চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক কূটনীতিক ড. এ কে আবদুল মোমেন। এর আগে তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৮ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও মেশন ফেলো হিসেবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী ড. মোমেন ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্ব ব্যাংকের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন।
বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রবীণ এ কূটনীতিক সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি নিম্নে তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন : দেশের সার্বিক অর্থনীতি কীভাবে দেখছেন?
আবদুল মোমেন: আমাদের অর্থনীতি বেশ সম্ভাবনাময়। কেননা দেশে খুব একটা স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ একটি সফল দেশ। পৃথিবীর মধ্যে যতগুলো দেশ আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি হতে যাচ্ছে। আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অনেক উন্নত দেশ থেকে এগিয়ে রয়েছি। এমনকি আমরা চায়নাকেও সেদিক দিয়ে হার মানিয়েছি। সুতরাং এটা দেশের অগ্রগতির বড় সঙ্গী। আমরা বড় একটি অর্জনের পথে আছি। এজন্য সরকার বেশ গুরুত্বের সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এখন কী করণীয়?
আবদুল মোমেন: আমরা যদি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চাই, তাহলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। মোট বিনিয়োগের ৭৭ শতাংশ আসতে হবে প্রাইভেট সেক্টর থেকে। আর মাত্র ২৩ শতাংশ লাগবে সরকারের। কিন্তু বর্তমানে এ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ ২৩ শতাংশ মাত্র। এজন্য ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের হাত ধরেই টেকসই উন্নয়ন করতে হবে। আর সরকার তাদের পলিসি ও অবকাঠামোগত সহযোগিতা করবে। আমাদের উন্নয়নের বাজেট একসময় হতো ঋণনির্ভর। সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, এখন কিন্তু বেশি ঋণ নিতে হয় না, অনেকটাই কমে এসেছে। আমরা এখন অনেক পরিপক্বতা অর্জন করেছি।
প্রশ্ন : টেকসই উন্নয়নের জন্য পুঁজিবাজার কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে?
আবদুল মোমেন: আমাদের এখন দরকার বড় বিনিয়োগ। বিভিন্ন হিসাব-নিকাশে দেখা গেছে, শুধু এশিয়ায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আট ট্রিলিয়ন ডলার দরকার। এতো টাকা কোথা থেকে আসবে! আমাদের যারা উন্নয়ন সহযোগী তাদেরও এতো টাকা নেই। আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত টাকা নেই। দেশের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে হাতিয়ার হিসেবে পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি করা হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন হবে।
প্রশ্ন : অবকাঠামোগত উন্নয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ব্যবহারের কোনো সুযোগ আছে কি?
আবদুল মোমেন: রিজার্ভ আমাদের জন্য ভালো। তবে বেশি রিজার্ভ হলে বাহবা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এরও যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। অবশ্য এজন্য সরকার ইতোমধ্যে উদ্যোগী হয়েছে, এটা কিন্তু ভালো লাগার বিষয়।
প্রশ্ন : ব্রেক্সিট ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে কতটুকু প্রভাব ফেলবে?
আবদুল মোমেন: আমাদের পৃথিবী অনেক সম্ভাবনাময়। আমরা স্বপ্ন দেখছি, পৃথিবীতে দারিদ্র্য বলতে কিছু থাকবে না। এখানে কেউ ঝরে পড়বে না। কিন্তু ব্রেক্সিট ও মার্কিট যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল বিশ্ববাসীকে চরম হতাশ করেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি বড় ধরনের একটা ধাক্কা খেয়েছে। আমরা এখনও জানি না, কতটুকু নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে বেক্সিট ও ট্রাম্পের জয়লাভে উন্নয়নের মনমানসিকতা থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। সুতরাং আমি মনে করছি, বৈদেশিক বিনিয়োগ বেশি পাবো না। তাই এখন আমাদের স্থানীয় বিনিয়োগে মনোযোগ দিতে হবে। এজন্য পুঁজিবাজারের দিকে তাকাতে হবে।
প্রশ্ন : বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় অর্জন কী বলে আপনি মনে করেন?
আবদুল মোমেন: দেশের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস অনেক উপরে উঠিয়ে দিয়েছেন। আমরা পারি এই বিশ্বাসটাকে মজবুত করেছেন। এটা আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে তুলেছেন। তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। সেই স্বপ্ন এখন আমাদের সবার হয়ে গেছে। স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ঘুম হারাম। স্বপ্ন পূরণে আমাদের মাথাপিছু ১২ হাজার মার্কিন ডলার আয় হতে হবে। এজন্য আমাদের অনেক খাটতে হবে। তবে আমরা কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।
প্রশ্ন : প্রধানত কী কী সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে?
আবদুল মোমেন: আমাদের প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে অবকাঠামো। এ সমস্যা দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের সমস্যা সমাধান করতে লাগবে টাকা অর্থাৎ দৃশ্যমান সমস্যা যেমন রাস্তাঘাট, গ্যাস-বিদ্যুৎ ইত্যাদি। আর দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে অদৃশ্যমান। এ সমস্যার সমাধান টাকা দিয়ে করা যাবে না। আইন-কানুন ও রীতিনীতি সম্পর্কিত সমস্যা। এগুলোয় যদি উৎকর্ষ সাধন না করি, তাহলে আমরা হোঁচট খাবো।
অদৃশ্যমান সমস্যা হচ্ছে সরকারি পলিসি বেশি হওয়া। আমাদের দেশে এতো আইন-কানুন যে, সরকারই আইন-কানুনের ভেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আমিও এর ভুক্তভোগী। উন্নয়নমূলক অনেক কার্যক্রমেই আমি হোঁচট খেয়েছি। এর কারণ, আইন-কানুনের আধিপত্য। আর এগুলো করতে হলে টাকা থাকলেই হবে না। প্রয়োজন সেবাদাতা ও গ্রহীতাদের সমন্বয়। এজন্য তাদের মধ্যে ঐকান্তিক সংলাপের মাধ্যমে এসব আইন-কানুনের ভেড়াজাল দূর করতে হবে।
দ্বিতীয় বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা যে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছি, তা পাড়ি দিতে হলে রাস্তাঘাট ও ব্রিজসহ আট লেনের মহাসড়ক নির্মাণের কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। এগুলো ম্যানেজ কারার জন্য উন্নতমানের দক্ষ জনবল দরকার। এজন্য গুণগত শিক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে। উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রশ্ন : অন্যান্য দেশে বন্ড মার্কেট বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ মার্কেটে লেনদেন নেই বললেই চলে…
আবদুল মোমেন: যথেষ্ট ভালো বলেছেন, বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক দেশেই বন্ড মার্কেট জনপ্রিয়। আমাদের দেশে এটা জনপ্রিয় করতে সবার উদ্যোগী হতে হবে। এছাড়া আমাদের শিল্পপতিদের ব্যাংক থেকে অর্থ তোলার ভাবনাও কমানো উচিত। তাদের পুঁজিবাজারে শেয়ার ছেড়ে অর্থ উত্তোলনে মনোনিবেশ করতে হবে।
প্রশ্ন : আমাদের পুঁজিবাজারের সম্ভাবনা কতটুকু?
আবদুল মোমেন: অর্থনৈতিকভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের এই অগ্রযাত্রাকে আরও গতিশীল করতে পুঁজিবাজার বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। দেশের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে হাতিয়ার হিসেবে পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি করা হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন হবে।
প্রশ্ন : বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে আপনার বক্তব্য কী?
আবদুল মোমেন: পুঁজিবাজার উঠবে, নামবে এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বাস রাখেন বাজার ভালো হবে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার আগে বাজারের প্রতি বিশ্বাস বাড়াতে হবে। আস্থা রাখতে হবে। আস্থা, বিশ্বাস আর ধৈর্যের সঙ্গে বিনিয়োগ করলে বিনিযোগকারীরা লোকসানের মুখে পড়বেন না। যদিও মাঝখানে স্টক মার্কেট একটা বদনাম কুড়িয়েছে। এরপরে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারসহ স্টেকহোল্ডাররা নানা উদ্যোগ নিয়েছে। মার্কেট একটা ভালো অবস্থানে গিয়ে পৌঁছেছে।
প্রশ্ন : আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আবদুল মোমেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
সৌজন্যে: শেয়ার বিজ