বদরুল ইসলাম বাদল।।
বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। সমুদ্রতীরের লাগোয়া বাংলাদেশের ১৯টি জেলা জুড়ে বিস্তৃত উপকূলীয় জনপদ। কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় অংশে চকরিয়া-পেকুয়ায় অনেক মানুষের বসবাস। প্রকৃতির সাথে বেড়ে উঠা প্রাকৃতিক দূর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন ধারণ করে এরা। গোছানো গৃহস্থ সরল সহজ এসব মানুষ সামাজিকবন্ধন নিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ বসবাস। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টিতে বন্যা সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে রয়। আবার অরক্ষিত বেড়িবাঁধ,দারিদ্র্যতা,লোকালয়ে লবনাক্ত পানি, সুপেয় পানি সংকট, সংকটাপন্ন কৃষি,প্রভৃতি নিয়ে উপকূলীয়বাস ঝুঁকিমুক্ত থাকে না কখনো। প্রকৃতির সাথে জড়ানো এসকল মানুষ প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। প্রাকৃতিক দূর্যোগে বসতবাড়ি ধূলিসাৎ হয়ে গেলে, তাঁরা গড়ে তুলে নতুন করে। অনেকবার ভাঙে বারবার তৈরী করে। নষ্ট হয়ে যায় ফসল, আবারও রোপণ করে।উপড়ে যায় গাছ, তচনচ হয়ে যায় সব।কিন্তু তারপরও জীবন জীবিকা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। মনোবল হারায় না। দুর্বল হয় না। নতুন করে বাঁচার সপ্ন নিয়ে এগিয়ে যায়।
নদী,খালবিল,জলাশয়ে ভরা গ্রামীণ লোকালয়। চকরিয়া নিম্নাঞ্চলের ঢেমুশিয়াখালসহ সবই একসময় উম্মুক্ত ছিল। গ্রামের নারীপুরুষ জাল নিয়ে অবাধে মাছ ধরতো। সময় অসময়ে দূরন্ত ছেলেমেয়েরা সাঁতার দিতো, শাপলা তুলতো। দুই কিনারায় গড়ে উঠে বসতি। খালে নৌকা চলতো,দাঁড় বেয়ে, পাল তুলে। কোথাও কোথাও ইঞ্জিন চালিত নৌকা করে হাটবাজারে পন্যসামগ্রি আনা-নেওয়া হতো। অনাবৃষ্টিতে খালের মিটাপানিতে ফসল রক্ষা করা হতো। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বনির্ভরতার সাথে জড়িত এসব খালবিল, জলাশয়। খালের পাড়ে খালি জায়গা সমূহ গোচারণভূমি হিসাবে ব্যবহার হতো। সর্বোপরি প্রবাহমান পানির স্রোতের সাথে ময়লা আবর্জনা ধুয়েমুছে সাগরে চলে গিয়ে পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা পেতো গ্রামীণ জনপদের মানুষ। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এক পর্যবেক্ষণে মহামান্য হাইকোর্ট নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী সমূহকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেন।ঢেমুশিয়া ইউনিয়নের একজন বয়স্ক সচেতন কৃষক আক্ষেপ করে বলেন,"আমাদের সব ঐতিহ্য এখন অতীত। লোভী মানুষের নজর পড়ে এ অঞ্চলের উপর। ভুলভাল যুক্তি দিয়ে প্রশাসনকে কব্জা করে প্রবাহমান খালকে জলমহাল হিসেবে ইজারা নিয়ে নেয়। বন্ধ হয়ে যায় প্রকৃতিপ্রাপ্ত সমস্ত সুযোগ। তার মতে "ইজারার নামে বর্গী এলো দেশে" নতুন বেশে, উপকূলীয় জনপদে। বন্ধ হয়ে যায় খালের অবাধ ব্যবহার। অপরিকল্পিত ভাবে বাঁধ নির্মাণ করায় রুদ্ধ হয়ে পড়ে পানি প্রবাহ। স্লুইস গেইটের জলকপাট নিয়ে চলে উপনিবেশিক শাসন। ইচ্ছে মাফিক নিজেদের স্বার্থে লবণ পানি ঢুকিয়ে ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে বারবার। "তাই তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন "নির্দিষ্ট কিছু মানুষের স্বার্থে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে জিম্মি করা অসাংবিধানিক, অমানবিক। "আমরা ঢেমুশিয়াবাসী" সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ইজারা প্রথা বাতিলের দাবি জানাচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশা মানুষের একই দাবি ঢেমুশিয়া জলমহাল ইজারা বাতিল করা হউক। তাঁরা ঢেমুশিয়াখাল উম্মুক্ত চায়। এনিয়ে জেলা প্রশাসকের প্রতি আবেদন করছে ভুক্তভোগী অসহায় জনসাধারণ।
অজপাড়াগাঁ সহ দেশজুড়ে কচুরিপানা একটি বহুমাত্রিক সমস্যার নাম। কচুরিপানায় অযাচিত দখল হয়ে যাচ্ছে নদী, খাল, বিল, জলাশয়। এই জলজ উদ্ভিদ দ্রুত বংশবিস্তার করে। ফলে সল্প সময়ে খাল,বিল,দিঘি ভরে যায়। কচুরিপানা পঁচে গিয়ে আবর্জনায় খাল ভরাট হয়ে যায়। তাই নদীর নাব্যতা হারানোর জন্য কচুরিপানা অনেকটাই দায়ী,মনে করে নদী বিশেষজ্ঞ মহল। ফলে ছড়া খালে পরিনত হওয়ায় নৌকা চলতে পারে না, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ক্ষমতা হ্রাস পায়।ভারী বৃষ্টিতে লোকালয়ে পানিতে একাকার হয়ে পড়ে। কচুরিপানা পঁচে পানি দূষিত হয়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায়। ভূমি দস্যুরা কচুরিপানাকে তাদের লালসা চরিতার্থের ঢাল হিসেবেও ব্যবহার করে।
খালখেকো দস্যুরা প্রথমে কচুরিপানাকে বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখে। তখন খালের পাড়ের কিনারা ঘেষে আগাছা জমে হরেক রকম গাছের প্রজাতির জন্ম নেয়। তারপর সুযোগ বুঝে খাল ভরাট করে দখলে নিয়ে ঘিরে রাখে এসকল পরিবেশ বিধ্বংসী সম্প্রদায়। এভাবেই আস্তে আস্তে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে খালবিল জলাশয়।এই নিরিখে ঢেমুশিয়া জলমহাল, পোড়া মাতামুহুরি, বুড়া মাতামুহুরি শুয়োর মরা খালকে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। পেকুয়ার সাংবাদিক জহিরুল ইসলাম বলেছেন, "পেকুয়া সদর ইউনিয়নের গুলদি খালটিতে যখন শুষ্ক মৌসুমে বোরো চাষের জন্য মাতামুহুরি নদী থেকে মিঠা পানি ঢুকানো হয়,তখন কয়েক মাসের মধ্যে খালটি কচুরিপানায় ভরে যায়, বৈশাখে ধান কাটা মৌসুমের পরে ও-ই খালে আবার নদী থেকে লবনাক্ত পানি ঢুকালে এই কচুরিপানা পঁচে গিয়ে খালের তলদেশে গিয়ে জমা হয়। এভাবে বছরের পর বছর চলতে থাকায় খালটি এখন প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। অবশ্যই এ ধরনের খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার অন্যান্য কারণও আছে"।
উচ্চ ফলনশীল ফসল উৎপাদনে সুফলা মাটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। টেকসই কৃষি উন্নয়নে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা বজায় থাকা আবশ্যক।
৮০ দশক থেকে এ অঞ্চলে চিংড়ি চাষের নিমিত্তে কৃষি জমিতে লবণ পানি উত্তোলন শুরু হয়েছে। এভাবে বছরের পর পর উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি জমি লবণ পানিতে তলিয়ে রাখায় জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায়।আর তাঁর সাথে পচনশীল বিভিন্ন বস্তু আবদ্ধ পানির তলে মাটির সাথে মিশে মাটি দূষণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে মাটিতে বসবাসকারী উপকারী অনেক অনুজীব মারা যেতে শুরু করে। প্রকৃতির "লাঙ্গল" খ্যাত কেঁচো আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে অসহনীয় লবণাক্ত আবহাওয়ার কারণে। ফলে পরিবেশ দূষণের সাথে মৃত্তিকা দূষণও ভয়াবহ আকার ধারণ করায় বিভিন্ন প্রজাতির মিঠা পানির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, মানুষের পরিচিত অনেক রকমের পশুপাখি এখন উড়তে দেখা যায় না। ধান উৎপাদনেও লবনের বিরূপ প্রভাব। এভাবে ফসলের উৎপাদন ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। লবণাক্ততায় ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি আমাদের বেঁচে থাকার তাগিদকে সামনে এসে নাড়া দিচ্ছে প্রবল ভাবে। ঢেমুশিয়ার বাসিন্দা কক্সবাজার জেলা আদালতের এডভোকেট আমির হাফজি বলেন, "বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ। শৈশব থেকে শুনে আসা,"মাছে ভাতে বাঙালী "ও "গোলা ভরা ধান গোয়াল ভরা গরু" নিয়ে বর্তমানে এই প্রবাদের মিল খুঁজে না পেলেও মাতামুহুরি নদী বেষ্টিত শাহারবিল, পশ্চিম বড় ভেওলা, কোণাখালী সহ ঢেমুশিয়া ইউনিয়নের কৃষক শুষ্ক মৌসুমে মাতামুহুরি নদীর পানি ও জলমহালের উপর নির্ভরশীল। তাই কৃষি নির্ভর অত্র মিটা পানির উৎস জলমহাল খালটি লবনাক্তমুক্ত ও কচুরিপানা মুক্ত রাখা প্রয়োজন বলে মনে করি"। কোণাখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা সমাজকর্মী জাফর আলম সিদ্দিকী,আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে ভঙ্গুর অরক্ষিত বেড়িবাঁধ নির্মাণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে দাবি রাখেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর দিয়ে বলেছেন,"এক ইঞ্চি জমিও চাষাবাদ থেকে যেন খালি না যায়"।কিন্তু সমুদ্রের লবণ পানি ঢুকিয়ে মাছের ঘের করার কারণে শতশত একর জমি অনাবাদি রয়ে যায় উপকূলীয় এই এলাকায় ।প্রতি তিন বছর পরপর ঢেমুশিয়া জলমহাল ইজারা দেয়া হয়ে থাকে। ১৪২৭ বাংলা সনে (২০২০ সাল) তিন বছরের জন্য ইজারা দেয়া জলমহালটি আগামী বৈশাখ মাসে শেষ হওয়ার কথা। জনস্বার্থে জলমহালটি ইজারা দেয়া থেকে বিরত রাখার দাবি করছেন এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে উপকূলের প্রাণ প্রকৃতি ও জীবন জীবিকা সুরক্ষায় কচুরিপানা পরিষ্কার করা এখন সময়ের দাবী।দরকার নদী শাসন, খনন এবং দখলমুক্ত নদী,খাল,বিল,জলাশয়।
লেখক: সদস্য বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
জলমহাল ও কচুরিপানা উপকূলীয় চকরিয়া-পেকুয়াবাসীর গলার কাঁটা https://corporatesangbad.com/49406/ |