প্লাটিনাম জয়ন্তীতে ফিরিয়ে আনুন তাঁদের

Posted on June 26, 2024

বদরুল ইসলাম বাদল।। ২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। ৭৫ বছরের ইতিহাসের স্বাক্ষী দলটি। বলা যেতে পারে আওয়ামী লীগ নিজেও একটি ইতিহাসের নাম।নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করছে দলটি তার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর এই বছরের "প্লাটিনাম জয়ন্তী"। সুদীর্ঘ এই ৭৫ বছরে দলটির সফলতা যেমন আছে, আছে ব্যর্থতাও। আছে আগামী প্রজন্মের জন্য শতাব্দী থেকে শতাব্দীকাল চেতনার অনুপ্রাণিত ঐতিহাসিক ছবক। দক্ষ সংগঠকদের হাতধরে তৃণমূল পর্যায়ে শক্ত অবস্থান রয়েছে আওয়ামী লীগের। অপরদিকে দলের ভিতরের মীরজাফরদের দ্বারা দলটি ক্ষতবিক্ষত হয়েছে অনেক বার, বারবার। তাই শুধু মাত্র আনুষ্ঠানিকতায় "প্লাটিনাম জয়ন্তী"কে সীমাবদ্ধ না রেখে আত্মসমালোচনা এবং পর্যালোচনায় দলের আদর্শিক কর্মীদের দলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করার পক্ষে মতামত রাজনেতিক বিজ্ঞমহলের। তাদের অভিমত যে, "বর্তমানে দলে আদর্শিক কর্মীদের অভাব। নিবেদিত ত্যাগীরা দল থেকে অনেক দুরে।যা একটি দলের জন্য চরম ব্যর্থতা"।ভারতের জাতীয় কংগ্রেস কিংবা বিশ্বের অনেক পুরাণো দল গুলো এই কারণেই হাল সময়ের দূরাবস্থা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে দলের তৃণমূল পর্যায়ের বিশলাখ কর্মী বিলুপ্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন"কেনো এরা চলে গেল, তার জবাব আওয়ামী লীগ নেতাদের দিতে হবে"। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুমূর্ষু আওয়ামী লীগের হাল ধরার জন্য দলের সিদ্ধান্তে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা। তার ফিরে আসাতে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল নেতাকর্মীদের মাঝে। দলীয় সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে তিনি গনতন্ত্র ও মানুষের মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধারে আন্দোলন শুরু করলে তাঁর আহ্বানে হাজার হাজার ছাত্র জনতা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়। যে আন্দোলনে অনেক নেতাকর্মী আহত নিহত পঙ্গুত্ব বরণ করে, জেল জুলুম হুলিয়া নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে। সে আন্দোলনের তীব্রতার মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন এরশাদশাহীর দখলবাজ সরকার। তারপর ১৯৯৬ সাল এবং বর্তমান সময়ে টানা চারবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন আওয়ামী লীগ সরকার,যার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীন দলটিতে আজকে দেখা যায় না সেই চেনা মুখগুলো যাদের রক্তে ঘামে দলের বর্তমান অবস্থান। দেখা যায় না মিশিলের সেসকল ভ্যানগার্ডদের, যারা শেখ হাসিনার আহ্বানে গুলির মুখে বুক পেতে দিতে দ্বিধা করেনাই।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, খালেদা জিয়ার আমল এবং ২০০১ এর জোট সরকারের দুঃশাসন বিরোধী দলের নির্যাতিত ত্যাগীনেতাদের অনেককে দেখা যায় না। সে-সকল ঝরে পড়া কর্মীদের খবর কারও কাছে নাই, কেউ খবর রাখার প্রয়োজন মনে করে না। এমনকি তারা কোথায় কি অবস্থায় আছে দলের কাছে কোন তথ্য নাই। অনেক দেরীতে হলেও বঙ্গবন্ধুকন্যা বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করছেন। কক্সবাজারেও এরকম অনেক নেতাকর্মী পর্দার অন্তরালে চলে গেছে। এরা পদপদবীহীন। সারাদেশ ব্যাপী বিগত আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও কাউন্সিলে কো-অপশন ক্যাটাগরীতে তাদেরকে কাউন্সিলার করে নুন্যতম সন্মান টুকু দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে নাই অনেক জায়গায়, বর্তমান সময়ের নেতৃত্ব। চরম অবহেলার স্বীকার তারা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথার সূত্র ধরে বলা যেতে পারে, কক্সবাজার জেলায় এরকম অনেক নেতাকর্মী ঝরে গেছে, তাদের বর্তমান অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করতেই আমার এক্ষুদ্র প্রয়াস।

ছাত্রলীগ কক্সবাজার জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি নুরুল আজিম কনক তার মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, "সামরিক শাসক এবং জোট সরকারের দুঃশাসনের সময় অনেক নেতাকর্মী দমন-পীড়নের স্বীকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেছে। তাদের অনেকে হারিয়ে গেছে, যার তথ্য উপাত্তের হিসাব দলীয় অফিসে সংরক্ষিত আছে কিনা আমার জানা নাই। সাবেক ছাত্রনেতা কলামিস্ট বদরুল ইসলাম বাদল সেসব ঝরে পড়া নেতাকর্মীদের নিয়ে লেখার আগ্রহকে আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি এবং সেসব ত্যাগী নেতাদের আবার রাজনীতিতে ফিরে এসে নিজেদের প্রজ্ঞা অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতকে আরও শক্তিশালী করবে, এই আশা ব্যক্ত করছি"।

রাজনীতি নিয়ে চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের বিশ্লেষণ যে, রাজনীতির চিরচেনা ঐতিহ্য আগের ধারায় নাই। জনসেবা অনেক ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। যেখানে দেশপ্রেম অনুপস্থিত, কর্পোরেট বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। শুধু চলে লুটেপুটে খাওয়ার চর্চা। হাল সময়ে আলোচিত রাজনীতি শব্দটি পজিটিভ অর্থের চেয়ে নেগেটিভ ধারণায় এখন ব্যবরিত হয়ে থাকে বেশি।রাজনীতির মাঠে কিংবা বাইরে, ট্রেড ইউনিয়ন হোক কিংবা টমটম সমিতি বা ক্লাবে, এমনকি মসজিদ কমিটি নিয়েও রাজনীতি অর্থাৎ হানাহানি দলাদলি মারামারি।রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের ভাস্যমতে, "অর্থনীতির ঘনীভূত রূপের নামই রাজনীতি", এ-ই তত্ত্বকে পাশকাটিয়ে এখন একে অন্যকে লেং মেরে ঘায়েল করার অপকৌশলকে রাজনীতি হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে বেশি।আর এরকম রাজনীতির পূর্বশর্তের মধ্যে দলবাজি, ভাইবাজি ধান্দাবাজি, টেন্ডারবাজি কিংবা আধিপত্য বিস্তারে পারদর্শীদের কদর বেশি দৃশ্যমান।

যেখানে আদর্শের চর্চা ঐচ্ছিক।দীর্ঘসময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুবিধা নিয়ে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী লোভী চাটুকার বিভিন্ন কলাকৌশলে দলের বিভিন্ন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নেয়। যারা দল এবং দলের আদর্শিক নেতাকর্মীদের দুরে রেখে নিজেদের একটি বলয় তৈরী করে দলকে ব্যবহার করছে।রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এসব ব্যাপারে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা কোন অবস্থাগেই দায় এড়াতে পারে না। সুবিধাভোগীদের আধিপত্যে তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক সংখ্যক কর্মী নিরবে নিভৃতে সরিয়ে গেছে।

বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায়, উপমহাদেশের এই পুরনো দলটির নেতাকর্মীদের তালিকা সংরক্ষণ করা হয় না। অনেক জায়গায় অফিসও নাই। দাপ্তরিক কাজ সংরক্ষণ করা হয় না। সম্মেলনের পর বছরের পর বছর চলে যায় পুর্নাঙ্গ কমিটি হয় না। দলের বিভিন্ন ইউনিটের সভাপতি সম্পাদক ছাড়া অন্যরা জানেও না তারা কোন অবস্থানে আছেন। নিবন্ধিত দলটির সদস্য সংখ্যার কোন পরিসংখ্যান নাই।অথচ কর্মী বাহিনীর বিশালত্ব নিয়ে দলটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের গর্বের উচ্ছ্বাস আকাশ ছোঁয়া। আহত নিহতের সহযোগিতা কিংবা পুনর্বাসনের কোনো প্রকল্প নাই। আহত কিংবা নিহতের পরিবারকে ফটোসেশানের নিমিত্তে কিছু নগদ টাকা দিয়ে পাশে থাকার নামে ভাঁওতাবাজি করে, নিজেকে দাতা হিসেবে জাহির করার চেষ্টায় থাকে।নির্বাচন কমিশন কতৃক নিবন্ধিত যেকোন দল একটি পূর্নাঙ্গ প্রতিষ্ঠান, যার নিজস্ব তহবিল থাকার কথা, দলের কাজ করতে গিয়ে কেউ হতাহত হলে তাদের চিকিৎসা সেবা থেকে নিহতদের পরিবারের দায়িত্ব পালন করা সেই দলের নৈতিক দায়িত্ব। আমি বঙ্গবন্ধু দর্শনের একজন নগন্য কর্মী।নব্বই দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকায় ছিলাম।আন্দোলনকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমাদের মিশিলের অনেককে আহত নিহত হতে দেখেছি। অনেকে পঙ্গুত্ব নিয়ে জীবন্ত লাশ হয়ে বেচে আছে।এরাই সম্মুখ যোদ্ধা, আদর্শের সৈনিক, সূর্য সন্তান।দল তাদের পাশে নিয়ে দাড়াতে না পারলে আগামীদিনে নিবেদিত রাজনৈতিক কর্মী খুঁজে পাওয়া যাাবে না।ভাইলীগের কর্মীরা বিপদ কালীন সময়ে সটকে যাবে।কক্সবাজার জেলায় এমন নেতাকর্মীর সংখ্যা অনেক।অনেকে আত্মসম্মানবোধের কারণে অভিমানে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে।কেউ কেউ দলীয় রাজনীতির কোন্দলের স্বীকার হয়ে কোনটাসা।কক্সবাজার জেলায় এ সকল কর্মীদের ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

প্রথমেই চকরিয়ার শহীদ দৌলত খান। ১৯৮৭ সালের ৫ই ডিসেম্বর চকরিয়ার রাজপথে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে শহীদ হন উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি দৌলত খান। মধ্যভিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। তিনি নিহত হওয়ার পরেই তার বাবা ইন্তেকাল করেন।

কোণাখালী ইউনিয়ন দুই নাম্বার ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক শহীদ দৌলত খানের ভাগিনা মোহাম্মদ সোহেলের সাথে কথা বলে জানা যায়,"দৌলত খান মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত লেখাপড়ার পাশাপাশি ব্যবসা করে সংসার চালাতো। তার অনুপস্থিতিতে সংসারে নেমে আসে অভাবনীয় দারিদ্র্যতা।তাঁর মৃত্যুর পরে অতীব কষ্টে বোনদের বিয়ে হয়।বর্তমানে তাঁর ছোট ভাই অস্বচ্ছলতা নিয়ে দিনযাপন করছে"।

কোণাখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,"আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে চকরিয়া পৌরসভার প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন তত্কালীন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আমজাদ হোসেন (বর্তমানে তিনি মৃত)। তিনি দৌলতের পরিবারকে দুইটি রিক্সা দিয়েছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একলাখ টাকার অনুদান দিয়েছিলেন। চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাইদি দৌলতখানের কবরকে টাইলস দিয়ে সৌন্দর্য বর্ধন করে দেন"।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চকরিয়া থানারাস্তার মাথা থেকে উপজেলা পর্যন্ত সড়কটি "শহীদ দৌলত সড়ক" নামকরণ হলেও কোন ধরনের সাইনবোর্ড নাই। ফলে ফাইলবন্ধী সড়কটির নাম প্রচার পায় নাই। কক্সবাজার পাবলিক হল সংলগ্ন মাঠকে "শহীদ দৌলত" ময়দান" নামকরণ হলেও নামফলক দেখা যায় না।এমনকি অনেক সংগঠনের মিটিং এর স্থান প্রচারের সময় শহীদ দৌলত ময়দান"নাম ও উচ্চারণ করে না। এমনি ভাবে অবহেলার স্বীকার শহীদ দৌলত এবং তার পরিবার।কিন্তু শহীদ দৌলত খানের আত্মত্যাগের পথ বেয়ে অনেকে নেতা মহনেতা রথী-মহারথী বনে যায়। তাই শহীদ দৌলত খানের স্মৃতি সংরক্ষণ করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তার চেতনা পৌঁছাতে কোণাখালী ইউনিয়নের নাম "শহীদ দৌলত নগর" নামকরণ করার দাবী জানান সাংবাদিক আকতার উদ্দীন রানা।মানবাধিকার কর্মী এবং বিশিষ্ট সমাজ সেবক রানা কোণাখালী ইউনিয়নেই বাসিন্দা।

মনুষ্যত্বের চেতনাবোধের নামই রাজনীতি।আর এসব চিন্তকদের অনুপস্থিতি দেশকে পিছনের দিকে নিয়ে যাবে, মেধাহীন হয়ে পড়বে রাষ্টীয় কাঠামো। তাই এদের সন্মান জানানো দরকার। কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের মাননীয় সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক উভয়েই সাবেক ছাত্রনেতা থেকে উঠে আসা জননেতা। উভয়েই কর্মীবান্ধব। তাদের তত্বাবধানে নির্যাতিতদের তালিকা সংরক্ষণ করে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেন তারা। কক্সবাজার জেলা থেকে এই কার্যক্রম শুরু করতে পারলে এডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক জননেতা মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অমর আলেখ্য হয়ে থাকবে। নির্যাতিত নেতাকর্মীরা দলের মূলস্রোতের সাথে সম্পৃক্ত হোক প্লাটিনাম জয়ন্তীতে এটাই প্রত্যাশা।পরবর্তী পর্বআসছে ---। জয় বাংলা।

লেখক : বদরুল ইসলাম বাদল, কলামিস্ট ও সাবেক ছাত্রনেতা।