মিউচুয়াল ফান্ডের এনএভি ও দামের ব্যবধান খতিয়ে দেখা প্রয়োজন: বিএসইসি কমিশনার ড. মিজান

Posted on October 4, 2023

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের মিউচুয়াল ফান্ড খাত নানা চ্যালেঞ্জ আর প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ভাল করছে। বেশিরভাগ ফান্ড ধারাবাহিক লভ্যাংশও দিচ্ছে। তবু স্টক এক্সচেঞ্জের বিভিন্ন ফান্ডের ইউনিট তার নিট সম্পদ মূল্যের (এনএভি) অনেক কমে বিক্রি হচ্ছে। কোন কোনো ফান্ডের ইউনিটের দাম তার এনএভির মাত্র অর্ধেক। কোনোভাবেই এই ব্যবধান ২০ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু অনেক ফান্ডেই এনএভি আর ইউনিটের দামের ব্যবধান প্রায় ৫০ শতাংশ। তাই এর কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, এনএভির অর্ধেক দামে ফান্ডের ইউনিট বিক্রি হওয়ার পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। হয় আমাদের বাজারের কাঠামোগত ত্রুটি, নয়তো ফান্ডের ঘোষিত এনএভি’র প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা। এমন আচরণের কারণ খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া গেলে মিউচুয়াল ফান্ড খাতের বিকাশ ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করেন তিনি।

মঙ্গলবার (৩ অক্টোবর) ‘বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ’ উপলক্ষে এসোসিয়েশন অব অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ অ্যান্ড মিউচ্যুয়াল ফান্ডস (এএএমসিএমএফ) আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. মিজানুর রহমান এ কথা বলেন। ‘রোল অব এসডিজি অ্যানালিটিক্স ইন ক্যাপিটাল মার্কেট-বেজড ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্সিং’ শীর্ষক সেমিনারটি রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পর্যটন ভবনে অনুষ্ঠিত হয়।

সেমিনারে সম্মানিত অতিথি ছিলেন কমিশনার ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএসইসির নির্বাহি পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম। রেস গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এএএমসিএমএফ এর সভপাতি ড. হাসান ইমামের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের কো-অর্ডিনেটর অ্যান্ড ইকোনোমিস্ট জুবায়ের হোসেন।

সেমিনারে প্যানেল আলোচক ছিলেন এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলাম এবং ভ্যানগার্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াকার চৌধুরী।

সেমিনারে বিএসইসির কমিশনার ড. মিজানুর রহমান বলেন, মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতের উন্নয়নে কমিশন কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে এই খাতের আকার ১৬ হাজার কোটি টাকার মতো। এটিকে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা সম্ভব।

তিন বলেন, দেশের মিউচুয়াল ফান্ড শিল্পকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মধ্যে এগুতে হচ্ছে। একদিকে সঞ্চয়পত্রসহ অনেক সরকারি সিকিউরিটিজে উচ্চ সুদ দেওয়া হয়। কিন্তু এগুলোতে বিনিয়োগের ঝুঁকি শূন্য শতাংশ। অন্যদিকে ব্যাংক আমানতে সুদের হার তত আকর্ষণীয় না হলেও এখানে টাকা রাখাকে মানুষ ঝুঁকিমুক্ত মনে করেন। এখন পর্যন্ত দেশের কোনো ব্যাংক অবসায়িত হয়নি। ব্যাংকে টাকা জমা রেখে গ্রাহক ফেরত পায়নি এমন ঘটনাও ঘটেনি। এর বিপরীতে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগকে অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন। আবার দেশের মানুষের একটি বড় অংশ এর সাথে পরিচিতই নয়। মিউচুয়াল ফান্ড কি, এটি যে বিনিয়োগের একটি ভাল বিকল্প হতে পারে-সেগুলো সম্পর্কে তারা তেমন কিছু জানেন না।

তিনি বলেন, মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কমিশন কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া হিসাব মান পরিপালনে কঠোর কমিশন। এই খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে এফডিআর এর থেকে ভালো রিটার্ন পাওয়া যায়। এই খাত যাতে আরও ভালো রিটার্ন দিতে পারে, সেলক্ষ্যে কমিশন কাজ করে যাচ্ছে।

সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে কমিশনার ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি নিরসন করে। যা ব্যক্তিগতভাবে করা কঠিন। এজন্য বিনিয়োগকারীদেরকে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করার আহবান করেন তিনি।

তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মিউচুয়াল ফান্ড খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

রেস গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এএএমসিএমএফ এর সভপাতি ড. হাসান ইমাম বলেন, মিউচ্যুয়াল ফান্ড পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। এই খাতটি অনেক বাঁধা বা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ভালো করছে।

তিনি বলেন, গত অর্থবছরে শেয়ারবাজার নেতিবাচক ছিল। যে ব্লু চিপস কোম্পানিতে মিউচ্যুয়াল ফান্ড থেকে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা হয়, সেই ব্লু চিপস-৩০ সূচকও নেতিবাচক ছিল। এই অবস্থার মধ্যেও মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো ২০২২-২৩ অর্থবছরের ব্যবসায় ২৮৩ কোটি টাকার নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। এমনকি গত ১০ বছরের মধ্যে ৭ বছরই সূচকের পারফরম্যান্সের চেয়ে মিউচুয়াল ফান্ড ভালো করেছে।

তিনি বলেন, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের আয়ের প্রধান উৎস বিনিয়োগ করা কোম্পানিগুলো থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ এবং ক্যাপিটাল গেইন। কিন্তু গত অর্থবছরে দুই খাতই ছিল মন্দা। তবু গড়ে ৪.৪ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিতে পেরেছে ফান্ডগুলো। এ সময়ে ডিএসইর মূল্যসূচক আগের বছরের চেয়ে ৪.৫ শতাংশ কমেছে। এ হিসেবে দেখা যায়, বাজারের পারফরম্যান্সের চেয়ে ফান্ডগুলোর প্রায় ৯ শতাংশ ভাল পারফরম করেছে।
আলোচিত সময়ে বাংলাদেশের অ্যাসেট ম্যানেজারদের পারফরম্যান্স ছিল সেরাদের তৃতীয় স্থানে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে রেজাউল করিম বলেন, বন্ডের কূপণ রেট থেকে কর অব্যাহতি দেওয়া দরকার। তাহলে ইউনিটহোল্ডাররা ভালো লভ্যাংশ পাবে।

এলআর গ্লোবালের সিআইও রিয়াজ ইসলাম বলেন, দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগিয়েছে, সেভাবে পুঁজিবাজার এগোয়নি। এটা এই বাজারের জন্য খারাপ খবর। আর ভাল খবর হচ্ছে-নানা সমস্যার মধ্যেও আমাদের অর্থনীতি ৫ থেকে ৬ শতাংশ হারে বড় হচ্ছে। তাই আমাদের পুঁজিবাজারের বড় হওয়ার অনেক সুযোগ রয়েছে। সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। তাতে দেশের অর্থনীতির টেকসই বিকাশও ত্বরান্বিত হবে।

ভ্যানগার্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াকার চৌধুরী বলেন, মিউচুয়াল ফান্ড খাতের আকার জিডিপির ১ শতাংশের কম। কিন্তু এটিকে ১০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব।

তিনি বলেন, মিউচুয়াল ফান্ড খাতের বিকাশ ঘটলে পুঁজিবাজারের অর্ধেক সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যাবে।