ময়মনসিংহ ব্যুরো: মাটির ওপর খড় দিয়ে মালচিং পদ্ধতিতে আলুর বাম্পার ফলনে সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষিতত্ত্ব বিভাগের একদল গবেষক।
রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব খামার গবেষণাগারে আয়োজিত ‘মাঠ গবেষণা কার্যক্রম পরিদর্শন’র সময় গবেষণার বিষয়ে এসব তথ্য জানান গবেষকদলের প্রধান কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ খায়রুল হাসান ও সহযোগী গবেষক পিএইচডি ফেলো এফ এম রুহুল কুদ্দুস।
এ সময় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাকৃবি রিসার্চ সিস্টেমের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাম্মাদুর রহমান। আরও উপস্থিত ছিলেন কৃষিতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. রমিজ উদ্দিন, অধ্যাপক ড. মো. আবদুল কাদের, অধ্যাপক ড. মো. আবদুস সালাম, অধ্যাপক ড. মো. পারভেজ আনোয়ারসহ বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আলুচাষ একটি অন্যতম লাভজনক পদ্ধতি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আলু উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে অবস্থান করছে। মাটির উর্বরতা, আবহাওয়া এবং উন্নত চাষ প্রযুক্তির ফলে দেশে আলুর উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইসঙ্গে দেশে আলু উৎপাদনে প্রচলিত চাষ পদ্ধতি ও প্রয়োজনের অধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে মাটির গুণাগুণ দিন দিন কমে যাচ্ছে।
এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষিতত্ত্ব বিভাগের একদল গবেষক। সংরক্ষণশীল চাষ পদ্ধতি (কনজারভেশন অ্যাগ্রিকালচার) বা বিনা চাষে (জিরো টিলেজ) আলু উৎপাদন করে প্রাথমিকভাবে আলুর ফলনে সাফল্য পেয়েছে ওই গবেষকদল।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিনা চাষে আলুর ফলন প্রচলিত চাষ পদ্ধতির চেয়ে তুলনামূলক বেশি। পাশাপাশি এ পদ্ধতিতে চাষের ফলে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ অনেকাংশে কমে যায়, যা বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের পরিমাণকে কমিয়ে দেবে ও জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন গবেষকরা।
দুই মৌসুম ধরে আলুর চাষ পদ্ধতি ও সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্থাপনা বা ইন্টিগ্রেটেড নিউট্রিয়েন্ট ম্যানেজমেন্টের (আইএনএম) ওপর গবেষণা করে তারা প্রাথমিকভাবে এ সাফল্য পেয়েছেন। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে গবেষণা প্রকল্পটি চলমান রয়েছে।
প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. আহমদ খায়রুল হাসান গবেষণার কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, আমরা বারি-৭ (ডায়মন্ড) জাতের আলু নিয়ে গবেষণা করেছি। গবেষণায় দুই ধরনের চাষপদ্ধতি নিয়ে কাজ করা হয়েছে। একটি প্রচলিত চাষ ও অন্যটি সংরক্ষণশীল চাষ বা বিনা চাষ (জিরো টিলেজ) পদ্ধতি। পাশাপাশি সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্থাপনা বা ইন্টিগ্রেটেড নিউট্রিয়েন্ট ম্যানেজমেন্ট (আইএনএম) নিয়েও কাজ করা হয়েছে। আইএনএম পদ্ধতিতে পাঁচ ধরনের সারের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গবেষণার ১ম মৌসুমে আলুর চাষ পদ্ধতি ও সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে একই জমিতে তিন পদ্ধতিতে আলু চাষাবাদ করে পরীক্ষণ চালানো হয়েছে। একটিতে বিনা চাষ ও শতভাগ রাসায়নিক সার প্রয়োগ পদ্ধতি, আরেকটিতে প্রচলিত চাষ ও শতভাগ রাসায়নিক সার প্রয়োগ পদ্ধতি এবং অন্যটিতে বিনা চাষ ও শতভাগ জৈব সার প্রয়োগ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। আলু উৎপাদনের ফলাফলে দেখা গেছে, প্রচলিত চাষ পদ্ধতি ও শতভাগ রাসায়নিক স্যার প্রয়োগকৃত অংশের ফলনের তুলনায় বিনা চাষ পদ্ধতি ও শতভাগ রাসায়নিক স্যার প্রয়োগকৃত অংশের ফলন হেক্টর প্রতি ২ টন বেশি। গবেষণার ২য় মৌসুমের ফসল এখন মাঠে রয়েছে। তবে মাঠ পরির্দশন করে ১ম মৌসুমের মতো প্রচলিত চাষ পদ্ধতির চেয়ে বিনা চাষের পদ্ধতিতে অধিক ফলন আশা করছেন এই গবেষক।
সহযোগী গবেষক পিএইচডি ফেলো এফ এম রুহুল কুদ্দুস বলেন, মাটি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, বিনা চাষ পদ্ধতি (জিরো টিলেজ) ও সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কেঁচো সার, মুরগির বিষ্ঠা, গোবর সার প্রয়োগ করা হয়েছিল। যেসব জমিতে ওই জমির মাটিতে জৈব কার্বনের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনতে পারে এই বিনা চাষ পদ্ধতি। সংরক্ষণশীল কৃষিতে বিনা চাষ পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে চাষাবাদের খরচ কমিয়ে আনবে। পাশাপাশি সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাসায়নিক সারের ব্যবহারেও সাশ্রয় হবে। যার ফলে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতিতে সংস্কার এনে সংরক্ষণশীল (কনজারভেশন) চাষ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। সংরক্ষণশীল চাষ পদ্ধতি বলতে প্রায় বিনা চাষে ফসল উৎপাদন বোঝায়। এ পদ্ধতিতে আলুর খেতে ট্রাক্টর বা হাল দিয়ে মাটি চাষ করার প্রয়োজন হয় না। হালকা টাইন দিয়ে মাটি খুঁড়ে আলু লাগানো হয় এবং জমিতে প্রয়োজন অনুযায়ী জৈব সার প্রয়োগ করা হয়। মাটির ওপর খড় দিয়ে মালচিং প্রযুক্তির প্রয়োগ করা হয়, যা মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। এক বছর পরীক্ষার পর দেখা গেছে, প্রচলিত চাষের তুলনায় সংরক্ষণশীল চাষে বেশি ফলন মিলেছে। এই পরীক্ষণের মাধ্যমে আমরা আশাবাদী যে সংরক্ষণশীল চাষ পদ্ধতি ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্রিনহাউস গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে ফসলকে আরও সহনশীল করে তুলবে।