কর্ণফুলীর পাঁচ ইউনিয়নে প্রশাসক নিয়োগেও মিলছে না সেবা

Posted on December 7, 2024

নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদে গত চার মাস ধরে কার্যত কোনো জনপ্রতিনিধি নেই। ক্ষমতার পালাবদল, রাজনৈতিক চাপ এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে বেশিরভাগ চেয়ারম্যান ও মেম্বার সেবা কার্যক্রম থেকে দূরে সরে গেছেন।

সরকারি নির্দেশনায় প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হলেও ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম ও নাগরিক সেবা কার্যত অচল। এতে করে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, নাগরিক সনদ, ওয়ারিশ সনদ, ট্রেড লাইসেন্সসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার সাধারণ মানুষজন।

জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতির কারণে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চেয়ারম্যানদের বেশিরভাগই নতুন সরকারের সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের রোষানল এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার শঙ্কায় পরিষদে আসছেন না।

চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সোলায়মান তালুকদার একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল মামলায় পলাতক রয়েছেন। অন্যদিকে, জুলধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী নুরুল হক হৃদরোগে মারা যাওয়ার পর থেকে ইউনিয়নটি চেয়ারম্যানশূন্য।

শিকলবাহা, বড়উঠান ও চরপাথরঘাটার চেয়ারম্যানরা এলাকা ছাড়েননি, তবে সেবা প্রদানে সক্রিয় নন। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সেবাগুলো চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর ছাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, যার ফলে জনগণের দৈনন্দিন কার্যক্রমে বড় ধরনের ভোগান্তি দেখা দিয়েছে। স্থানীয় মেম্বার মো. ফরিদ জুয়েল জানান, আমাদের পরিষদে জনগণের চাপ প্রতিদিন বাড়ছে। কিন্তু জনপ্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে কাজ করা প্রায় অসম্ভব। চেয়ারম্যান কিংবা প্যানেল চেয়ারম্যান কে দায়িত্ব দিলে জনগণ উপকৃত হতো।

প্রশাসনের কার্যক্রম ও সীমাবদ্ধতা বিষয়ে জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা নাগরিকদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন। ইউএনও ও এসিল্যান্ডের তত্ত্বাবধানে ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে কিছু সীমিত সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে এর মান এবং নাগালের অভাবে জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ ভোগান্তি বেড়েছে। কিছুদিন আগেও বড়উঠানে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিলো।

যদিও স্থানীয় প্রশাসন বলছে, জনপ্রতিনিধিদের শূন্যতা পূরণে তারা কাজ করছেন, কিন্তু পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

পরিষদে সেবা অচলাবস্থা বিষয়ে চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের বাসিন্দা রুবেল অভিযোগ করে বলেন, মৃত্যুসনদ, নাগরিক সনদ, কিংবা জন্ম নিবন্ধনের জন্য আমাদের কয়েকবার ইউনিয়ন পরিষদে যেতে হচ্ছে। চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর ছাড়া কোনো কাজ হচ্ছে না। উপজেলা থেকে যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁকেও ঠিক মতো পাওয়া যায় না।

স্থানীয় একাধিক মেম্বাররা বলেছেন, পরিষদের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। সরকার থেকে প্রকল্পের বরাদ্দ পেলেও, সেগুলোর কাজ বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। অনেক মেম্বার তাদের প্রাপ্য বিল পাচ্ছেন না। বড়উঠানের এক মহিলা সদস্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে বলেন, আমরা জনগণের জন্য কাজ করতে চাই, কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতার কারণে কোনো কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না।

স্থানীয় বাসিন্দারা দ্রুত জনপ্রতিনিধিদের ফিরিয়ে এনে পরিষদ কার্যক্রম সচল করার দাবি জানিয়েছেন। চরপাথরঘাটা ইছানগরের বাসিন্দা মো. জুয়েল বলেন, প্যানেল চেয়ারম্যান বা অন্য জনপ্রতিনিধিদের হাতে দায়িত্ব দিলে পরিষদের কার্যক্রম আবারও চালু হতে পারে। অন্যতায় তেমন সুফল পাবে না জনগন। আরেকজন নাগরিক মনির হোসেন বলেন, যেসব জনপ্রতিনিধি দায়িত্ব পালনে ভয় পাচ্ছেন, তাদের পদত্যাগ করা উচিত। জনগণ জনপ্রতিনিধি ছাড়া পরিষেবা পাচ্ছে না।

প্রশাসক ও জনপ্রতিনিধিদের মতবিরোধে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৯ সেপ্টেম্বর কর্ণফুলীর পাঁচটি ইউনিয়নে চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিত দেখিয়ে প্রশাসনের হাতে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। তবে চেয়ারম্যানরা দাবি করেছেন, তারা নিয়মিত পরিষদে উপস্থিত ছিলেন এবং সেবাগ্রহীতাদের প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করেছেন।

চরলক্ষ্যার বাসিন্দা মো. সুমন বলেন, 'আমাদের পরিষদে কোনো তালা দেওয়া হয়নি। প্রশাসনের দাবি সঠিক নয়।' অন্যদিকে, ইউএনও-এসিল্যান্ডের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে জনগণের চাপের মুখে পরিষদের কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।

কর্ণফুলীর স্থানীয় জনগণ মনে করছেন জনপ্রতিনিধি ছাড়া প্রশাসন সেবা কার্যক্রম চালাতে পুরোপুরি অক্ষম। আরেক বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম বলেন, প্রশাসনের উচিত প্যানেল চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া। পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনপ্রতিনিধি ফেরাতে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে এবং স্থানীয় সরকারের কার্যক্রম সচল রাখতে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাই প্রধান।

কর্ণফুলীর সহকারী কমিশনার (ভূমি) রয়া ত্রিপুরা বলেন, পরিষদগুলোর সেবা কার্যক্রম কীভাবে সচল করা যায়, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। স্থানীয়দের সমস্যা ও অভিযোগ জানানো হলে দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

কর্ণফুলী ইউএনও মাসুমা জান্নাত জানান, 'সেবা প্রদানের সংখ্যা দেখলে বুঝা যাবে ভোগান্তি হচ্ছে কিনা। মেম্বাররা এ ধরনের কোন অভিযোগ করেনি আর প্রকল্পের বিল বকেয়া আটকে নেই।'

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো. নোমান হোসেন বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দ্রুত সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।

কর্ণফুলীর পাঁচ ইউনিয়নের নাগরিক সেবা কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের কার্যক্রম সীমিত এবং জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জনপ্রতিনিধিদের দ্রুত দায়িত্বে ফেরানোর দাবি জানাচ্ছেন। সরকারের উচিত এই সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা।