বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারীকরণ কমিশনকে একত্র করে গঠিত সংস্থা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ব্যবসায় পরিবেশের উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকার চায় ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা করা বা ইজ অব ডুইং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশকে ১৭৬তম থেকে ১০০তম অবস্থানের নিচে নিয়ে আসতে। এ ক্ষেত্রে উন্নতি, এক দরজায় সব সেবা নিশ্চিত করা, বিডার কার্যক্রম, বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থের উৎস ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেছেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম।
প্রশ্র: ব্যবসার পরিবেশের উন্নতিতে আপনারা বেশি জোর দিচ্ছেন, যাতে বিশ্বব্যাংকের ডুইং বিজনেস সূচকে উন্নতি করা যায়। এটা কীভাবে সরকারের অগ্রাধিকারে এল এবং আপনারা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
আমিনুল ইসলাম: ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ডুইং বিজনেস সূচক প্রকাশ করছে। এতে গত বছর ১৮৯টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ছিল ১৭৬তম। তার মানে হলো, বাংলাদেশ একেবারে নিচের দিকে অবস্থান করছে। এ ধরনের অবস্থা থাকলে আমরা নিজেদের উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণ করতে পারব না। ২০২১ সালে মধ্যম আয় ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হতে গেলে আমাদের এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে, যে অবস্থা মানুষকে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলবে। এ চিন্তা থেকেই ডুইং বিজনেসে উন্নতির জন্য কাজ শুরু হয়েছে।
প্রশ্র: ডুইং বিজনেস সূচকে উন্নতির জন্য কী কী করা হচ্ছে এবং হবে?
আমিনুল ইসলাম: বিনিয়োগকারী একটি সামগ্রিক পরিবেশের মধ্যে কাজ করেন, যাকে আমরা বলি ব্যবসায় পরিবেশ। তাই প্রথমেই আমরা চিন্তা করেছি, তাঁদের যেসব সেবা, অনুমোদন ও লাইসেন্স দরকার হয়, তা যেন সহজে পান। দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করব। তৃতীয় পর্যায়ে আমরা বিনিয়োগকারীদের জন্য সামগ্রিক একটি ব্যবস্থা তৈরি করব, যেখানে স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বস্তির সঙ্গে ব্যবসা করা যায়।
প্রশ্র:আপনারা তো কোন কোন সেবা কত দিনে দেওয়া হবে, তা ঠিক করে দিচ্ছেন। কয়েকটি কি উল্লেখ করবেন?
আমিনুল ইসলাম: বিশ্বব্যাংক বলছে, ব্যবসা শুরুর অনুমোদনগুলো দিতে সাড়ে ১৯ দিন সময় লাগে। আমরা সেটা ৫ দিনে নামিয়ে আনব। বিদ্যুৎ-সংযোগ পেতে ৪০৪ দিন লাগে, সেটা ২৮ দিনে নামিয়ে আনা হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, তাঁরা এর চেয়েও কম সময়ে এখন বিদ্যুৎ-সংযোগ পাচ্ছেন। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নির্মাণকাজের অনুমতি পেতে ১৬৯ দিন লাগে, আমরা সেটা ৬০ দিনে নামিয়ে আনছি। কয়েকটি ঘটনায় আমরা দেখেছি, এখন ৪০-৪৫ দিনেও নির্মাণকাজের অনুমতি মিলেছে। ঋণ দেওয়া ও নেওয়ার সুবিধার জন্য জামানত হিসেবে দেওয়া জমির একটি তথ্যভান্ডার হবে, যা ইন্টারনেটে থাকবে, যাতে মানুষ দেখতে পারে। ঋণ দেওয়া সহজ করতে এমন আরও কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চুক্তির বাস্তবায়নের দুর্বলতা দূর করতে আদালতের সংখ্যা বাড়াতে এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) সক্ষমতা বাড়াতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ডুইং বিজনেসের ১০টি বিষয়ের প্রতিটির ক্ষেত্রে উন্নতির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কর দেওয়া সহজ করা ও করের হার নিয়ত পরিবর্তন হওয়া রোধ করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে আমরা আলোচনা করছি।
প্রশ্র: আমরা দেখতে পাচ্ছি কিছু সেবা বিনিয়োগকারীরা দ্রুত পেতে শুরু করেছেন। এতে কি আগামী বছরই ডুইং বিজনেস সূচকে আমরা উন্নতি দেখতে পাব?
আমিনুল ইসলাম: অবশ্যই। এবারের র্যাঙ্কিংয়ের জন্য আমরা মাত্র তিন মাস কাজ করার সময় পেয়েছি। তবে আমি আশা করি, পরবর্তী বছরের র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে। তবে আমাদের কার্যক্রম পাঁচ বছরের। সংস্কার এক বছরের বিষয় নয়, চলমান বিষয়।
প্রশ্র: বিনিয়োগকারীদের এক দরজায় সব সেবা দিতে সরকার ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন করছে। এই আইনটির প্রয়োজন কেন হলো, আইন ছাড়া কি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেবা দিতে বাধ্য করা যাচ্ছিল না?
আমিনুল ইসলাম: এটা ঠিক না, সব সংস্থাই রাজি হচ্ছিল। তবে সংস্থাগুলোর আইন, বিধি, প্রথা ও পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন, যা একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে সেবা দিতে নেতিবাচক অবস্থা তৈরি করে। ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন অন্য সব আইনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে (অসামঞ্জস্য দেখা দিলে অন্য আইনের সংশ্লিষ্ট অংশ অকার্যকর হবে)। এতে সেবা দেওয়া সহজ হবে। ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইনে সংস্থাগুলোকে একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে সেবা দিতে ক্ষমতায়ন করা হবে।
প্রশ্র: বিনিয়োগকারীরা কবে থেকে পুরোদমে এক দরজায় সব সেবা পাবেন?
আমিনুল ইসলাম: এটা নিয়ে যারা আমাদের কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে কাজ চলছে। বিশ্বব্যাংক, আইএফসি আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা আশা করছি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমরা ওয়ান স্টপ সার্ভিস কার্যকরভাবে দিতে পারব।
প্রশ্র: অন্যান্য দেশে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের অভিজ্ঞতা কী? সেখানে এই সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে কি? এতে কি ডুইং বিজনেসে তাদের উন্নতি হয়েছে?
আমিনুল ইসলাম: অনেক দেশে এটা ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে যেসব দেশে সরকার দুর্বল। সফল দেশও আছে। আমরা ২৩টি দেশের বিশ্লেষণ করেছি। যারা ব্যর্থ, তাদের ব্যর্থতার কারণ দেখার চেষ্টা করেছি। যারা সফল হয়েছে, তাদের সাফল্যের উপাদানগুলো অতি যত্নসহকারে দেখে বাংলাদেশের ওয়ান স্টপ সার্ভিসটির কাঠামো সাজানো হয়েছে। যাতে ব্যর্থতার কোনো সুযোগ না থাকে।
প্রশ্র: বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আপনি কোন কোন সমস্যাকে বড় করে দেখেন?
আমিনুল ইসলাম: কোনো সমস্যাকেই আমি ছোট করে দেখতে চাই না। একসময় বলা হতো, আমাদের দেশে নির্ঝঞ্ঝাট জমি নেই। সেটা সমাধান হচ্ছে, ভবিষ্যতে নির্ঝঞ্ঝাট জমির কোনো অভাব হবে না। কারণ, সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছে। সরকার বিদ্যুতের সমস্যা নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল, এখন শিল্পায়নের জন্য বিদ্যুতের সমস্যা নেই। গ্যাসের সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির টার্মিনাল তৈরি করা হচ্ছে। দুই বছরের মধ্যে সেগুলো কার্যক্রমে যাবে। এখন বিনিয়োগের পরিকল্পনা করলে দুই বছর পরে কারখানা চালু করতে গ্যাস লাগবে, তখন তা দেওয়া যাবে। বিনিয়োগকারীদের সেবা সমস্যা দূর করতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার হচ্ছে। বেশ কিছু অবকাঠামো প্রকল্পের কাজ চলছে। অবকাঠামো দুর্বলতা অদূর ভবিষ্যতে অনেক কমবে। আইন, বিধি, প্রথাপদ্ধতির সংস্কার চলছে এবং চলবে।
প্রশ্র: আপনারা যে এত সব কাজ করছেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা আসলে কতটুকু?
আমিনুল ইসলাম: পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম বিনিয়োগ-গন্তব্য হবে। বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি চেম্বারগুলো ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ থেকে আমরা প্রচুর আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি। তবে বিনিয়োগ শুধু ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে আসবে না। ভারত গত বছর তিন হাজার কোটি ডলারের মধ্যে দেড় হাজার কোটি ডলার পেয়েছে সিঙ্গাপুর থেকে। চীন, সিঙ্গাপুর, ভারত, মালয়েশিয়া, এমনকি ইন্দোনেশিয়ারও বিনিয়োগ-সক্ষমতা বেড়েছে।
প্রশ্র: প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী দেশের চেয়ে বাংলাদেশে করপোরেট কর অনেক বেশি বলে উল্লেখ করা হয়। আপনি কি মনে করেন বিদেশি বিনিয়োগ টানতে বাংলাদেশে করপোরেট কর কমানো উচিত?
আমিনুল ইসলাম: অনেক দেশ বিদেশি বিনিয়োগ আনার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। তাই অন্য দেশের সঙ্গে মিলিয়ে আমাদের দেশের করপোরেট কর হার ঠিক করতে হবে। এখানে মনে করা হয়, যদি করপোরেট কর কমানো হয়, তাহলে রাজস্ব আয় কমবে। কিন্তু আমার মনে হয়, করপোরেট করের ক্ষেত্রে রাজস্ব কিছুটা কমলেও সামগ্রিক রাজস্ব বাড়বে। কারণ, বিনিয়োগ বাড়লে মানুষের আয় বাড়বে, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে।
প্রশ্র: মেট্রোপলিটন চেম্বারের সাবেক সভাপতি নাসিম মঞ্জুর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন না করার পরামর্শ দিয়েছেন। এখন কি আমাদের দেশে প্রশ্ন করা হয়?
আমিনুল ইসলাম: বাংলাদেশে টাকার উৎস নিয়ে এখন প্রশ্ন করা হয় না। কারণ হলো, ধরে নেওয়া হয় যাঁরা বিদেশি অর্থ আয় করবেন, তাঁরা সেটা বৈধ উপায়েই করবেন। সেই দেশের আইন-বিধিবিধান অনুসরণ করেই করবেন। তাই একই ব্যক্তিকে একাধিক দেশে তদারকির আওতায় ফেলার প্রয়োজন নেই।
প্রশ্র: ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিডাকে পুরোনো বিনিয়োগ বোর্ডের মতো সংস্থায় পরিণত করা যাবে না। এ জন্য এই সংস্থাটির সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আপনি কী মনে করেন?
আমিনুল ইসলাম: বিনিয়োগ বোর্ডে যে জনবল ছিল, যে কাঠামো ছিল, তা একই রেখে আমরা ভিন্নতর ফল আশা করতে পারি না। বিডা আইনের অধীনে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব আমরা দিয়েছি, সেটা দেখলে বিডাকে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান মনে হবে না। সরকারি বেতন-ভাতার বাইরেও সঠিক যোগ্যতার জনবল সংগ্রহের ব্যবস্থা এই কাঠামোতে থাকবে।
সৌজন্যে : প্রথম আলো।
© ২০২৩ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | কর্পোরেট সংবাদ সম্পাদক - মোঃ মিজানুর রহমান । উপদেষ্টা সম্পাদক- জেসমিন আক্তার, এফসিএস ই-মেইলঃ corporatesangbad@gmail.com । ফোনঃ ০২২২-৩৩৫৪১২৫ । মোবাইলঃ ০১৭১১০৭৬৮১৫ অফিসঃ ৫৫/বি, নোয়াখালী টাওয়ার, ১১ তলা, সুইট ১১-এফ, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ |
আগামী বছরই সহজে ব্যবসার সূচকে উন্নতি: কাজী এম আমিনুল ইসলাম, নির্বাহী চেয়ারম্যান, বিডা https://corporatesangbad.com/470507/ |