১০ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রুল, ফেঁসে যেতে পারেন ৮ অডিটর!

Posted on December 28, 2024

বিশেষ প্রতিবেদক : এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত ৭টি ব্যাংক হলো- ১. আল আরাফা ইসলামি ব্যাংক পিএলসি. ২. বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক পিএলসি. ৩. ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক পিএলসি. ৪. গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক পিএলসি. ৫. ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি. ৬. ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি. ৭. সোস্যাল ইসলামি ব্যাংক পিএলসি.।

এ ৭টি তফসিলি ব্যাংকগুলোর অডিট করেন- ১. হুদা ভাসী চৌধুরী এন্ড কোং ২. খান ওহাব শফিক রহমান এন্ড কোং ৩. শফিক বসাক এন্ড কোং ৪. একনবিন ৫. কাজী জহির খান এন্ড কোং ৬. এম. এম. রহমান এন্ড কোং।

উপরোক্ত ছয়টি ফার্মের ৮ পার্টনার হলো- ১. এসকে বসাক এফসিএ- অংশীদার শফিক বসাক এন্ড কোং ২. এমডি মনিরুজ্জামান এফসিএ- অংশীদার একনবিন ৩. ফারুক আহমেদ এফসিএ- অংশীদার খান ওহাব শফিক রহমান এন্ড কোং ৪. মোহাম্মদ শাহেদ এফসিএ- অংশীদার খান ওহাব শফিক রহমান এন্ড কোং ৫. এমডি নরুল হোসাইন খান এফসিএ- অংশীদার কাজী জহির খান এন্ড কোং ৬. মোহাম্মদ ফরকান উদ্দিন এফসিএ- অংশীদার এম. এম. রহমান এন্ড কোং ৭. সাব্বির আহমেদ এফসিএ- অংশীদার হুদা ভাসী চৌধুরী এন্ড কোং ৮. শওকত হোসাইন এফসিএ- অংশীদার হুদা ভাসী চৌধুরী এন্ড কোং।

দেশ-বিদেশে লক্ষ কোটি টাকা পাচারের সাথে জড়িত বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত এই ৭টি তফসিলি ব্যাংকের গত ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর শেষ হওয়া অর্থবছরের জন্য উপরোক্ত ৬ ফার্ম ও ৮ নিরীক্ষকগণ প্রচলিত আইন ও বিধি অমান্য করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর আন-কোয়ালিফাইড অডিট রির্পোট দেওয়ায় এই বিষয়ে জনস্বার্থে সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবী মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া এফসিএস হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো: আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি কাজী ওয়ালিউল ইসলামের দ্বৈত বেঞ্চে ১০২ (২) ধারায় একটি রিট দায়ের করেন। যার নাম্বর-১৫৩১২/২০২৪।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র এ্যাডভোকেট ফিদা এম কামাল ও সিনিয়র এ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আহসান উক্ত রিটের পক্ষে উল্লেখিত অডিট ফার্ম এবং অডিটরদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), আইসিএবি, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলকে আদেশ দেওয়ার জন্য রিটে প্রার্থনা করেন।

মামলার বিপক্ষে সরকার নিয়োগকৃত আইনজীবী হিসেবে ছিলেন- এ্যাডভোকেট মো: মনজুর আলম (ডেপুটি এ্যাটর্নী জেনারেল), এ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শোয়েব মাহমুদ (সহকারী এ্যাটার্নী জেনারেল), মো: ওবায়দুল রহমান তারেক (সহকারী এ্যাটর্নী জেনারেল) এবং এ্যাডভোকেট মো: আবুল হাসান (সহকারী এ্যাটর্নী জেনারেল)।

উভয় পক্ষের শুনানি শেষে হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চ পিটিশনে উল্লেখিত ৬টি অডিট ফার্ম ও ৮ অডিটরের বিরুদ্ধে অসত্য ও মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে জাল জালিয়াতিমূলক নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করে আইনগত করণীয় কার্য করতে কেন অর্থ মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), আইসিএবি, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলকে নির্দেশ প্রদান করা হবে না। এছাড়া আদালত কর্তৃক প্রতিপক্ষের প্রতি সঠিক বা যথাযথ মনে করলে অতিরিক্ত আদেশ বা আদেশসমূহ কেন প্রদান করা হবে না। তার কারণ দর্শানো পূর্বক রুল জারি করেছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীগণকে রুলের জবাব দেয়ার জন্য বলেছেন উচ্চ আদালত।

উল্লেখ্য, এর আগে একই আইনজীবী অডিটরদের অনিয়মের জন্য তাদেরকে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছেন। লিগ্যাল নোটিশ সংক্রাংন্ত জটিলতা নিরসনের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনজীবী উচ্চ আদালতে জনস্বার্থে রিট করেছেন বলে কর্পোরেট সংবাদকে জানান।

অন্যদিকে উল্লেখিত রিটের উপর রুল বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারী ঐ সব প্রতিষ্ঠানে জানতে চাইলে তারা বলেন, রিটের বিষয়ে তারা এখনও কিছু জানে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা হাতে পেলে করনীয় ঠিক করবে বলে জানান এছাড়া আইসিএবিতে ফোন করলে তারা এ বিষয় কথা বলতে চাননি।

এ বিষয়ে আইনজীবী মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া এফসিএস কর্পোরেট সংবাদকে বলেন, “অডিটরের দুনীর্তি বহু বছর ধরে চলে আসছে, তাঁরা মালিকদের কথা অনুসারে অডিট রিপোর্ট তৈরী করে আসছে, যা সংস্কার হওয়া দরকার। এই অডিটরগণের আন-কোয়ালিফাইড রিপোর্টের কারণে গত বেশ কয়েক বছর ধরে এস আলম গ্রুপ বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করলেও অডিট ফার্ম ও অডিটরের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক, এফআরসি, আইসিএবি, বিএসইসি কোন প্রকার শাস্তিমূলক ও ডিলিস্টিং করে নাই বলে উল্লেখ করেন।” এ কারণে রিটের আবেদন করা হয়।

মামলাটিতে আইনজীবী মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া অভিযোগ করেন, উল্লেখিত ৮ নিরীক্ষক তথা- ১. এসকে বসাক এফসিএ- অংশীদার শফিক বসাক এন্ড কোং ২. এমডি মনিরুজ্জমান এফসিএ- অংশীদার একনবিন ৩. ফারুক আহমেদ এফসিএ- অংশীদার খান ওহাব শফিক রহমান এন্ড কোং ৪. মোহাম্মদ শাহেদ এফসিএ- অংশীদার খান ওহাব শফিক রহমান এন্ড কোং ৫. এমডি নরুল হোসাইন খান এফসিএ- অংশীদার কাজী জহির খান এন্ড কোং ৬. মোহাম্মদ ফরকান উদ্দিন এফসিএ- অংশীদার এম. এম. রহমান এন্ড কোং ৭. সাব্বির আহমেদ এফসিএ- অংশীদার হুদা ভাসী চৌধুরী এন্ড কোং ৮. শওকত হোসাইন এফসিএ- অংশীদার হুদা ভাসী চৌধুরী এন্ড কোং আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা মানদন্ড, আর্থিক প্রতিবেদন আইন ২০১৫ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও ফিনান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) বিভিন্ন নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছেন।

রিটের অভিযোগ অনুযায়ী, এস. আলম গ্রুপ প্রায় ১ লক্ষ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা পৃথিবীর প্রায় ১০টি দেশে পাচার করেছে হুন্ডি, জালিয়াতি, ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। তাদের এই কর্মকান্ডে সহযোগিতা করেছে কয়েকটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নিরীক্ষক, যারা ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছে। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়েছে এবং আমানতকারীর জমানো টাকা ফেরত দিতে পারছে না।

এছাড়া সংশ্লিষ্ট অডিট রিপোর্টগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অডিটরগণ আর্ন্তজাতিক নিরীক্ষামান (আইএসএ) এবং বিআরপিডি সার্কুলার অনুযায়ী গোয়িং কনর্সান ইফেক্ট, দীর্ঘদিন ধরে চলা তারল্য সংকট, ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর), সংবিধিবদ্ধ লিক্যুইডিটি রিজার্ভ (এসএলআর) ঘাটতি, বেজল-৩ অনুযায়ী রিস্ক বেজড ক্যাপিটাল এডিকোয়েসি (আরবিসিএ) যথাযথ ঋণ শ্রেণীকরণ না করা, প্রভিশন ঘাটতি বিষয়ে এড়িয়ে যাওয়া, নামে-বেনামে ঋণ প্রদানের বিষয়ে মতামত না দিয়ে, রিলেটেড পার্টি ডিসক্লোজার ঠিকমত না করে, সিংগেল পার্টি এক্সপোজার লিমিট অতিক্রম করার বিষয়- ইত্যাদি কী পারফরমেন্স ইন্ডিকেটর (কেপিআই) বিষয়ে, ঝুকিপূর্ণ দূর্বল আর্থিক বিষয়ে উল্লেখ না করে আইন ও প্রচলিত বিধি অমান্য করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর আন-কোয়ালিফাইড অডিট রির্পোট দিয়েছেন।

রিটের অভিযোগে আরো রয়েছে সততা, সচ্ছতা, নীতিবোধ ইত্যাদি তোয়াক্কা না করে কী পারফরমেন্স ইন্ডিকেটর (কেপিআই) বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষকগণ বিপুল অর্থের বিনিময়ে গোপন আতাঁতের মাধ্যমে আনকোয়ালিফাইড বা পরিচ্ছন্ন নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রদান করায় ঐ ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এস আলম গ্রুপ ১.১৩ লক্ষ কোটি টাকা পাচার, হরিলুট ও আত্নসাৎ করার সুযোগ পায়। ফলে ঐ সব ব্যাংকের আমানতকারীগণ তাদের আমানত ও জামানত হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশী গণমাধ্যমে বিষয়টি ফুটে উঠে।

অর্থ উপদেষ্টা ড: সালেহ উদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ড. আহসান এইচ মনসুর বিভিন্ন গণমাধ্যমে অডিটর ও অডিট ফার্মের অর্থ পাচারের দায়বদ্ধতা থাকায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার বিষয় উল্লেখ করেন।

রিটের অভিযোগে বলা হয়েছে যে, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য ত্রুটিগুলোর মধ্যে রয়েছে: সম্পর্কিত পক্ষের লেনদেনের তথ্য গোপন, সঠিক ঋণ শ্রেণিবিন্যাস না করা, শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকের জন্য প্রযোজ্য ইনভেস্টমেন্ট ডিপোজিট রেশিও (আইডিআর) উল্লেখ না করা এবং স্ট্যাটুটরি লিকুইডিটি রেশিও অনুসরণে ব্যর্থতা। এসব তথ্য গোপন রেখে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি, যা বিনিয়োগকারীদেরকে বিভ্রান্ত করেছে এবং অবৈধ অর্থপাচারকে উৎসাহিত করেছে।

রিট পিটিশনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো-যেমন অর্থ মন্ত্রণালয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি এবং এফআরসি- তাদের আইনগত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তারা নিরীক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি।

পিটিশনের প্রমাণ হিসেবে আর্থিক প্রতিবেদন, নিরীক্ষা রিপোর্ট এবং ২০২৪ সালের আগস্টে দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো-তে প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এতে এস. আলম গ্রুপের আর্থিক দুর্নীতির বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। অভিযোগে দাবি করা হয়েছে যে, এস. আলম গ্রুপের এই কার্যক্রম দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের আঘাত হেনেছে। তারা বিদেশে "কানালি লজিস্টিকস প্রাইভেট লিমিটেড" নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছে, যার মূলধন বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ।

পিটিশনে আদালতের কাছে একটি রুল ইস্যুর আবেদন জানানো হয়েছে, যাতে সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষক এবং নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম কেন বাতিল হবে না, তা ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া, তাদের সার্টিফিকেট অফ প্র্যাকটিস (সিওপি) এবং ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) স্থগিত করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় সফল হলে দেশের আর্থিক খাতের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন পিটিশনের দায়িত্বরত বিজ্ঞ এই আইনজীবী।