আগামী ১ জুলাই থেকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও সম্পূরক শুল্ক আইন বাস্তবায়ন করবে সরকার। ২০১২ সালে তৈরি করা এই আইন পর্যালোচনার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) যৌথ কমিটির কো-চেয়ারম্যান ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। এ আইন তৈরিও করা হয় তিনি এফবিসিসিআইয়ে থাকার সময়। মূসক আইন তৈরির সময় ব্যবসায়ীদের অবস্থান, সরকারের সঙ্গে আলোচনা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
প্রশ্ন: আপনি তো মূসক আইন পর্যালোচনার জন্য গঠিত কমিটির কো-চেয়ারম্যান ছিলেন। এ কমিটি গঠনের প্রেক্ষাপট কী ছিল?
জসিম উদ্দিন: মূসক আইন প্রথমে করা হয়েছিল ইংরেজিতে। সম্ভবত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এই আইনের খসড়া অস্ট্রেলিয়ার জন্য তৈরি করেছিল। পরে সেটি বাংলায় রূপান্তর করা হয়। এ সময় আমাদের চোখে যেসব সমস্যা ধরা পড়ে, তা নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করি। তবে তারা তাদের মতোই আইনটি করে। কখনোই এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধিদের বক্তব্য আমলে নেওয়া হয়নি। মতভেদ রয়েই গেল এবং সেভাবেই আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হলো। ২০১৪ সালে অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, অর্থ উপদেষ্টা, আইন প্রতিমন্ত্রী এবং এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ও সাবেক কয়েকজন সভাপতির মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আইনটি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়। তখন এফবিসিসিআই আইনের বিষয়ে তাদের মতভেদগুলো উপস্থাপন করে এবং আইনটিকে একরকম প্রত্যাখ্যান করা হয়। তখন অর্থমন্ত্রী পর্যালোচনা কমিটি করতে বলেন।
প্রশ্ন: এনবিআর ও এফবিসিসিআইয়ের কমিটি কী কাজ করেছে?
জসিম উদ্দিন: এই কমিটি অনেকগুলো বৈঠক করে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা, বিভিন্ন দেশের আইন ও বাংলাদেশের আইন পর্যালোচনা করে সাতটি বিষয়ে একমত হয়। অবশ্য এফবিসিসিআই ১১টি বিষয়ে সংশোধন চেয়েছিল। বাকি চারটিতে এনবিআর একমত হয়নি। আমাদের ধারণা ছিল, যে সাতটি বিষয়ে এনবিআর ও এফবিসিসিআই একমত হয়েছিল, সেগুলো অন্তত বাস্তবায়িত হবে। বাকিগুলো নিয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা হবে। এর পরের দুই বছরে আইনটি বাস্তবায়িত হয়নি। এখন সরকার আইনটি বাস্তবায়ন করবে বলছে।
প্রশ্ন: এখন কি আপনাদের দাবিগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে?
জসিম উদ্দিন: আমাদের দাবিগুলোর বিষয়ে সুরাহা হয়নি। শুধু একটা বিষয়ে সরকার ছাড় দিয়েছে। সেটি হলো মূসকমুক্ত লেনদেনের সীমা ২৪ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩০ লাখ টাকা করেছে, যেখানে আমাদের দাবি ছিল ৩৬ লাখ টাকা করা। বাকি বিষয়গুলো এখনো সুরাহা হয়নি।
প্রশ্ন: আপনাদের আপত্তি কী কী?
জসিম উদ্দিন: এ আইনের অনেক ভালো দিক আছে। অনেক দেশের অনেক ভালো বিধান এ আইনে সন্নিবেশিত হয়েছে। বড় প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক কোম্পানির জন্য এ আইন অনেক ভালো। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারিদের জন্য আইনটি সংশোধন করা দরকার। রেয়াতের সুবিধা নিতে পারলে ব্যবসায়ীর ওপর চাপ কম হবে। তবে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পক্ষে রেয়াত নেওয়ার মতো হিসাব ও নথিপত্র ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব নয়। আবার ক্ষুদ্র উৎপাদনকারী, যারা নিজেরা কাঁচামাল আমদানি করে না, তাদের পক্ষেও রেয়াত নেওয়া কঠিন। এতে বড়দের চেয়ে ছোটদের মূসকের বোঝা বেশি হবে, তাদের পণ্য প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। মূসক আসলে বেশ জটিল কর পদ্ধতি। এখানে রেয়াত নিতে হলে হিসাবরক্ষক নিয়োগ দেওয়া দরকার।
প্রশ্ন: আসলে মূসক আইনের প্রভাব কী হবে?
জসিম উদ্দিন: অনেক পণ্য আছে, যেগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয়। সেগুলোর ওপর এখন নামমাত্র মূসক আরোপ করা আছে। প্রতি স্তরে ১৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপ করা হলে জনগণের ওপর চাপ পড়বে। শেষ পর্যন্ত মূসক তো ক্রেতার কাছ থেকেই আদায় করা হবে। এখন মূসক আইনের প্রভাব বোঝা যাচ্ছে না, পরে বোঝা যাবে। সরকারেরও হাত-পা বেঁধে ফেলা হচ্ছে। সরকার যে পরিস্থিতি বুঝে মূসকের হার পাল্টাবে, সে সুযোগ আইনে থাকছে না। জরুরি কারণে কোনো পণ্যে মূসক কমাতে হলে আইন পাল্টাতে হবে।
প্রশ্ন: আপনি বলছেন, এখন মূসক আইনের প্রভাব বোঝা যাচ্ছে না। এ ধরনের আইনের প্রভাব সমীক্ষা না করে বাস্তবায়ন করা কি উচিত?
জসিম উদ্দিন: আমার ধারণা, কোনো দেশে এ ধরনের আইনের প্রভাব সমীক্ষা করে দেখার পরই তা কার্যকর করা হতো।
প্রশ্ন: এ আইনে কি কর আদায়কারীদের অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
জসিম উদ্দিন: এ আইনে একটি বিধান আছে, যেখানে বলা হয়েছে, ব্যবসায়ী মূসক ফাঁকি দিলে সে জন্য তাঁর আত্মীয়স্বজনও দায়ী হবেন। এটা নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি। আমি ব্যবসা করেছি, এ জন্য আমি দায়ী হব। আমার আত্মীয়েরা কেন দায়ী হবেন? এ ছাড়া আইনে রাজস্ব কর্মকর্তাদের অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যার অপব্যবহার হতে পারে।
প্রশ্ন: নতুন আইন বাস্তবায়িত হলে অনেক পণ্যে সম্পূরক শুল্ক উঠে যাবে। এ নিয়ে কী বলবেন?
জসিম উদ্দিন: সম্পূরক শুল্ক উঠে গেলে অনেক খাত টিকতে পারবে না। এখন সুরক্ষা থাকার পরও অনেক খাত টিকতে পারছে না। সুরক্ষা না থাকলে কী অবস্থা হবে, তা বোঝা যায়। সব দেশই তো স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেয়। বাংলাদেশে অ্যান্টি-ডাম্পিং জাতীয় শুল্ক আরোপের সক্ষমতা এখনো তৈরি হয়নি। সরকার, ট্যারিফ কমিশন এ বিষয়ে প্রস্তুত নয়। ব্যবসায়ীদেরও ঘাটতি আছে। ফলে সম্পূরক শুল্ক এখন তুলে নেওয়া ঠিক হবে না।
প্রশ্ন: মূসকের হার কি ১৫ শতাংশ থেকে কমানো উচিত?
জসিম উদ্দিন: মূসকের হার পণ্যভেদে ভিন্ন হওয়া উচিত। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে কম হওয়া উচিত, বিলাস পণ্যে বেশি হওয়া উচিত। ভারত কিন্তু সেটাই করছে। বাংলাদেশে একক হারের বদলে ভিন্ন হার হলে সেটাই হবে যুক্তিযুক্ত।
সৌজন্যে: প্রথম আলো।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
মূসক আইন তৈরিতে আমাদের কথা আমলে নেওয়া হয়নি: মো. জসিম উদ্দিন, সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই https://corporatesangbad.com/470508/ |