বগুড়ায় রথযাত্রায় ৫ জনের মৃত্যু, তদন্ত কমিটি গঠন

Posted on July 8, 2024

মোঃ আব্দুল ওয়াদুদ, বগুড়া প্রতিনিধি: বগুড়ায় সনাতন ধর্মালম্বীদের রথযাত্রাকালে বিদ্যুৎ স্পর্শে ৩ নারীসহ অন্তত ৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ৫০ জন। রবিবার (৭ জুলাই) বিকেল সোয়া ৫টার দিকে শহরের সেউজগাড়ি আমতলা এলাকায় ওই হতাহতের ঘটনা ঘটে।

বগুড়ার জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল ইসলাম ৫জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ঘটনাটি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (এডিএম) নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত টিমও গঠন করা হয়েছে।

নিহতরা হলেন-বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার কুন্দুগ্রামের ভবানী মোহন্তের ছেলে নরেশ মোহন্ত, শহরের তিনমাথা রেলগেট এলাকার মন্তেস্বরের স্ত্রী আতশী, শাজাহানপুর উপজেলার গোহাইল গ্রামের সুদেবের স্ত্রী রনজিতা, শিবগঞ্জ উপজেলার কুলুপাড়া গ্রামের মৃত নারায়ণ কুমারের ছেলে অলক কুমার ও সারিয়াকান্দি উপজেলার সাহাপাড়ার বাসুদেব সাহার স্ত্রী জলি সাহা।

আহতদের মধ্যে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতাল ও ২৫০ শয্যা মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ৪৩ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বিদ্যুৎ স্পর্শে সৃষ্ট আগুনে অনেকের শরীর ঝলসে গেছে।
আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার পর তাদের পরিবারের সদস্যসহ রথযাত্রায় অংশ নেওয়া শত শত মানুষ শজিমেক হাসপাতারের জরুরী বিভাগ এবং ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ভিড় করেন। বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতির কারণে চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হয়। ওই হতাহতের ঘটনার পর রথযাত্রা সংক্ষিপ্ত করা হয়।

দূর্ঘটনার পর পরই বগুড়া-৬ আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপু, বগুড়ার জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল ইসলাম, পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী, এবং সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শুভাশীষ পোদ্দার লিটন শজিমেক হাসপাতালে ছুটে যান। জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, সৎকারের জন্য প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এছাড়া আহতদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদেরকে ঢাকা বা অন্য কোন বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হবে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার রবিবার বিকেল ৫টার দিকে বগুড়া শহরের সেউজগাড়ি ইসকন মন্দিরের কাছে সেউজগাড়ি এলাকায় (সাতমাথা-তিনমাথা সড়ক) রথযাত্রার উদ্বোধন করেন। এরপর তারা চলে গেলে সনাতন ধর্মালম্বী হাজার হাজার নারী-পুরুষ রথটির দড়ি ধরে সেটি টেনে এগিয়ে যেতে থাকে। রথটি প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে শহরের লতিফপুর এলাকায় (পুলিশ লাইন্স সংলগ্ন) শিব মন্দিরে গিয়ে শেষ হবার কথা। তবে মাত্র ৫০০ গজ পূর্ব দিকে সেউজগাড়ি আমতলা মোড়ে পৌঁছার পর পরই রথের গাড়িতে সংযুক্ত উঁচু গম্বুজের ভেতরে থাকা লৌহ দন্ডটি সড়কের ওপরের ১১ হাজার ভোল্টের তারের (তারটি সড়কের দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে টানা) সংস্পর্শে আসে। এতে মুহুর্তের মধ্যে আগুন ধরে যায় এবং ওই গাড়ি ধরে থাকা অর্ধ শতাধিক মানুষ সড়কের ওপর পড়ে যান। তাদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাই বেশি। এতে রথযাত্রায় অংশ নেওয়া সনাতন ধর্মাবলম্বী হাজার হাজার নারী-পুরুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রথযাত্রীদের অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং স্বজনদের খোঁজা-খুঁজি শুরু করেন। পরে পুলিশের সহায়তায় সড়কের ওপর পড়ে থাকা আহতদের উদ্ধার করে ২৫০ শয্যা মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল এবং শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে পথের মধ্যে এবং হাসপাতলে নেওয়ার পর ৩ নারীসহ ৫জনের মৃত্যু হয়।

বগুড়া শজিমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ জানান, ওই হাসপাতালে মোট ৪জনের মৃত্যু হয়েছে। সেখানে বর্তমানে ৩৮জন চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে ২জন আইসিইউতে রয়েছেন। বগুড়া সদর থানার ওসি সাইহান ওলিউল্লাহ জানান, ২৫০ শয্যার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে একজন মারা যান। তিনি বলেন, বর্তমানে ২৫০ শয্যার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে আরও ৩জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের বগুড়া পৌর কমিটির পরিমল প্রসাদ রাজ জানান, রথ যাত্রার শুরুতে দুঃখজনখ হতাহতের ঘটনা ঘটার পর রথযাত্রাটি কিছু সময় থামিয়ে রাখা হয়েছিল। তবে পরে সেটি শুরু করা হয় এবং সংক্ষিপ্তভাবে শেষ করা হয়।

বিদ্যুতের তার থেকে সাবধান থাকতে বার বার বলা হয়েছিল

রথ যাত্রায় অংশ নেওয়া স্থানীয় সাংবাদিক অরূপ রতন শীল জানান, রথের গাড়িটি যারা টানছিলেন তাদেরকে বার বার সড়কের ওপরে থাকা হাইভোল্টেজের তারের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। তিনি বলেন, সড়কের ওপরে আড়াআড়ি ভাবে টানা তারের নিচ দিয়ে রথের গাড়িটি সাবধানে পার করার জন্য ইসকন বগুড়ার সভাপতি খরজিতা কৃষ্ণ দাস বার বার মাইকে সতর্ক করছিলেন। কিন্তু হাজার হাজান মানুষের উপস্থিতিতে তার সতর্কবাণী চাপা পড়ে যায়। তিনি ইতিপূর্বে একাধিকবার রথযাত্রায় অংশগ্রহণের কথা জানিয়ে বলেন, ‘রথযাত্রার মত ধর্মীয় এই উৎসব অনুষ্ঠানে এর আগে এমন প্রাণহানির ঘটনা কখনও ঘটেনি।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেউ কেউ সড়কের ওপর হাইভোল্টেজের তারগুলোকে ন্যাকেড (ওপরে রাবারের কোন আবরণ না থাকা) রাখাকেই দায়ী করেছেন। তারা বলছেন, তারগুলো যদি ঢাকা থাকতো তাহলে হয়তো প্রাণহানির মত দুঃখজনক ঘটনা ঘটতো না।

ঘটনার পর পরই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হয়
নর্দান ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) নির্বাহী প্রকৌশলী (১) আব্দুল মান্নাফ জানিয়েছেন, বিকেল সোয়া ৫টার দিকে রথের গাড়িতে বিদ্যুৎ স্পর্শের ঘটনার খবর পাওয়ার পর পরই স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশে ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। রাত সাড়ে ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। সড়কের ওপর সরবরাহ লাইনের তার ন্যাকেড রাখার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১১ হাজার ভোল্টের তারগুলো এভাবেই রাখা হয়। শুধু বগুড়ায় নয় বরং সারা বাংলাদেশেই এভাবে রয়েছে।’ দূর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদ্যুত সরবরাহ লাইনের যে তার সড়কের ওপর দিয়ে পারাপার করা হয়েছে সেগুলোর উচ্চতা ছিল ১০ মিটার। ধারণা করা হচ্ছে রথের গাড়িতে এমন কোন উঁচু দণ্ড যুক্ত করা হয়েছিল যেটি বিদ্যুৎ পরিবাহী। আর সে কারণেই দূর্ঘটনাটি ঘটেছে।’

বগুড়ার জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল ইসলাম জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আপাতত ঘটনাস্থল অর্থাৎ শহরের সেউজগাড়িসহ সংলগ্ন এলাকায় আপাতত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পেলে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় চালু করা হবে।