নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ফুলবাড়িয়ার ২৬৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘হুমগুটি’ খেলায় জনতার ঢল

Posted on January 15, 2025

ময়মনসিংহ ব্যুরো: ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় ২৬৫ বছর যাবত চলতে থাকা ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলা বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন তৎপরতা চালালেও নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ২৬৬তম ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলা দেখতে জনতার ঢল নেমেছিল।

মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) বিকেলে সাড়ে ৩টায় ফুলবাড়িয়ার লক্ষ্মীপুর বড়ইআটা এলাকায় অনুষ্ঠিত হয় এ ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলা।

এতে অংশ নেন হাজার হাজার খেলোয়াড়। ঐতিহাসিক এ হুমগুটি খেলা দেখতে সেখানে মানুষের ঢল নামে। শুরুতে প্রশাসন খেলা নিষিদ্ধ করায় উপস্থিতি কম হয়। তবে সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোক সমাগম বাড়তে থাকে।

স্থানীয়রা জানান , খেলায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে, বয়স্কদের চেয়ে উঠতি বয়সের তরুণদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি ছিল। খেলার মাঠের চারদিকে চলছিল হৈ-হুল্লোড়।

খেলায় ব্যবহার করা হয় ৪০ কেজি ওজনের পিতলের গুটি। হাজারো মানুষের ভিড়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায় ৪০ কেজি ওজনের পিতলের গুটি। এক গুটির দখল নিতে গ্রামের লাখো জনতার লড়াই। তবে রেফারিবিহীন এ খেলায় শুরু থেকে গুটি নিয়ে ব্যাপক কাড়াকাড়ি হলেও কোনও মারামারি হয়নি। তবে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খেলার রং বদলায়।পিতলের গুটি নিজেদের দখলে নিতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয় খেলায়। খাল-বিল ও মাঠ-ঘাট পেরিয়ে গুটি গুম না হওয়া পর্যন্ত চলে খেলা। এবারের খেলায় উপজেলার দেওখোলা ইউনিয়নের কালিবাজাইল গ্রামে হুমগুটি টেনে-হিঁচড়ে কাড়াকাড়ি করে গুম করে ফেলায় ওই গ্রামের খেলোয়াড়রা বিজয়ী হন। মূলত গ্রামটির অবস্থান পূর্বদিকে হওয়ায় পূর্বকে পূব্বা বলা হয়।

এর আগে মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) সকাল থেকেই ফুলবাড়ীয়া, মুক্তাগাছা, ত্রিশাল ও সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ঢাকঢোল ও বাদ্যযন্ত্রের তালে হাজারো খেলোয়াড় ও দর্শনার্থীরা আসতে থাকেন উপজেলার দেওখোলা ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের দশমাইল এলাকায় খেলার মাঠে। বিকেল ৩টায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয় খেলার মাঠ। এ সময় হাজার হাজার খেলোয়াড় হুমগুটি লুকাতে টানাটানি করতে থাকেন। ধীরে ধীরে খেলার আশপাশে দর্শনার্থী আরও বাড়তে থাকে। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে জনসমাগম জনস্রোতে পরিণত হয়।

খেলা দেখতে আসা তৌহিদ নামে একজন বলেন, ছোট থেকেই এ খেলা দেখে আসছি, আগে এক সপ্তাহ ধরে চলত এ খেলা। এ বছর শুরুতে প্রশাসন খেলা নিষিদ্ধ করায় উপস্থিতি কম। তবুও হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ফজলুর রহমান বলেন, গ্রাম বাংলার প্রাচীনতম খেলাধুলার মধ্যে হুমগুটি অন্যতম পুরোনো একটি খেলা। কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে খেলাটি। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাটি ধরে রাখতে হলে প্রতিবছর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

যদিও সোমবার (১৩ জানুয়ারি) রাত পৌনে ১২টার দিকে ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রুকনুজ্জামান জানিয়েছিলেন খেলায় বিশৃঙ্খলা ঘটে,অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটতে পারে। ফলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে খেলা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। সে অনুযায়ী সোমবার রাত থেকে খেলা বন্ধ করতে তৎপরতা চালাচ্ছে সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশ। রাতে খেলার মাঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অবস্থান থাকবে।প্রশাসনের নির্দেশনা অমান্য করে খেলার চেষ্টা করা হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফেরাতে চেষ্টা করবে। তবুও খেলা চালানো হলে, এর মাধ্যমে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে দায়ভার তাদের নিজেদেরকেই নিতে হবে।তবে খেলায় কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য,জনশ্রুতি আছে, মুক্তাগাছা জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী ও ত্রিশালের বৈলরের জমিদার হেম চন্দ্র রায় জমি পরিমাপের বিরোধ সমাধানে তাদের প্রজাদের মধ্যে কৌশল ও শক্তির খেলা হিসেবে বৃত্তাকৃতির বল ‘হুমগুটি’ খেলার আয়োজন করেছিলেন। দুই জমিদারের সীমানা তেলিগ্রাম বড়ইআটা গ্রামে ধানের পতিত জমিতে এর আয়োজন করা হয়।

খেলার শর্ত ছিল যে জমিদারের প্রজারা প্রায় ৪০ কেজি ওজনের এক পিতলের বলকে নিতে পারবেন সেই জমিদারের জমির পরিমাপ হবে সাড়ে ৬ শতাংশে এক কাঠা। পরাজিত জমিদারের এলাকার জমির পরিমাপ হবে ১০ শতাংশে এক কাঠা। জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর প্রজারা খেলায় বিজয়ী হন। এরপর থেকে জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর ‘পরগনা’ এলাকায় জমির পরিমাপ হয় সাড়ে ৬ শতাংশে এক কাঠা। জমিদার হেম চন্দ্র রায়ের এলাকার ‘তালুক’ জমির পরিমাপ হয় ১০ শতাংশে এক কাঠা।

সেই রেওয়াজ মেনে এখনো প্রতিবছর খেলার আয়োজন করা হয়। খেলোয়াড়রা পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ চার ভাগে বিভক্ত হয়ে খেলতে শুরু করেন। টেনেহিঁচড়ে কাড়াকাড়ি করে যে বা যারা এই গুটি গুম করে ফেলতে পারবেন, তারাই বিজয়ী।

খেলার দিন সকাল থেকে জেলার ফুলবাড়ীয়া, মুক্তাগাছা, ত্রিশাল, সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ঢাকঢোল ও বাদ্যযন্ত্রের তালে হাজারো খেলোয়াড়রা আসেন। ধীরে ধীরে দর্শনার্থী হয় লক্ষাধিক। এদিন গুটি খেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামে মেলা বসে।

ফুলবাড়িয়া পৌর এলাকার স্বপন, জামাল উদ্দিন ও আল আমিনসহ কয়েকজন জানান, এ খেলাকে কেন্দ্র করে উপজেলার গ্রামগুলোতে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। প্রতিটি বাড়িতে চলে আত্মীয়-স্বজনদের মিলনমেলা। পিঠাপুলি, পায়েস আর নানা ধরনের খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় অতিথিদের। এই উপজেলার মানুষ ‘হুমগুটি’ খেলাকে ঈদের আনন্দ মনে করে।