মোহাম্মদ রিদুয়ান হাফিজ, কক্সবাজার প্রতিনিধি: চলতি রবি মৌসুমে কৃত্রিম সারের সংকট দেখিয়ে দাম বাড়ানোর অভিযোগ উঠেছে । সঠিক সময়ে সার না পাওয়া ও দাম বেশি হওয়ার কারনে জেলায় এই সংকট আরও গভীর আকার ধারণ করেছে। ডিলার, সাব-ডিলার এবং খুচরা বিক্রেতারা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ দামে ইউরিয়া, মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) ও ডাই এ্যামোসিয়াম ফসফেট ( ডিএপি) সার বিক্রি করছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক কৃষক।
কৃষকদের অভিযোগ, পরিবেশকরা (ডিলার) কৃষকদের কাছে সার বিক্রি না করে অতিরিক্ত দামে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন।বিএডিসির ডিলার সার বরাদ্দ পেয়েও প্রকৃত কৃষকদের না দিয়ে রাতারাতি খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। খুচরা বিক্রেতা নিচ্ছে চড়া মূল্যে। পরে সেই সার খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে কৃষকদের। ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা ডিএপি ও এমওপি সার বিক্রি করা হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে সাড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি। তাও মিলছে না চাহিদামত।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন কক্সবাজার ( বিএডিসি সার) আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দুই হাজার টন ধারণক্ষমতার গুদামে এমওপি ১ হাজার হাজার ৫'শ মেট্রিক টন মজুদ আছে। গত রোববার পর্যন্ত ২০ মেট্রিক টন বিক্রি করেছেন। টন প্রতি বিক্রি করেছেন ১৮ হাজার টাকা। ডিএপি ৯০০ টন মজুদ রয়েছেন। তারমধ্য গতকাল (৮ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ৭০ টন বিক্রি হয়েছে। টন প্রতি ১৯ হাজার টাকা। সরকারি নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ডিএপি প্রতিকেজি ১৯ টাকা, প্রতি বস্তা ৯৫০ টাকা, এমওপি কেজি ১৮ টাকা, বস্তা প্রতি ৯০০ টাকা এবং টিএসপি কেজি ২৫ টাকা, বস্তা প্রতি ১২৫০ টাকা। এদিকে টিএসপি সারের কোনো হদিস নেই। যদিও বিএডিসি বলছেন, সোমবার রাতেই জেলায় পৌঁছবে টিএসপি।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, সৌদিআরব ও মরক্কো থেকে ডিএপি, কানাডা ও রাশিয়া থেকে এমওপি এবং তিউনিসিয়া থেকে আমদানি হয় টিএসপি। কয়েকদিন আগে ডিএপি সার বোঝাই একটা জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করে। বর্তমানে খালাস হয়ে বিভিন্ন জেলায় চলে যাচ্ছে। কিন্তু টিএসপি'র আমদানির সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। যার কারনে জেলায় টিএসপির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বিএডিসির ( সার) দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, তিউনিসিয়া থেকে টিএসপি সার নিয়ে একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে। কিন্তু কতটুকু সত্যি এখন বলা যাচ্ছে না।
কৃষকদের অভিযোগ, ডিলারেরা কৃষকদের কাছে সার বিক্রি না করে অতিরিক্ত দামে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন। পরে সেই সার খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে কৃষকদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এর পরও চাহিদামত সার পাচ্ছেন না তারা। যদিও কৃষি অধিদপ্তর সারের কোনো সংকট নেই বলে দাবি করছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, জেলায় সারের চাহিদা রয়েছে ৪০ হাজার মেট্রিক টন। তারমধ্যে টিএসপি ৭ হাজার ৭২৩ টন, ডিএপি ১২ হাজার টন এবং এমওপি ৫ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। জেলায় নিবন্ধিত ডিলারের সংখ্যা ৮৪ জন।
সরেজমিনে গিয়ে ও কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন করে ডিলার নিয়োগ দিয়েছেন সরকার। কিন্তু অধিকাংশ ডিলারের দোকান থাকে বন্ধ। এছাড়া যেসব ডিলারের দোকান খোলা পাওয়া যায় তারা বেশিরভাগই সার নেই বলে জানায়। আর এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন খুচরা বিক্রেতারা। বাজারে ৩৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে ইউরিয়া, টিএসপি বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকায়, এমওপি বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। যা সরকারের দামের চেয়ে কেজিতে ২০-২৫ টাকার বেশি। ডিলার ও খুচরা সার বিক্রেতারা দোকানে মূল্য তালিকা টাঙ্গিয়ে রাখলেও সে অনুযায়ী বিক্রি করছেন না তারা। প্রতি বস্তা সার সরকারি মূল্যের চেয়ে প্রকারান্তরে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করছেন। কৃষক সার কিনতে গেলে ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা সংকটের কথা বলেন। তবে দাম বেশি দিলেই সার পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া বিক্রেতারা কৃষকদের কোনো সঠিক বিক্রয় রসিদ দেন না। আর যেটা কৃষকদের দেন তার চেয়ে বেশি দাম দিয়ে সার কিনতে হয়। ডিলার/খুচরা বিক্রেতাদের কাছে তারা এভাবে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সরকার অনুমোদিত এই সকল ডিলার/সাব-ডিলাররা সরকারি নির্দেশনা না মানায় দেখা দিয়েছে সারের কৃত্রিম সংকট। আর এতে বাড়বে কৃষি উৎপাদন খরচও।
খুচরা বিক্রেতা ( সাব ডিলার) বাহারছড়া বাজার মেসার্স আল মদিনা বীজ বিতানের প্রোপাইটর খোরশেদ আলম বলেন, সারের সংকট দেখা দিয়েছে। ডিলারের কাছে সার অর্ডার করেও সার পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া টিএসপি নেই বললেই চলে।
বিমান বন্দর সড়কের কৃষি বিপনি'র প্রোপাইটর আজিজুর রহমানের (ডিলার) কাছে জানতে চাইলে তাঁর ছেলে রাকিব বলেন, এমওপি ৭০ টাকা, টিএসপি ২০০ টাকা, ডিএপি ১৫০ দরে সব জায়গায় বিক্রি হচ্ছে। পরে সাংবাদিক পরিচয়ে আবার কল দিলে তিনি অস্বীকার করে বলেন, আমি সরকারি দামেই সার বিক্রি করছি। আমি ছোট ডিলার। চাহিদা অনুযায়ী আমাদের বরাদ্দ কম। বিএডিসি থেকে ১ টন এমওপি, ২ টন ডিএপি সার পেয়েছি।
খুরুশকুল রাস্তার মাথা মদিনা কৃষি বিতানের ডিলার মো: নোমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমওপি ২৫ টাকা, ডিএপি ৩০ এবং ইউরিয়া ৩৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। টিএসপি সারের চাহিদা থাকলে-ও বিএডিসি থেকে না পাওয়ায় বলা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশন কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম বলেন, দাম বেশি নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। টিএসপি সারের সংকট ছিল। কিন্তু বিএসডি থেকে জানতে পারলাম সার সোমবার রাতেই গুদামে আসবে। কৃষকের আর কোন সমস্যা হবে না৷ ডিলাররা দাম নেওয়ার কারন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কেউ বেশি নেওয়ার অভিযোগ পেলে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি সার) উপ-সহকারী পরিচালক ইকবাল বাহার বলেন, টিএসপি সারের সংকট থাকবে না। আজ রাতেই আসছে (সোমবার) ৮০-১০০ টন টিএসপি। এভাবে প্রতিদিন ৪/৫ টি গাড়ি ঢুকবে। প্রথম পর্যায়ে ৯০০ মেট্রিক টন টিএসপি বরাদ্দ আসবে। এছাড়া গুদামে এমওপি ১৫০০ টন ও ডিএপি ৯০০ টন মজুদ আছে। তিনি বলেন, সার বোঝাই আরও একটি জাহাজ কয়েকদিনের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়বে। দাম বাড়ার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এদিকে গত ২৪ নভেম্বর জেলায় সারের কৃত্রিম সংকট দেখা দেওয়ার অভিযোগ পেয়ে জরুরি সভা করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সভায় সংশ্লিষ্ট সকলেই উপস্থিত ছিলেন।
জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. বিমল কুমার প্রামাণিক বলেন, কিছু ডিলার সারের দাম বেশি নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পেয়েছি। কয়েকদিন আগেও উখিয়াতে একজন ডিলারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, টিএসপি সারের একটা সংকট দেখা দিয়েছিলো। কিন্তু সেই সংকট আর থাকছেনা। সোমবার রাতে গুদামে ঢুকতে শুরু করেছে টিএসপি। ইতিমধ্যে ৮ জন ডিলার গাড়ি আপলোড করতে বিএসডিসিতে রয়েছেন।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
কক্সবাজারে সারের কৃত্রিম সংকটে দিশেহারা কৃষক https://corporatesangbad.com/495207/ |