সাইফুল ইসলাম তানভীর : মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার দক্ষিণ জামশা বাজারে ৩টি এজেন্ট ব্যাংকের আউটলেট খুলে চলছে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা। ব্যাংকে রাখা আমানতের টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে মালিক ও কর্মচারীদের হাতে মারধর ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন গ্রাহকেরা।
সরেজমিন মঙ্গলবার (১১ মার্চ) দুপুরে ভুক্তভোগী একাধিক গ্রাহকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই বাজারে জনৈক নজরুল ইসলাম মোল্লার মালিকানাধীন তিনটি এজেন্ট ব্যাংকের শাখায় গেলে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর প্রতারণার তথ্য। ওই এলাকার সোহরাব মোল্লার ছেলে নজরুল ইসলাম মোল্লা গত ৬-৭ বছর আগে দক্ষিণ জামশা বাজারে ডাচ্ বাংলা ব্যাংক, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক,ও মধুমতি ব্যাংকের আউটলেট খুলে কার্যক্রম শুরু করেন। এলাকার বিভিন্ন গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অংকের আমানত রাখার বিপরীতে লাখে প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে লভ্যাংশ দেয়ার প্রলোভন দেয়। এতে আশপাশের লোকজন সেখানে টাকা রাখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তিনটি এজেন্ট ব্যাংক আউটলেটে শতাধিক গ্রাহক মোটা অংকের আমানত রাখেন। কয়েক মাস ঠিক মতোই গ্রাহকেরা লভ্যাংশ পায়। এর মধ্যে সদ্য প্রবাস ফেরত পার্শ্ববর্তী গোলাইডাঙ্গা গ্রামের মৃত সিরাজ মাহাকির ছেলে লোকমান মাহাকি (৬৩) তার আমানতের ২৫ লাখ টাকা তুলতে গেলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানান,তার সমুদয় টাকা ব্যাংকের এজেন্ট নজরল ইসলাম মোল্লার মালিকানাধীন” সমৃদ্ধি সঞ্চয় ও ঋণদান সমিতিতে” রাখা হয়েছে। ওই টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে বাগবিতন্ডার এক পর্যায়ে গত ৪ মার্চ এজেন্ট মালিক ও কর্মচারীদের হাতে মারধরের শিকার হন ভুক্তভোগী গ্রাহক। এ নিয়ে আহত গ্রাহক লোকমান মাহাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক নজরলসহ ৪ জনকে আসামী করে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই বাজারের তিনটি এজেন্ট ব্যাংক শাখায় গেলে দেখা যায়, ভুক্তভোগী গ্রাহকদের উপচেপড়া ভীড়। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সবাইকে এজেন্ট ব্যাংকের শাখায় টাকা রাখার কথা বলা হলেও সত্ত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম মোল্লা অভিনব কায়দায় সমুদয় অর্থ তার মালিকানাধীন ডাচ্ সমৃদ্ধি সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতিতে জমা রাখেন। ওই টাকা দিয়েই দেদারসে সুদের ব্যবসা চালিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন তিনি। লাভ তো দূরের কথা গ্রাহকদের আসল টাকা চাইতে গিয়ে মারধর,প্রতিনিয়ত হুমকি – ধমকি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনেকেই।
এদিকে,দক্ষিণ জামশা হাই স্কুল বিল্ডিংয়ের নিচ তলায় ডাচ বাংলা ও মধুমতি ব্যাংকের আউটলেটে গিয়ে দেখা যায়, আমানতের টাকা রাখা ভুক্তভোগী গ্রাহকদের ভীড়। এ সময় বিশু বেপারীর স্ত্রী গ্রাহক কাঞ্চনমালা অভিযোগ করে বলেন, আমার ১০ লাখ টাকা ডাচ্ বাংলা ব্যাংকে রাখা হয়েছে। টাকা তুলতে এসে জানতে পারলাম ব্যাংকে টাকা নাই তার সমিতিতে নিয়ে গেছে। একই সাথে তার পরিবারের বিলকিসের ১ লাখ ৫০ হাজার, রোখসানার ১ লাখ ৫০ হাজার, ফুলমালার ১৪ লাখ টাকা জমা রাখলেও লাভ তো দূরের কথা আসল টাকাই দিচ্ছেন না। মূল টাকা থেকে প্রতি মাসে লাখে ১ হাজার টাকা করে ফেরতের কথা বলছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে পুরো টাকা ফেরত পেতে শত বছর লাগলে তাদের পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না বলেও জানান একাধিক গ্রাহকেরা।
এ সময় নজরুল ইসলামের মালিকানাধীন সমৃদ্ধি সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির ম্যানেজার হাবিবুর রহমান গ্রাহক লোকমান মাহাকির সঙ্গে মারধরের ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমি গত পাঁচ মাস আগে এ ঋণদান সমবায় সমিতিতে যোগদান করেছি। প্রতিষ্ঠানটির সমবায়ের রেজিষ্ট্রেশন থাকলেও মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির সনদ নেই । সেই হিসেবে সমবায় সমিতিতে ফিক্সড্ ডিপোজিট রাখার বিধান নেই বলেও স্বীকার করেন তিনি।
অপরদিকে,ভুক্তভোগী আরেক গ্রাহক চুন্নু মিয়া বলেন, প্রবাসে থাকাবস্থায় আমার ১০ লাখ ও স্ত্রীর নামে ৯ লাখ টাকা ডাচ্ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছিল। পরে আমার স্ত্রী আকলিমাকে লোভ দেখিয়ে কৌশলে টাকাগুলো ডাচ সমৃদ্ধি সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতিতে ঢুকিয়েছে। কয়েক মাস আগে কখনো ডাচ্ সমিতি আবার কখনো সমৃদ্ধি সমিতির নামে আমার মোবাইলে ম্যাসেজও দিয়েছে তারা ।পরে জানতে পারলাম ওটা এজেন্ট ব্যাংক না তার নিজের এনজিও।
গ্রাহকদের রোষানল থেকে বাঁচতে ও একটি মামলায় পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে প্রতারক নজরুল বসতবাড়িতে তালা ঝুলিয়ে রয়েছে আত্মগোপনে। নিজের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটি বন্ধ রাখায় তার সঙ্গে যোগাযোগ ও বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে তার প্রতিষ্ঠান ডাচ্ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকের ক্যাশিয়ার শাকিল খান বলেন, মালিকের মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। কয়েক দিন পর পর তিনি ইমোতে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। সকল গ্রাহক টাকার জন্য একসঙ্গে চাপ দেয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারাও ভীতির মধ্যে অফিস করছেন বলেও জানান।
ডাচ্ বাংলা ব্যাংক সিংগাইর শাখার ম্যানেজার মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, বিষয়টি আপনাদের কাছ থেকে শুনলাম । এজেন্ট ব্যাংকের কার্যক্রম যেখান থেকে মনিটরিং করা হয় আমি সেখানে অবগত করবো।
এদিকে,আহত গ্রাহক লোকমান মাহাকির অভিযোগ প্রসঙ্গে থানার এসআই মো. জসিম উদ্দিন বলেন, যতটুকু শুনেছি ঘটনার সত্যতা আছে। বাদী মামলা করতে চাইলে তা নেয়া হবে।
উপজেলা সমবায় অফিসার মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, শুধুমাত্র সমিতির সদস্যদের মধ্যে ঋণ কার্যক্রম করতে পারবে। এফডিআর করার কোনো সুযোগ নেই। অডিট অফিসার যাবে,উনার রিপোর্টের আলোকে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।
এ ব্যাপারে সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. কামরুল হাসান সোহাগ বলেন, সমবায় অফিসের মাধ্যমে বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া থানায় দায়ের করা লিখিত অভিযোগের আইনগত সুযোগ ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা গ্রহণ করতে পারে।