পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের উদ্যোগকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধুবাদ

Posted on October 21, 2024

অধ্যাপক ড. মোঃ আইনুল ইসলাম।।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ভূয়সী প্রশংসা ও সাধুবাদ জানাচ্ছে। একই সঙ্গে অর্থ পাচারের উৎসসমূহ বন্ধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টাকে সর্বোতভাবে সমর্থন জানাচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি মনে করে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চালকের আসনে থাকা জ্ঞানাভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা দেশের অর্থনীতিতে ক্যানসার ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়া কালোটাকা, অর্থপাচার ও দুর্নীতির মতো মৌলিক সমস্যা নিমূর্লে সফল হবেন। কালোটাকা, অর্থপাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন অর্থনীতি সমিতি প্রয়োজনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সবধরনের সহায়তা দেবে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, দুর্নীতিগ্রস্ত অর্থ পাচার যৌক্তিক কারণেই অত্যন্ত নিন্দনীয় ও ঘৃণ্য অপরাধ। কারণ রাষ্ট্রের উন্নয়নে তা মারাত্মক ঋণাত্মক প্রভাব ফেলে। ২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর সরকারের ঘোষিত জাতীয় বাজেটের বিপরীতে অর্থনীতি সমিতির বিকল্প জাতীয় বাজেট প্রস্তাবনায় বরাবরই বলা হচ্ছে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অন্তত ৩ শতাংশের সমপরিমাণ মতো অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে, যা দেশে বহুমাত্রিক বৈষম্য ও দারিদে্র্যর বিস্তার ঘটাচ্ছে এবং সর্বগ্রাসী দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। অর্থনীতি সমিতির হিসাবে ২০১৮—১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে অর্থ পাচারের পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৭৫,৭৩৪ কোটি টাকা, যা একই অর্থবছরের সৃষ্ট মোট কালোটাকার (৮ লক্ষ ৪১ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা) ৯ শতাংশের সমপরিমাণ এবং একই অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১৬.৩ শতাংশের সমপরিমাণ। এ হিসাবে ৪৬ বছরে (১৯৭২—৭৩ থেকে ২০১৮—১৯ অর্থবছরে) দেশের মোট অর্থ পাচারের পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৭ লক্ষ ৯৮ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। যেখানে প্রতিবছর বাজেট সংকুলানের জন্য সরকারকে দেশি—বিদেশি বিপুল ঋণ নিতে হচ্ছে, সেখানে মোট বাজেটের প্রায় এক—পঞ্চমাংশের সমপরিমান অর্থ পাচার হয়ে যাওয়া জাতি হিসেবে অত্যন্ত লজ্জা ও উদ্বেগের।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। তবে মনে করে, যেহেতু দুর্নীতি—কালোটাকা—অর্থ পাচার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টেকসই ও উন্নত করার পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকে পরিণত হয়েছে, সেহেতু ‘দুর্নীতি, কালোটাকা ও অর্থ পাচার কমিশন’ শীর্ষক একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা হোক। ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২৩—২৪: বৈষম্য নিরসনে জনগণতান্ত্রিক বাজেট’ দলিলে এই কমিশনের বিশদ রূপরেখা দেওয়া আছে, যেখানে বলা হয়েছে, এই কমিশনের প্রধান কাজ হবে দুর্নীতি, কালোটাকা ও অর্থ পাচারসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি গভীর অনুসন্ধান ও গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড নিরন্তর চালিয়ে যাওয়া এবং অনুসন্ধান—গবেষণাফল প্রতি তিন মাস অন্তর দেশের সকল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে জনগণকে অবহিত করা। একই সাথে কমিশনের নিজস্ব ভেরিফায়েড ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা। প্রস্তাবিত এ কমিশন যেহেতু স্বাধীন, সেহেতু কমিশন তার কাজের জন্য সরাসরি জনগণের কাছেই জবাবদিহি করবে (প্রয়োজনে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্র প্রধানের কাছে)। মোট ৯ জন সদস্য নিয়ে প্রস্তাবিত এ কমিশন গঠিত হবে, যার মধ্যে ১ জন প্রধান কমিশনার (নারী অথবা পুরুষ) ও ৮ জন কমিশনার (৪ জন নারী ও ৪ জন পুরুষ)। কমিশন তার কর্মসম্পাদনে মোট ১০০ জন গবেষক—গবেষণা সহকারী নিযুক্ত করবে। প্রধান কমিশনারসহ সকল কমিশনার নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রের প্রধান; নিযুক্তিকাল হবে ৩—৫ বছর; কমিশনারদের যে—কেউ যেকোনো সময় ইস্তফা দিতে পারবেন (ইস্তফার কারণ উল্লেখ অথবা উল্লেখ না করে); এবং নিযুক্তিকালে ছেড়ে চলে যেতে বলার দায়দায়িত্ব থাকবে রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে। কমিশনের সদস্য হতে পারবেন শুধু তারা, যারা স্ব—গুণাবলি, দেশপ্রেম ও জ্ঞানসমৃদ্ধতার কারণে জনসাধারণ্যে পরিচিত এবং সম্মানিত। রাষ্ট্র কমিশনকে এককালীন ১০০ কোটি টাকার ৩ বছরের বাজেট অগ্রিম দেবে (প্রধান কমিশনার রাষ্ট্রের সাথে বাজেটে স্বাক্ষর করবেন), কমিশন প্রতি ৩ মাস অন্তর কমিশনের আয়—ব্যয় জনসম্মুখে উপস্থাপন করবে; গঠনের ৩ মাসের মধ্যে রাষ্ট্র কমিশনের জন্য বহুতল স্থায়ী কমিশন ভবনের ব্যবস্থা করবে; রাষ্ট্র কমিশনে কর্মরত সকলের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। প্রস্তাবিত এ কমিশন স্বাধীন, বিধায় কমিশনের সাথে বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশনের তেমন কোনো সম্পর্ক থাকবে না। তবে স্বাধীন এই কমিশন প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন কমিশন সম্পর্কে বলতে পারবে। দুর্নীতির কারণে, কালোটাকার মালিক হবার কারণে, অর্থ পাচার করার কারণে প্রস্তাবিত এই কমিশন কাউকে শাস্তি দিতে পারবে না, শুধু সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশ্লেষণপূর্বক রাষ্ট্রপতি এবং/অথবা প্রধান বিচারপতির বরাবর শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুপারিশ প্রেরণ করতে পারবে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, এই প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে দারিদ্র্য ও বৈষম্য প্রশমিত করে বাংলাদেশ দ্রুতই সমৃদ্ধ ও শোভন একটি দেশে পরিণত হবে।