বিচারক আইনজীবীকে থাপ্পর দিতে চাইলেন: একটি তুলনামূলক আলোচনা

Posted on October 17, 2024

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক।।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান থেকে জানা যায়, মহামান্য হাইকোর্টে আগাম জামিন আবেদন মেনশনের সময় গতকাল ১৫ অক্টোবর সকাল ১১টার দিকে আইনজীবীদের পক্ষে ব্যারিস্টার আশরাফ রহমান বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আপনার আদালতের বেঞ্চ অফিসারেরা অনিয়ম করে সব জমা করা মামলা ঠিকমতো দৈনিক কার্যতালিকায় দেননি। এতে অসংখ্য আইনজীবী বঞ্চিত হয়েছেন।’ বেঞ্চ কর্মকর্তারা অনিয়ম ও অর্থ লেনদনের মাধ্যমে তালিকা করেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

একপর্যায়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি তাঁর উদ্দেশে বলেন, ‘চেনো আমাকে, এক থাপ্পড় দেব।’ আমি বারের নেতা ছিলাম। তোমাকে কে সাহস দিয়েছে আমার আদালতের বিরুদ্ধে কথা বলতে? এজলাস থেকে বের হও, বেয়াদব, তোকে থাপ্পড় দিয়ে পুলিশে দেব।’ এ নিয়ে হইচই ও হট্টগোল শুরু হয়। পরে বিচারপতিরা এজলাস ত্যাগ করেন। এ নিয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ২৬ আইনজীবী। প্রধান বিচারপতি দ্বৈত বেঞ্চটি পুনর্গঠন করে দেন। বিচারকের পক্ষে শ্লোগান দেন আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা। এ নিয়ে ১৬ অক্টোবর আওয়ামীপন্থী বিচারকদের অপসারণের দাবীতে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গনে জড়ো হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। প্রশাসনিকভাবে বিষয়টি সুন্দর ও সুষ্ঠু সমাধানের জন্য মাননীয় প্রধান বিচারপতি ১২ বিচারপতিকে চায়ের দাওয়াতে নিয়ে গিয়ে তাঁদের ছুটি দিয়ে দেন।

লর্ড ম্যাকমিলানের মতে “অন্য কোন পেশা মানবজীবনকে এত স্পর্শ করে না।” একজন অ্যাডভোকেট তার অবস্থানের প্রেক্ষিতে আদালতে অফিসার এবং বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত শ্রেণীর অন্তর্গত। অসংখ্য মৌলিক আইন গ্রন্থের প্রণেতা মরহুম গাজী শামসুর রহমান বলেছিলেন, কোন মানুষ ভ্রমের ঊর্ধ্বে নয়, সম্ভবত বিচারকও নয়। বিচারকের ভ্রম ধরিয়ে দিতে পারে শুধু সেই ব্যক্তি যিনি জ্ঞানে, গুণে, মর্যাদায় এবং অবস্থানে বিচারকের সমকক্ষ। সেই ব্যক্তিই অ্যাডভোকেট।

আদালতের ক্ষমতা ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে বিচারকগণ যেমন কতিপয় বিশেষাধিকার ভোগ করেন, আইন প্রণয়নকারী সংস্থা হিসেবে জাতীয় সংসদের সদস্যগণও তেমনি কতিপয় বিশেষ অধিকার ভোগ করার অধিকারী। তেমনি বিচারক কর্তৃক অ্যাডভোকেট এর অবমাননা আদালত অবমাননার শামিল।

একজন অ্যাডভোকেট যখন তার মক্কেলের মামলা পরিচালনা করেন, তখন যদি আদালত অর্থাৎ বিচারক তার আচরণ নিয়ে মন্তব্য করেন, তবে আদালত অবমাননার অপরাধ হতে পারে। (৩৫সি, ডব্লিউ, এন ১৮৯)
যদি আদালত কোন মোকদ্দমা শুনানিকালে পুলিশ গার্ড ডাকেন এবং কোন যথার্থতা ছাড়াই আইনজীবীকে আদালত কক্ষ হতে বের করে দেন তবে তা আদালত অবমাননার শামিল। (Prag Das Advocate V.Sir P.C. Agrwal’1975 ALI .L.J.41; 1975 Cr. L. J. 659)
১। কোন আইনজীবী যখন কোন মামলা পরিচালনা করেন তখন তিনি নিরংকুশ বিশেষ সুবিধা ভোগ করেন।
২। যদি কোন অ্যাডভোকেট বিশ্বস্ততার সাথে মামলা চলাকালে মানহানিকর বিবৃতি দেন তার জন্য তিনি দায়ী হবেন না।
৩। তাঁর বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করা যাবে না।
৪। মামলা চলাকালে অ্যাডভোকেট যদি বাদীকে মিথ্যাবাদী ও ধাপ্পাবাজ বলেন তাহলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না।
৫। যদি কোন অ্যাডভোকেট মামলা চলাকালে সাক্ষীকে বদমাশ বা লম্পট বলে, তাহলেও তার বিবৃতিটিকে বিশেষ সুবিধার অধীন বলে ধরে নেয়া হবে।

অতএব কোন অ্যাডভোকেটকে তার আইনবিষয়ক কাজে বা মামলা চলাকালে প্রাসঙ্গিকভাবে মানহানিজনক বিবৃতি প্রদানের জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। তিনি যাই বলুন না কেন, তা প্রকৃত সত্য নাও হতে পারে বা অতিরঞ্জন হতে পারে কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি বিশেষ সুবিধা ভোগ করবেন।

বিচারাধীন মামলায় একজন আইনজীবী তার মক্কেলের পক্ষে আইনের যুক্তিতর্ক পেশ করার প্রাক্কালে সম্পূর্ণভাবে আইনের স্বাধীনতা পেয়ে থাকেন এবং এজন্যে ঐ সময় যদি সংশ্লিষ্ট মামলাটির “MERIT ” বা গুণাগুণের সাথে সম্পর্কহীন এমন কোন মন্তব্য করা হয় যা ঐ মামলা সংক্রান্ত নহে বরং সম্পূণরুপে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর পেশাগত চরিত্র বা আচরণ সম্পর্কিত, তাহলে ঐ জাতীয় মন্তব্য আদালত প্রদত্ত রায়ের অংশ হিসেবে রেকর্ডে রাখা যাবে না এবং তা রেকর্ড হতে মুছে ফেলতে হবে। ৩১ ডি, এল,আর (এ.ডি) ১৬৩ (১৯৭৯)।

কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের বহু জেলাতে আইনের কূটতর্কের বিষয়টি ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে পড়ায় বহু ক্ষেত্রে বার ও বেঞ্চের মধ্যকার উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং এক পর্যায়ে আদালত বর্জন অনুষ্ঠান চলে। এই অবস্থা কখনও কাম্য নয় এবং তা ন্যায়বিচার প্রত্যাশীদের গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নেওয়ার সামিল বলে গণ্য। আইন ও বিচারের প্রতি জনমানুষের শ্রদ্ধা যদি বাঁধার সৃষ্টি করে তবে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ায় স্বাভাবিক। কাজেই বিচারক, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট সকলকে যার যার অবস্থান থেকে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। যাতে পক্ষগণ অন্ততঃ বুঝতে পারেন যে, আদালতে ন্যায় বিচার হয়েছে। বিচারকের নীতিমালাতে স্পষ্ট বলা আছে যে, বিচারককে ভয় ভীতির উর্ধ্বে থেকে বিচারকার্য সম্পাদন করতে হবে। বিচারক অবশ্যই ন্যায়নিষ্ঠ এবং উন্নত চরিত্রের অধিকারী হবেন। বিচারকরা এমন কোনো সংগঠনের সদস্য হবে না যা ধর্ম, বর্ণ, লিংগ ভেদাভেদের কারনে গঠিত হয়। একজন বিচারক অন্য কারও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য তার নিজের পরিচয় এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না। বিচারককে আইনজীবী এবং বিচারপ্রার্থী জনগনের প্রতি ধ্যৈর্যশীল হবেন এবং সম্মানজনক আচরন প্রদর্শণ করবে। বিচারক বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য কারো কাছ থেকে বিচারিক ক্ষমতার বিনিময়ে উপহার, অনুরোধ, ঋণ বা সুবিধা চাইতে পারবেন না। এক কথায় বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়ে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস থাকে, এমন আচরণ করতে হবে।

অতীতে সম্ভান্ত পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জ্ঞান পিপাসার অন্যতম খোরাক ছিল আইন। ফলে তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা, মননশীলতা, উন্নত আচরণ আইন পেশাকে অনেক উঁচুতে প্রতিষ্ঠিত করেছিল আর জয় করেছিল মানুষের হৃদয়। কিন্তু এখন গণেশ উল্টে গেছে, দিক ভ্রান্ত পথিকের ভারে আইন পেশা দিগিবিদিক শূন্য হয়ে পড়ছে! সাধারণ মানুষের কাছে একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, আইন পেশায় আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। তাই রাতারাতি ধনী হওয়ার আশায় অন্য একটি পেশা ছেড়ে দিয়ে শেষ বেলাতে আইন পেশার দ্বারস্থ হন অনেকেই। নিদিষ্ট বয়সসীমা না থাকায় অনেক সময় নীতি নৈতিকতাহীন ব্যক্তিবর্গের আগমনেরও সুযোগ ঘটে। ফলে হয়রানির স্বীকার হয় বিচার প্রত্যাশী অসহায় মানুষগুলো। তাই বলে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের প্রতারণায় দায়ে একটি পেশাকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। তবে প্রত্যেকটি পেশায় কতিপয় ব্যক্তি তাদের কৃত কর্মের সমালোচনা তথা ক্ষেত্র বিশেষে শাস্তি প্রাপ্তির যোগ্য বটে। এক্ষেত্রে সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগ গুরুদায়িত্ব পালন করে। কিন্তু বিচার বিভাগের একার পক্ষে তা অনেকাংশেই অসম্ভব।

লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, আইনের শিক্ষক ও আইন গবেষক।