুধুমাত্র সীলমোহরের প্রয়োজন ছিল তাই না, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যবাদীকেও তা ব্যবহার করতে হয়েছে।

সূত্র: সি ২/২, কলেজ ষ্ট্রীট, কোলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক ’কাফেলা’, দ্বিতীয় বর্ষ, বিশ্বনবী সংখ্যা, পৌষ ১৩৮৯ বঙ্গাব্দ (পৃষ্ঠা নং ১২ ও ১৩)। তবে এরপরও কথা থেকে যায়। কম্পিউটারের কল্যানে ইদানিং ’কিউ আর কোড’ আবিষ্কৃত হয়েছে আর তা আমাদের দেশেও ব্যবহৃত হচ্ছে। কাগজে বা দলিলে যদি কিউ আর কোড ব্যবহার করা যায় তবে তা কমনসীলের উপযুক্ত বিকল্প হতে পারে।

লেখক: গবেষক কোম্পানি ল, পেশাদার হিসাববিদ ও সহ প্রতিষ্ঠাতা, আইসিএসবি।