শাহজাদপুরে বন্যার পানিতে ডুবে গেছে অর্ধশত বাড়িঘর

Posted on July 7, 2024

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারিবর্ষণে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরি ইউনিয়নের হাট পাচিল গ্রামে যমুনা নদীর ভাঙ্গণে ২৫ বাড়িঘর বিলিন হয়েছে। এছাড়া গত বছরে যমুনার ভাঙ্গণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধশত মানুষের পাশের নিচু সমতল জমিতে নির্মাণ করা বাড়িঘর ৩/৪ ফুট বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। ফলে তারা স্ত্রী সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য নারী ও শিশুদের নিয়ে চৌকি অথবা মাচায় বাস করছে। গত কয়েকদিনেও তাদের ভাগ্যে জোটেনি কোনো ত্রাণসামগ্রী বা অর্থ সাহায্য। বন্যার পানিতে চুলা ডুবে যাওয়ায় অনেকের ঘরে ঠিকমত রান্নাও হচ্ছে না। ফলে তারা একবেলা আধবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।

এ বিষয়ে বন্যার পানিতে বাড়িঘর ডুবে মাচা ও চৌকিতে বাস করা হাট পাচিল গ্রামের আজিদা বেগম (৭৫), পরীবানু (৫০), বিউটি খাতুন (৪০), সুরা খাতুন (৪৫) বলেন, গত কয়েকটিন ধরে বন্যার পানিতে বাড়িঘর ডুবে গেছে। এ পর্যন্ত চুলা জ্বালাতে পারিনি। ফলে রান্নাবান্নাও হয়নি। সকালে পান্তা ও চিড়া খেয়েছি। দুপুরে না খেয়ে আছি। রাতে কি করবো ভেবে পাচ্ছি না।'

তীরসংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণে তৈরি সিসি ব্লকের স্তুপে ছাউনি তুলে বাস করা বিধাব টুলু বেগম (৬৫) বলেন, যমুনায় বাড়িঘর বিলিন হওয়ার পর বাড়ি করার সামর্থ না থাকায় ব্লকের স্তুপের উপর পলিথিনের ছাউনি তুলে বাস করছি। এ ব্লকের স্তুপও বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। এটা ডুবে গেলে কোথায় যাব জানিনা। এ নিয়ে খুবই দুঃশ্চিন্তায় আছি।

মোতালেব হোসেন (৫০), ছগির মোল্লা (৫৫), আবু সাঈদ (৫০), সোহেল রানা বলেন, বন্যার বানিতে বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় স্ত্রী, সন্তান ও বৃদ্ধি মা বাবাকে নিয়ে অতিকষ্টে চৌকি উচু করে অথবা মাচা পেতে আমরা ১০/১২টি পরিবার বাস করছি। রাতে ঘুমাতে পানি না ছোট ছোট ছেলে মেয়ে বন্যার পানিতে পড়ে তলিয়ে যাওয়ার ভয়ে। ঘরে খাবার না থাকায় সেই সকালে খেয়েছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার উপক্রম হল এখনও খাবার জোটাতে পারিনি। ফলে আমাদেও এখানে সবগুলো পরিবার অর্ধাহারে অনাহারে রয়েছে। তারপরেও আমাদেও ভাগ্যে কোনো ত্রাণ সামগ্রী বা সরকারি বেসরকারি কোনো সাহায্য জোটেনি। কেউ আমাদের খোজ খবরও নেয়নি। আমরা আশায় বুক বেধে পথের দিকে চেয়ে আছি কেউ সাহায্য নিয়ে এদিকে আসে কি না। দুঃখের কথা এখনও কেউ আমাদের খোজ নিতে আসেনি।

এদিকে শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগ্রাম, আরকান্দি, পাড়ামহোনপুর, ঘাটাবাড়ি, জালালপুর ইউনিয়নের জালালপুর, পাকুরতলা, গুচ্ছোগ্রাম, সৈয়দপুর, কৈজুরি ইউনিয়নের শরিফমোড়, মোনাকষা গ্রামে যমুনা নদীর ভাঙ্গণে আরও ২৫ বাড়িঘর যমুনাগর্ভে বিণিস হয়ে গেছে। অনেকে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়িঘর সরিয়ে নিতে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। এছাড়া গত কয়েকদিনে যমুনার ভাঙ্গণে নিঃস্ব অর্ধশত মানুষ পাশের নতুন নির্মিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের স্লপে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এ ছাড়া শাহজাদপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ৫০০ বিঘা জমির নেপিয়ার ঘাস বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।

এ বিষয়ে ভাঙ্গণে নিঃস্বা জানায়, যমুনা নদীর ভাঙ্গণরোধে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০২১ সালের জুন মাসে ৪৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে শাহজাদপুর উপজেলার খুকনি ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগ্রাম হতে হাট পাঁচিল পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। এছাড়া আরও দু‘টি প্যাকেজে শরিফমোড় হতে মোনাকষা কলেজ পর্যন্ত বালু বোঝাই টিউব ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু করেন। বার বার প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করেও কাজ শেষ না হলেও গত জুন মাসে এ প্রকল্পের ৫০ শতাংশ কাজ বাকি রেখেই মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ড আবারও আগামী ২০২৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত এ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িায়েছে বলে জানা গেছে।

শাহজাদপুর উপজেলার পাকুরতলা গ্রামের লাল মিয়া ও পাচিল গ্রামের আলাউদ্দিন, কালাম শেখ, আয়নাল হক অভিযোগ করে বলেন, চলতি মৌসুমে সিরাজগঞ্জ পাউবোর ১৪জন ঠিকাদার সমন্বিত ভাবে যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ করতো, তাহলে এবার বর্ষায় আমাদের এই সর্বনাশ হতো না।

এ বিষয়ে জালালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ বলেন, এবছরও যমুনার ভাঙ্গণে খুকনি, কৈজুরি ও জালালপুর ইউনিয়নের ভাঙ্গণ কবলিত গ্রাম গুলিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গত কয়েক দিনে অন্তত অর্ধশত বাড়িঘর ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তরা সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণ কাজ তিন বছরেও শেষ না হওয়ায় নদীতীরের মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে।
এ বিষয়ে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: কামরুজ্জামান বলেন, ভাঙ্গণ কবলিত ২০ পরিবারের জন্য ১ বান করে ঢেউটিন বরাদ্দ পাওয়া গেছে। অচেরেই তালিকা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে। এছাড়া বন্যায় ডুবে যাওয়া বাড়িঘরের তালিকা তৈরীর কাজ চলছে।'

গত ১২ ঘণ্টায় ২১ সেন্টিমিটার বেড়ে যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষাবাঁধের হার্ড পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো') উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রঞ্জিত কুমার সরকার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, এদিন সকাল ৬টায় সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ হার্ড পয়েন্টে যমুনা নদীর পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৯১ মিটার। গত ১২ ঘণ্টায় ২১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৯০ মিটার)

অপরদিকে, কাজিপুরের মেঘাই ঘাট পয়েন্টে পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৬০ মিটার। ১২ ঘণ্টায় ২৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপৎসীমা ১৪.৮০ মিটার)

সিরাজগঞ্জ পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রঞ্জিত কুমার সরকার আরও বলেন, পানি আগামী ৮ তারিখ পর্যন্ত বাড়বে, তারপর কমার সম্ভাবনা রয়েছে।'

আরও পড়ুন:

বন্যায় মৌলভীবাজারে ৫০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত